শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মাদকের ট্রানজিট বগুড়া

বিস্তৃতি এখন গ্রামেও তছনছ বহু পরিবার

মহসিন রাজু | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

বগুড়ার শিবগঞ্জে দরিদ্র নিজামের পরিবারে হতাশার মাঝে একটু আশার আলো তার ছেলে মিজান। জীবন সংগ্রামে প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া নিজামের স্বপ্ন ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হলে দূর হবে সকল অন্ধকার। তাইতো শত কষ্টের মাঝে ছেলেকে করেছেন উচ্চ শিক্ষিত। মেধাবী মিজানের চাকরি পেতেও খুব একটা দেরি হয়নি। ছেলের চাকরিতে নিজামের পরিবারে উকিঁ দিয়ে ছিল আলো। ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু ভয়াল মাদকের জালে হঠাৎ আটকে যায় মিজান। সুখের সাজানো সংসারে দেখা দেয় অশান্তি। শান্তির খোঁজে তিনি ছেলেকে বিয়েও করিয়েছেন। কোনভাবেই মাদকের জাল থেকে বের হচ্ছে না মিজান। মাদকাসক্তির কারণে মিজানের স্ত্রীও তাকে তালাক দেয়। চাকরি থেকে ছাঁটাইও করা হয় তাকে। বেকার হয়ে সে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে নিয়মিত মাদক সেবন চালিয়ে যায়। আশার প্রদীপ মিজান হয়ে যায় সংসারে বোঝা। এমনকি টাকার জন্য ছেলের প্রহারও সইতে হয়েছে নিজামকে। এভাবে একদিন টাকা না পেয়ে ক্ষিপ্ত ছেলে লাঠির আঘাতে মৃত্যু হয়েছে তার।
শহরের বাসিন্দা হাসান আহম্মেদের মাদকাসক্ত এক ছেলে নেশার টাকা না পেয়ে ছুরিকাঘাতে তার মাকে খুন করলে এ ঘটনাটি বগুড়া শহরে খুব আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়। এছাড়া সম্প্রতি বগুড়ার একটি বিখ্যাত ধনী ও শিল্পপতি পরিবারের পরিবারের একমাত্র পুত্র অতি মাত্রায় মদ্যপানের কারনে স্ট্রোক করে মারা গেলে পিতাও একই কারণে একমাসের ব্যবধানে বিকারগ্রস্ত্র অবস্থায় মারা যান। মিডিয়ায় পিতা পুত্রের মৃত্যুর আসল কারণ চেপে যাওয়া হলেও মানুষের মুখে মুখে তা’ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় । শুধু নিজাম কিংবা হাসান, বগুড়া জেলাসহ উত্তরাঞ্চলে অনেক পরিবারে বর্তমান চিত্র এটি। মাদকাসক্তির কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা, অকাল মৃত্যুর অজস্র ঘটনা ঘটেছে বগুড়ায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে বগুড়ার ধুনট উপজেলায় সুবর্না (১৪) নামের এক স্কুলছাত্রীকে মাদক বিক্রির সময় হাতে নাতে ইয়াবা ও গাঁজার পুরিয়া ও মাদক বিক্রির টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে সুবর্না বলে তার মরহুম পিতা সিরাজ মিয়া ছিল মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী। নেশার কারণে বাবার অকাল মৃত্যু হলে সংসারের হাল ধরতেই সে মাদক ব্যবসাকে অবলম্বন করে। সুবর্নার মত বহু সংখ্যক বালিকা কিশোরী বা তরুণী এখন মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে নিজেরা যেমন ধ্বংস হচ্ছে তেমনি সমাজ ধ্বংসের কারন হয়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক অভিঘাত, সামাজিক সংঘাত, সামাজিক পরিবর্তন এমনকি বর্তমানের করোনা ইস্যুতে অনেক কিছু বদলে গেলেও মোটেই বদলেনি মাদকের ব্যবহার ও ব্যবসা। বরং বেড়েছে মাদকের ব্যবহার ও ব্যবসার ক্ষেত্র হয়েছে বিস্তৃত।
উত্তরাঞ্চলের ‘গেটওয়ে’ বা প্রবেশদ্বার খ্যাত বগুড়াকে ঘিরেই মূলত বিস্তৃত মাদকের আন্তঃজেলা ও আন্তঃদেশীয় নেটওয়ার্ক। মাদকের এই কারবারের সাথে জড়িত, ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ী, বাহকরা অসংখ্যবার ধরা পড়লেও এর মুল নিয়ন্ত্রক বা গড ফাদাররা সব সময়েই থেকে যায় অধরা। ফলে আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এই কারবার সাময়িকভাবে থমকে দাঁড়ালেও সময়ের ব্যবধানে নতুন নতুন কৌশলে আবার শুরু হয় মাদক ব্যবসা ।
বগুড়া ডিবিতে কর্মরত একজন কর্মকর্তা জানালেন, চলতি বছরের করোনা ডামাডোলের মধ্যেও বগুড়ায় ইয়াবা, ফেন্সিডিল,গাঁজা উদ্ধার সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে মাদক রিকোভারি ও মামলার সংখ্যা ওই পরিমাণেই হয়ে থাকে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শক্তিশালী রাজনৈতিক গড ফাদারের ছত্রচ্ছায়ায় টেকনাফ ও কক্সবাজার ভায়া হয়ে মিয়ানমার থেকে বগুড়ায় আসে ইয়াবা ট্যাবলেটের ছোট বড় অসংখ্য চালান। শুরুতে লাল কালারের ইয়াবা আসলেও ইদানিং হলুদ, নীল ও সবুজ রঙের ইয়াবার চালানও আসছে। ইয়াবার এই রং পরিবর্তন নাকি ইয়াবাসেবীদের মনে বিশেষ রং ধরায়, নেশায় আনে অভিনবত্ব।
মাদক নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত একটি সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী বগুড়া জেলায় মাদকসেবীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আগে শুধু শহরাঞ্চলেই মাদকের বেচাকেনা ও সেবন সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে বিস্তার ঘটেছে মাদকের । পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মাদকের গডফাদারদের রাজনৈতিক আশ্রয় বন্ধ না হলে মাদকের নির্মুল বা নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই সম্ভব হবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন