১৮ বছরের দাম্পত্য জীবন রেহেনা বেগম ও মাহে আলমের। তাদের সংসারে আছে তিন সন্তান। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ছোলা বুট বিক্রির টাকায় চলছিল তাদের সংসার। সীমিত আয়ের মাঝে সুখের ছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। হঠাৎ বন্ধুদের পাল্লায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন মাহে আলম । এরপর থেকে তিনি প্রায়ই স্ত্রীকে মারধর করতেন। একদিন স্ত্রী রেহেনাকে বুট ভাজার কথা বলে মাহে ঘুমিয়ে পড়েন। রেহেনা কাজ শেষে স্বামীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে যান। অতিরিক্ত ডাকাডাকির ফলে বিরক্ত মাহে আলম ঘুম ভেঙ্গেই স্ত্রীকে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করেন। এতে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রেহেনা। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত স্ত্রীকে কুমেক হাসপালে নিয়ে যান আলম। সেখানে চিকিৎসকরা রেহেনাকে মৃত ঘোষণা করলে মাহে আলম তার লাশ বাড়িতে এনে দ্রুত পালিয়ে যান। অন্যদিকে কুমিল্লায় মাদক সেবনে বাধা দেয়ার কারণে তালাবদ্ধ করে আরাফাত হোসেন (১৪) নামের এক কিশোরকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটে। সে কুমিল্লা শহরতলী চাঁনপুর এলাকার মো. আবুল বারেকের ছেলে বলে জানা যায়। নগরী সংলগ্ন কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার বউবাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতের বাবা মো. আবদুল বারেক বলেন, ওইদিন দুপুর ১টায় তার ছেলে আরাফাতকে বাড়ি থেকে চারজন ছেলে ডেকে বউবাজারে নিয়ে আসে। তিনি ঘটনাস্থলে এসে শুনতে পান একটি দোকানে আরাফাতকে তালাবদ্ধ করে বাইরে থেকে আগুন দেয়। এ ঘটনায় আরাফাত আগুনে পুড়ে মারা যায়।
কেবল মাহে আলম নয়, মাদকের নেশায় আচ্ছন্ন সদস্যদের নিয়ে বিপন্ন হাজারো পরিবার। শুধু প্রচার মাধ্যমে নয় এখন বাস্তব জীবনেও প্রত্যক্ষ করছেন অনেকেই। দেশের পূর্বাঞ্চলের মাদকদ্রব্যের বিস্তার ও ভয়াবহ মাদকাসক্তি পারিবারিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। পরিবারে চলছে বোকা কান্না।
আইনশৃঙ্খলা সূত্র জানা গেছে, মাদকের বিরুদ্ধে তারা সবসময় কঠোর অবস্থানে রয়েছে। প্রতিনিয়ত পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা- উপজেলায় জব্দ করা হচ্ছে মাদকদ্রব্য। জড়িতদের আটকের বিষয়ে ব্যাপক তৎপর তারা। তবে স্থানীয়রা বলছেন, পুলিশ কঠোর হলেও কোনভাবেই কমছে না সর্বনাশা মাদকের বিস্তার। প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাদকেসেবী ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা।
বিষয়টি অনুসন্ধানে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চালালেও মাদকের কুফল কিংবা পরিণতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ প্রচার-প্রচারণা নেই। ফলে মাদক ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ফাঁদে পড়ে অনেক তরুণ-তরুণী তাদের জালে আটকা পড়ছেন। কথা হয়েছে ইয়াবায় আসক্ত কুমিল্লার তেইশ বছরের এই তরুণ রাফির সাথে। দৈনিক ইনকিলাবকে তিনি বলেন, প্রথম প্রথম ওরা ফ্রি ইয়াবা দিয়েছিল, খাওয়ার ব্যবস্থাও বন্ধুরাই করে দিতো। তখন আমি বুঝতে পারি নাই অন্ধকার জগৎতে চলে যাচ্ছি আমি। তিনি বলেন, ইয়াবা খেলে কী হয়, এর ক্ষতির দিকগুলো কী - এ সম্পর্কে তাকে কেউ কখনো সচেতন করেনি। তবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার পর যখন পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি বুঝতে পারেন, তখন তারা তাকে ভালো করার অনেক চেষ্টা করেন। ভর্তি হয়েছিল মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে। কয়েক দফা চিকিৎসার পর তিনি এখন সুস্থ হয়েছেন। বর্তমানে তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছেন। অপর তরুণ সিহাব বলেন, আমি যখন মাদকে আসক্ত হই, তখন এর অপকারিতা বা ক্ষতির দিক সম্পর্কে জানতেন না। নিছক আগ্রহ বা বন্ধুদের পল্লায় পড়ে সে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তদের নিয়ে পারিবারিক বা সামাজিকভাবে লুকোছাপার কারণে একদিকে যেমন আসক্তদের চিকিৎসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি মাদকাসক্তি ঠেকাতেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। মুক্তি নামের একটি নিরাময় কেন্দ্রের পরিচালক ডা. ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, এটা ঠিক যে, মাদক নিয়ে পারিবারিক, সামাজিকভাবে সচেতনতার ব্যাপারে একটা ঘাটতি আছে। মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে তা এখনো অনেক অপ্রতুল বলা যায়। কারণ শহর এলাকা ছাড়িয়ে মাদক এখন তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে এবং তরুণরা ব্যবহার করছে। যতটুকু প্রতিরোধমূলক কর্মকান্ড হচ্ছে, তাও হচ্ছে বড় শহর এলাকায়, তৃণমূল পর্যায়ে আসলে সেরকম প্রচারণা নেই। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে মাদক পাওয়া যাচ্ছে এবং অনেক তরুণ-তরুণী আসক্ত হয়ে পড়ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের পূর্বাঞ্চলে ফেন্সিডিল ও গাঁজার বড় চালান আসে ফেনী, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে। এ তিনটি জেলার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে ভারতের সঙ্গে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গাদের কারণে কিছুটা কড়াকড়ির পর মিয়ানমারের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হয়ে সীমান্তপথে কুমিল্লা ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ঢুকছে মাদক। কুমিল্লায় হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে বিভিন্ন জেলার প্রধান প্রধান ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে মাদকগুলো। ইয়াবার পাইকারি বিক্রেতা বা সেলসম্যানের ভূমিকায় রয়েছেন কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি। এসব ব্যক্তির নাম পুলিশের অপরাধ তালিকায়ও রয়েছে। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও আইনের মারপ্যাঁচে ফলে তারা জামিন পেয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করছে।
মাদকের ভয়াবহতার বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞ ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেন, মাদক নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদি কোনো ধরনের অপারেশন সাময়িক স্বস্তি আনলেও কিছুদিন পর তা আবার আগের মতো হয়ে যাওয়ার বহু উদাহরণ রয়েছে। তিনি বলেন, সীমান্ত অরক্ষিত রেখে অভিযান চালালে খুব একটা লাভ আসবে না।
এ বিষয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন ভূঁইয়া দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কিছুদিন আগেও ইয়াবা ট্যাবলেট মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হতো। বর্তমানে মিয়ানমার থেকে সরাসরি ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে কুমিল্লা ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া হয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি আরো বলেন, মাদকের চাহিদা এবং জোগান দু’টি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাদকের চাহিদা বন্ধ করা গেলে যোগান থাকলেও কোনো লাভ নেই। কেউ মাদক কিনবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন