করিম সাহেব (ছদ্মনাম)। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুব শান্তিতে বসবাস করছেন। কিন্তু মাদকের হিংস্র ছোবলে সুখের সংসার পুড়ছে অশান্তির আগুনে। পরিবারে সবাই শিক্ষিত। অথচ তাদের ২৪ বছরের পড়ুয়া একমাত্র মেয়েটি মাদকাসক্ত। কোনভাবেই সংশোধন করা যাচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের শরণাপন্ন হন তারা। অশ্রুসিক্ত চোখ আর বিষন্ন মুখে আঁকুতি জানান, মেয়েকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে আমাদের রক্ষা করুন। ঘটনাটি যশোর শহরের সিটি কলেজপাড়ার। শিক্ষিত পরিবারটির উদ্ধৃতি দিয়ে যন্ত্রণার চিত্র দৈনিক ইনকিলাবের কাছে বর্ণনা করলেন যশোর মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মো. বাহাউদ্দিন।
অভয়নগরের এক এনজিও কর্মীর স্বামী মারা যান বেশ আগে। সামান্য পয়সার চাকরি করে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন। কিন্তু সর্বনাশা বিষের বোতলে তার স্বপ্ন বিষময় হয়ে উঠেছে। কোনভাবেই মাদক থেকে ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। সংসারের জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়ে মাদকসেবন করছে। শুধু যশোর ও অভয়নগরের দু’টি পরিবার নয়, অসংখ্য পরিবারে সুখ শান্তি বিনষ্ট করছে মাদক। নিরব মারণাস্ত্র মাদক দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
মাদকাসক্ত যুবকরা হত্যা, ছিনতাই, চুরি ও ধর্ষণসহ অপরাধ ঘটাচ্ছে একের পর এক। যুব সমাজকে গ্রাস করছে মাদক। মাদকনেশায় ডুবে পথভ্রষ্ট হচ্ছে তুলনামূলক বেশি স্কুল কলেজের ১৬ থেকে ২৫ বছরের তরুণ-তরুণী , যুবক-যুবতীরা আসক্ত। আর শিক্ষিত বেকার যুবকরা। অপরাধ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও সমাজবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, মাদকের ভয়াল থাবায় নীতি-নৈতিকতা ধ্বংস হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক শক্তি নষ্ট হয়ে মাদকাসক্তরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। কোন পরিশ্রমী, খেটে খাওয়া কিংবা কাজের মধ্যে ডুবে থাকা মেহনতি মানুষের মাদকাসক্ত হওয়ার তথ্য নেই বললেই চলে। ধর্মবিমুখ, আত্মবিশ্বাস হারানো ও বেপথু বন্ধু-বান্ধবদের কারণেই যুব সমাজকে মাদকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
যশোর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর কামরুল এনাম দৈনিক ইনকিলাবকে প্রসঙ্গক্রমে বলেন, মাদকের ভয়াল থাবা ধর্ম ও পরিবারের অস্তিত্বের কাঠামোর উপর বিরাট আঘাত হানছে। তছনছ করে দিচ্ছে। এটি সুদূরপ্রসরী প্রভাব ফেলছে। জীবন সভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি। এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।
যশোর মাদক নিরাময় কেন্দ্রের ম্যানেজার আমিরুজ্জামান লিটন জানান, যশোরে ২টি নিরাময় কেন্দ্রে অর্ধশত যুবক-যুবতী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের বেশিরভাগই শিক্ষিত। সূত্র জানায়, যশোর গাজীরঘাট রোডের শেখ জামসেদ আলী নামের ২৬ বছরের এক যুবক সম্প্রতি মাদক সেবনের সময় হাতেনাতে মোবাইল কোর্টের অভিযানে আটক হয়। তিনি মাদক না খেলে শরীর ঝিমঝিম করে বলে সংশ্লিষ্টদের জানান। নিয়মিত এক মাদকসেবীর বক্তব্য ‘অন্ধকার নেমে এলেই সারা শরীরের মধ্যে একটা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। মাদক সেবনের পরই অস্থিরতা কেটে যায়। তাই মাদক সেবন করি’।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত অ্যালকোহাল মিশ্রিত, নকল, ভেজাল, মেয়াদউত্তীর্ণ ও বিষাক্ত ফেনসিডিল সেবনে মাদকসেবীরা কর্মশক্তি হারিয়ে শারিরীক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে যায় মাদকে। প্রসঙ্গত, যশোরে অতি সম্প্রতি বিষাক্ত মদ খেয়ে পরপর ৩ দিনের ব্যবধানে ১১ জনের মৃত্যু হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জানান, শীতকালে মাদকের ব্যবহার অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। সেজন্য আসছেও বেশি, তবে আটকের ঘটনাও বেশি। তার মতে, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এবং মোবাইল ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীরা হাতের নাগালেই পেয়ে যাচ্ছে মাদক। তারপরেও আমরা সর্বোতভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি মাদক নিয়ন্ত্রণে। মাঠপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়। এজন্য মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে অস্ত্রধারী নিযুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, বিষের বোতল ফেনসিডিল ভারত থেকে আসছেই। নতুন যোগ হয়েছে ইয়াবা। নীরবে সর্বনাশ ঘটছে যুব সমাজের। অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ফেনসিডিলসহ মাদকদ্রব্য। এতে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা ও পারিবারিক অশান্তি। বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে দেশের বিভিন্ন সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই আটক হচ্ছে ভারত থেকে আসা ফেনসিডিল। জানা গেছে, মাদকসেবীদের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য বিদেশী অর্থ সাহায্য পায় বিভিন্ন এনজিও। কিন্তু যার কিয়দংশ ব্যয় হয় না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, যশোরে বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে মাদকের বিরুদ্ধে। যশোর পুলিশ সূত্র জানায়, মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান চলছে। প্রতিনিয়ত মাদক উদ্ধার ও মাদক বিক্রেতারা আটক হচ্ছে। ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, বেনাপোল, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও ঢাকার বেশ কয়েকজন গডফাদার কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে ‘সর্বনাশা ব্যবসা’ পরিচালনা করছেন। সীমান্ত সূত্র জানায়, বেনাপোলের ওপারের কৃঞ্চপদ, গোপাল ও আশিক এবং এপারের বিপুল, জাকির ও আলমগীরসহ সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী একটি চক্র আছে, যাদের নেটওয়ার্ক ঢাকা ও কলিকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন