বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মাদকে বিষময় জীবন

রাজশাহীতে ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল হোতারা : চিন্তিত অভিভাবকরা

রেজাউল করিম রাজু : | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

রহিমা খাতুন। চার মেয়ের পর জন্ম তার দুই ছেলের। ছোট ছেলের জন্মের পর মারা যান তার স্বামী। স্বামীকে হারিয়ে ছেলেদের বুকে চেপে ধরে চালিয়ে যান জীবন সংগ্রাম। স্বপ্ন দেখেন ছেলেরা শিক্ষিত হলে সচল হবে অর্থনেতিক চাকা। অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রকট হওয়ায় ছেলেদের লেখাপড়া বেশি চালাতে পারেন নি। তাদের সাথে নিয়ে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। ভালোই চলছিল ব্যবসা। ধীরে ধীরে সোনালী আলোয় আলোকিত হচ্ছিল তার সংসার। হঠাৎ সর্বনাশা মাদকের থাবায় বিষময় হয়ে ওঠে তার জীবন। ছেলে দুটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা।

ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় ছেলেদের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাও কিনে দিয়েছিলেন, সেটিও শেষ। দুই ছেলেই বেকার। বড় ছেলে বিয়ে করেছে, সন্তানও আছে। বাধ্য ছোট ছেলেকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ছোট ছেলে কারাগারে থাকা অবস্থায় কিছুদিন পরই আবার বড় ছেলেকে পুলিশে ধরিয়ে দেন। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি না করার কারণ প্রশ্নে রহিমা জানান, নিরাময় কেন্দ্রে দিতে হলে প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা গুনতে হবে। সেটা আরও অসম্ভব বলেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি। ‘ছেলেদের হাজতে পাঠাতে খুব কষ্ট হয়। পথে পথে কেঁদে বেড়াই। মাছ-মাংস খেতে পারি না।’ মাদকে থাকায় নিঃস্ব এক মা এভাবেই তার অসহায়ত্বের কথা জানলেন। রহিমা নয়, রাজশাহীতে এমন সন্তান নিয়ে অনেক মা এবং এমন মাদকাসক্ত স্বামী নিয়ে অনেক স্ত্রী বিপাকে পড়েছেন। নেশার খরচ জোগাড় করতে করতে তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, করোনা সঙ্কটে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় শহর ছেড়ে নিজ নিজ ঘরে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন গ্রামে থাকায় সেখানে তারা হাঁফিয়ে উঠেছে। সময় কাটাতে দলবদ্ধভাবে আড্ডা দিচ্ছে। চায়ের দোকানের সামনে ক্যারাম তাস খেলছে। এরমধ্যেই চলে জুয়া খেলা আর মাদক সেবন। অনেকে কমলমতি তরুণ তরুণীরা প্রথমে নিজের অজান্তে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। অভিভাবকরা চিন্তিত তাদের সন্তান নিয়ে। পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠেছে ভাই কেন্দ্রিক বলয়। রাজনৈতিক বড় ভাইদের ছায়ায় এসব ছোট ভাইয়েরা ক্রমশ: বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মাদকের টাকা যোগাড় করতে ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। রাজশাহী মহানগরীর হেতমখা এলাকায় রাজশাহী কলেজের এক শিক্ষার্থী ছিনতাইকারী যুবকের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। আটকের পরে যুবক জানায় নেশার টাকা জোগাড় করতে সে এ কাজ করেছে। পবা এলাকায় নেশার টাকার জন্য মাদকাসক্ত সন্তান পিতাকে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনা ঘটিয়েছে। মাদকাসক্ত পুত্রের অত্যাচারে চারঘাটে সন্তানকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নজীর রয়েছে।
এ অঞ্চলে মাদক আসে ভারতের সীমান্ত গলিয়ে। আগে সবচেয়ে বেশি আসত ফেন্সিডিল। ভারতের মুর্শিদাবাদ আর মালদহ জেলার সীমান্তের কাছে গড়ে উঠেছে এর উৎপাদন কেন্দ্র। প্রথমে এটি ঔষধ কোম্পানী করলেও এখন তৈরি হয় সীমান্ত এলাকার ঝুপড়ি ঘরে। হেরোইন তৈরি হচ্ছে ভগবান গোলা আর লাল গোলায়। গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের নেশা ও যৌন উত্তেজনা ট্যাবলেটের সাথে হালে যোগ হয়েছে ট্যাপেন্টাডল।
এসব পদ্মা পেরিয়ে সহজে চলে আসছে এপারের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, চাপাইসহ সদর রাজশাহীর গোদাগাড়ী পবার চরাঞ্চল নগরীর গুড়িপাড়া, কাজলা, চারঘাট, বাঘা, নাটোরের লালপুর আর নওগার বিভিন্ন সীমান্ত পথে। ভারতের কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে আসছে। বিএসএফ সীমান্তে গরুর রাখাল আর মাছ ধরা জেলেদের অহরহ গুলি করে মারা আর ধরে নির্যাতন করা নিত্য ঘটনা হলেও মাদক আর অস্ত্র পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কাঁটাতারের চৌকিদাররা নমনীয়। ফলে সহজে চলে আসে এসব। আর এসব মাদকের মূল্য পরিশোধ করা হয় সোনার বার দিয়ে।
সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানী চক্র অত্যন্ত শক্তিশালী। এদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন মহল বিশেষ করে রাজনৈতিক আর্শীবাদের বিষয়টা মুখে মুখে। সরকারি বিশেষ সংস্থার রিপোর্টে মাদকের গডফাদার জনপ্রতিনিধি রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকেও সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টা উঠে এসেছে। জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে পর্যন্ত বার বার আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দৃশ্যত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিশেষ অভিযানেও ওরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে চোরাচালান রোধে বিশেষ করে মাদকের বিরুদ্ধে বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। মাঝে মধ্যেই এদের হাতে ধরা পড়ছে মাদক দ্রব্য ও বহনকারী। যা পাচার হয়ে আসছে তার ক্ষুদ্র অংশ ধরা পড়ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন