স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট (এসআইআই) উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম চালান আগামী ২৫ বা ২৬ জানুয়ারি দেশে আসবে। পাশাপাশি ভারত সরকার সেরামের ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন উপহার স্বরূপ বাংলাদেশকে দিবে। এটি আগামী ২০ জানুয়ারি আসছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ইতোমধ্য ভ্যাকসিন আনার অনুমতিও দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর।
গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) উদ্যোগে আয়োজিত ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ কথা বলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বেসরকারিভাবেও ভ্যাকসিন আমদানি ও প্রয়োগ করার অনুমোদন দেয়া হবে। এ জন্য নীতিমালা করা হয়েছে। তার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সেরামের সঙ্গে চুক্তি অনূযায়ী আগামী ২৫ বা ২৬ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম ধাপের ভ্যাকসিনের লট বাংলাদেশের প্রবেশ করবে। পরবর্তী এক সপ্তাহ পরেই আমাদের ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম শুরু করা হবে। এ জন্য ৪২ হাজার ভ্যাকসিন প্রদান কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তত করা হচ্ছে। ঢাকায় ৩০০টি চিকিৎসা কেন্দ্রে ভ্যাকসিন প্রদান কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। ১৮ বছরের নিচের কাউকে দেয়া হবে না।
করোনাভাইরাসে বিশ্ব বিপর্যস্ত। আর তাই অজানা করোনাভাইরাস সামলাতে নানা সমস্যা বা সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনাকালীন স্বাস্থ্য খাতে কিছু অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা হয়েছে। অবশ্য তা নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তিও দেয়া হয়েছে। আর তাই দুর্যোগ মোকাবিলার পাশাপাশি ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্যখাত, করোনার চিকিৎসায় নেই শয্যা কিংবা আইসিইউ সংকট। রাতারাতি বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টার তৈরির বিষয়টিও তুলে ধরেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রথম ধাপে ডাক্তার, নার্স, টেকলোজিস্ট, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাধারণের মধ্যে ৫৫ বছর বা তার উপরের বয়সের মানুষকে প্রথম ধাপে করোনার ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে।
করোনার ভ্যাকসিনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে জনসাধারণকে সবধরনের চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, করোনার ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেটা আছে, সেটি গুরুতর নয়। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। এ জন্য আমি মনে করি, জনগণকে প্রস্তুত থাকতে হবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মেনে নিয়ে ভ্যাকসিন নিতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, যে কোনও ওষুধের কিংবা ভ্যাকসিনের সাইড ইফেক্ট থাকতে পারে। আমরা একটি ওষুধ গ্রহণ করলেও সেটার গায়ে লেখা থাকে, কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। আবার নাও হতে পারে। বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনেও হয়েছে। আমরা ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে জনসাধারণকে সবধরনের চিকিৎসা সহায়তা দেবো।
জাহিদ মালেক বলেন, এ যাবত আমরা বাংলাদেশে যেসব ভ্যাকসিন দিয়ে থাকি সেখানেও কিন্তু সাইড ইফেক্ট আছে। কাজেই আমি মনে করি, এটাতে বড় কোনও সমস্যা হবে না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেন, আমরা ৪ ডলার করে সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন কিনছি। আর পরিবহনসহ সংরক্ষণে যে এক ডলার খরচ, সেটাও দেয়া হচ্ছে। আমাদের চুক্তি আছে যে, ভারত সরকার কম দামে কিনলে আমাদের কম দামে দেবে। বেশি দাম হলে আমরা সেই দামে নেবো না, আমরা কম দামেই নেবো। আমাদের কাছে যদি ২৫ থেকে ২৬ জানুয়ারি ভ্যাকসিন চলে আসে, তারপরও আমাদের প্রিপারেশনের জন্য টাইম দরকার। আশা করি, ভ্যাকসিন পাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে মানুষের মধ্যে দেয়া শুরু করতে পারবো।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, গ্লোব বায়োটেককে আমরা সাধুবাদ জানাই। তারা একটি ভ্যাকসিন ডেভেলপ করেছে। একটি ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তাদের সেগুলো অনুসরণ করে আসতে হবে। আমরা দেখবো, আমাদের দেশীয় প্রোডাক্ট যদি মানসম্পন্ন হয়, আমরা সবসময় সেটি গ্রহণ করে থাকি। আমাদের কাছে যখন যেটা সাহায্য চাইবে আমরা দেবো।
বেসরকারি পর্যায়ে ভ্যাকসিনের মূল্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, আমরা বেসরকারি পর্যায়ে ভ্যাকসিন আনার অনুমতি দেবো। একটি ভ্যাকসিনের দাম যেটা হবে, সেটি নির্ধারণ করার জন্য সরকারি প্রক্রিয়া আছে। সেই প্রক্রিয়া অনুযায়ী আমরা দামও নির্ধারণ করে দেবো। ভ্যাকসিনের যে নীতিমালা সেটিও করা হয়েছে, নীতিমালা ফাইনাল করে দেয়া হবে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী ভ্যাকসিন দেয়া হবে। সব ভ্যাকসিনের দাম এক হবে না। দেশ ভিন্নতায় ভ্যাকসিনের দাম ভিন্ন ভিন্ন হবে। কাজেই সেদিক লক্ষ্য রেখে এই দাম নির্ধারণ করে দেবো। যেভাবে আমরা টেস্টের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছি, সেভাবে ভ্যাকসিনের দামও নির্ধারণ করে দেয়া হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সেরামের পাশাপাশি ভারত সরকার আমাদের ২০ লাখ ভ্যাকসিন উপহার স্বরূপ দিবে। সেটি আগামী ২০ জানুয়ারি আসছের। এছাড়া কোভ্যক্সের মাধ্যমে ফাইজারের ভ্যাকসিনের প্রস্তাব পেয়েছি তার উত্তর আমরা ইতোমধ্যে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে ৮ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে। এই ভ্যাকসিন রাখার জন্য আমাদের কিছু ফ্রিজ আছে, ইউনিসেফের মাধ্যমে আরো কিছু ফ্রিজ আনা হবে। ফাইজারের ভ্যাকসিন মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্র প্রয়োজন হয় বলেও উল্লেখ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির পক্ষ থেকে সভাপতি মুরসালিন নোমানী এবং সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান খান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে সংগঠনের সদস্যদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির আহ্বান জানান। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়ে বলেন, প্রত্যেক সাংবাদিক করোনা ভ্যাকসিন পাবেন। সারা দেশের সাংবাবিদকরাও ভ্যাকসিন পাবেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ডিআরইউর সহ-সভাপতি ওসমান গনি বাবুল, যুগ্ম সম্পাদক আরাফাত দাড়িয়া, অর্থ সম্পাদক শাহ আলম নূর, সাংগঠনিক সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল, দফতর সম্পাদক মো: জাফর ইকবাল, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মাইদুর রহমান রুবেল, তথ্য প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক হালিম মোহাম্মদ, আপ্যায়ন সম্পাদক মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন, কল্যাণ সম্পাদক খালিদ সাইফুল্লাহ, কার্যনির্বাহী সদস্য এম এম জসিম, রহমান আজিজ, রুমানা জামান ও রফিক রাফিসহ সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে যাওয়ার পরিসংখ্যানে এমন আভাস দিচ্ছে। দেশে সফলভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে চিঠি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধের মতো ভ্যাকসিন দেয়ার কর্মসূচিতেও ভাল করার আশাবাদ জানিয়ে এ কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগীতা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সংস্থাটি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, করোনার শুরুতে আমাদের মাত্র একটি করোনা পরীক্ষার ল্যাব ছিলো। বর্তমানে ২০০টি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী লকডাউন থাকায় পিপিই সংকট ছিলো। বর্তমানে আমরা পিপিই রফতানি করছি। সকল কিছু অজানা থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে করোনা চিকিৎসা পদ্ধতি সাত ধাপে পরিবর্তন করা হয়েছে। শুরুতে আমাদের কিছু ঘাটতি থাকলেও অব্যবস্থাপনা ছিলো না। তবে বেসরকারিভাবে কিছু অনিয়ম হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
জাহিদ মালেক বলেন, যারা বিদেশ যাচ্ছেন আমরা তাদের করোনা টেস্টের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে কয়েক কোটি মানুষ সুবিধা নিয়েছে। এটি আমাদের একটি সফল কার্যক্রম। করোনার মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন থেমে নেই। দেশের পরীক্ষা স্থগিত থাকলেও মেডিকেল কলেজের সকল পরীক্ষা চলমান রয়েছে। চলতি বছরের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা এপ্রিলে আয়োজন করা হবে। বর্তমানে হাসপাতালে ৮০ শতাংশ সাধারণ বেড ও ৬০ শতাংশ আইসিইউ খালি রয়েছে। সারাদেশে ২ হাজার করোনা রোগী এবং ২০০ জন আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০২০’-এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, করোনাকালে রোগ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে স্বল্প সময়ে নিয়োগ পেয়েছেন ১১ হাজার ৬৫৪ জন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী। আরও ২ হাজার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, কোভিড মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে স্বল্প সময়ে নিয়োগ পেয়েছেন ১১ হাজার ৬৫৪ জন। এর মধ্যে ২ হাজার চিকিৎসক এবং ৪ হাজার নার্স।
এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় নেয়া হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ জন। এর মধ্যে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টসহ আয়া, ওয়ার্ড বয় ও পরিচ্ছন্ন-কর্মী রয়েছেন।
অন্যদিকে নবসৃষ্ট মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদে ১ হাজার ২০০ জন, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ১ হাজার ৬৫০ জন এবং কার্ডিওগ্রাফার পদে ১৫০ জনসহ মোট ৩ হাজার জনবল নিয়োজিত হয়েছে স্বাস্থ্যখাতে। এতে আরও জানানো হয়, বর্তমানে আরও ২ হাজার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
জুনাইদ আহমেদ পলক তার বক্তব্যে বলেন, সুরক্ষা নামে একটি অ্যাপস আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই চালু করতে পারব। এ অ্যাপসের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের নিবন্ধন থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন নেয়া মানুষের সব তথ্য সংরক্ষিত থাকবে।
তিনি বলেন, ডিজিটাল সুবিধার কারণে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সব কার্যক্রম চলমান রয়েছে। অনলাইনের মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই সফটওয়্যারটি আগামী দুই দিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। আগামী ২৫শে জানুয়ারীর মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এটা দেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন