শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মহিলা

আসুন বাবা মার হৃদয়ের সব উষ্ণতা দিয়ে সন্তানদের ধরে রাখি

প্রকাশের সময় : ৩০ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

খন্দকার মর্জিনা সাঈদ

গেল ক’বছর ধরে পত্রিকার পাতায় পাতায় আত্মহত্যা, অপমৃত্যু, ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে রাগ-দুঃখ অভিমানে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা প্রতিনিয়তই চোখে পড়ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায়স্বরূপ রাষ্ট্রীয় সামাজিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক সচেতনতা পদক্ষেপসহ নানামুখী আইন পাস হলেও প্রকৃত অর্থে আমরা কোনো সুফল পাচ্ছি না। হচ্ছে না স্থায়ীভাবে সমস্যা সমাধান। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম ও সর্বশেষ আশ্রয় নির্ভরতার স্থান মায়েদের কাছেই। তাই বার বার ফিরে আসতে হচ্ছে। ভেবে নিয়ে আমি, আপনি, আমরা এই সকল সর্বস্তরের মায়েরা কি পারি না হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা ভালোবাসা দিয়ে আমাদের সন্তানদের ধরে রাখতে? ওদের একটি নতুন জীবন উপহার দিতে!
এ বিষয়টি নিয়েই কথা হয়েছিল বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত অনেক মায়ের সঙ্গে। এদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ-কালীন অধ্যাপিকা মারুফা রহমান বলেন, আমার বিশ্বাস, পৃথিবীতে এমন কোনো মা নেই যে তার সন্তানকে ভালোবাসেন না। হয়তো পরিস্থিতি প্রেক্ষাপটের কারণে অনেক মা তাদের সন্তানদের প্রতি যথার্থ ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন না। বাধ্য হন বিচ্ছেদ সৃষ্টি করতে। আর এ অনিচ্ছাকৃত বিচ্ছেদ চোখের আড়াল হলেই যে মা সন্তানদের ভালোবাসেন না এমন নয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্তানরা মায়েদের ভুল বোঝে। মায়ের শাসন-বারণ, চোখের আড়াল হওয়াকে অবহেলা মনে করে। নাড়ির এ অচ্ছেদ্য বন্ধনের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলে। ভাবে মা তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন। নেই তাদের পায়ের নিচে আস্থাশীল কোনো ভিত। বিপদ-আপদে আশ্রয়নির্ভরতা। আর এসব ভাবনা দীর্ঘদিন ধরে আপন মনে ধারণ করার ফলশ্রুতিতেই সামান্য প্রতিকূলতাকে উপলক্ষ করেই ঘটে যায় আত্মহত্যা অপমৃত্যুর মতো অগণিত ঘটনা। যা রুখতে মায়েদেরই প্রধানত নিতে হয়-হবে অগ্রণী ভূমিকা। সন্তানদের প্রতি যত্মশীল আন্তরিক ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা মানসিক স্বাধীনতা যাতে সঠিকভাবে বিকশিত হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এদের মতামতের প্রাধান্য ও সূক্ষ্ম ভালোলাগার প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে। তাহলেই বোধ করি ভালোবাসা আশ্বাসনির্ভরতার পূর্ণতার সমন্বয় সন্তানদের এ বিপথগামী পথ থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলেও জানান এ অধ্যাপিকা।
গৃহিণী চার সন্তানের মা পারভীন সুলতানা এ বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন, আমি একজন মা। একজন গর্ভধারিণীর অভিজ্ঞতার আলোকেই বলছি, আমার প্রতিটি সন্তান যে সমান মেধাবী বা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত তা নয়। আর এ বিষয়টিকেই আমি স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। বুঝে নিয়ে হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেখানে সমান নয়, সে ক্ষেত্রে সংসারের সব সন্তান স্বভাব চরিত্রে, মেধা মননে, সৌন্দর্য কার্যক্ষমতায় এক হবে তা কিন্তু নয়। সেই বিবেচনায় আমার কোনো একটি সন্তান যখন পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ে, যথার্থ মেধা বিকাশের পরিচয় দিতে পারে না, কিংবা তার চারিত্রিক দোষত্রুটি ধরা পরে, অসৎ সঙ্গে ভুল পথে পরিচালিত হয়, ঠিক তখনও আমি হাল ছাড়ি না। দৃঢ়তার সাথে তার পাশে দাঁড়াই। মানসিক শারীরিক পরিচর্যায় যতœশীল হই। তাকে আচার-আচরণে বুঝিয়ে দেই পৃথিবীর কোনো একজন তার পাশে না থাকলেও আমি মা, গর্ভধারিণী সব ন্যায়-অন্যায়, ভুলত্রুটিকে পাশ কাটিয়ে তার পাশে দাঁড়াব। হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা দিয়ে ভালোবাসব। সেক্ষেত্রে কোনো ন্যূনতম স্বার্থ লেন-দেনের বিষয়টি কাজ করবে না। শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসা থাকবে। থাকবে সম্পর্ক বজায়। আমার বিশ্বাস এ আস্থাশীল নির্ভরতাই মায়ের হৃদয়ের উষ্ণতা সন্তানদের বিপথগামী পথ থেকে সরিয়ে আনবে। দেবে নতুন ভালোবাসার ভুবনের সন্ধান বলেও জানান মা পারভীন সুলতানা। কথা হয়েছিল দিনমজুর মা পপি বেগমের সঙ্গে। যখন কথা বলছিলাম ঠিক সে মুহূর্তেও তার দুই সন্তান আঁখি-সখি ফুটপাতে ফুল বিক্রি করছিল। আর মা পপি বেগম ফুটপাতেরই এক কোণে বসে আপন মনে কাঁঠালচাপা ফুলের মালা গাঁথছিলেন। মা-সন্তানদের সম্পর্ক সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “সব বাপ-মাই তাগো সন্তানগো ভালোবাসে। আমিও বাসি। তয় টাকা-পয়সা নাই বইলা ভালো খাওন, জামা, থাকবার ঘর না দিতে পারলেও ওরা বোঝে ওগো মাই ওগো সব। আশ্রয় আপন। হে কারণেই সারা দিন ফুল বেছলেও খাটুনির কাম করলেও আমার মুখের দিক চাইলেই ওরা সব ভুইলা যায়। আদর কইরা দিন শেষে লবণ-মরিচ দিয়া পানি ভাত খাইতে দিলেও তাও তৃপ্তি সহকারে খায়। কোনো রকমের রাগ করে না। জেদ দেহায় না। জেদ দেহায় তখন, আমি ওগোরে যহন ভুল বুঝি। অকারণে বকাঝকা দেই। আর হে কারণে হাজারো কান কথা শুনলে ওগো নামে বস্তির মানুষ মিথ্যা বদনাম রটাইলেও নিত্য অভাব দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও ওগোরে কিছু কই না। ফুটপাত-বস্তি যেহানে যে অবস্থায় থাহি না কেন মুরগির নাহান ভালোবাসা আদরের পাখনার নিচে ওগোরে বাইন্দা রাখার চেষ্টা করি। ভাইবা, আমি তো মা, আমি ছাড়া ওগোর কে-ও বা আছে! কি ও বা আছে!”
এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলছিলাম একজন কর্মজীবী নারী সেবিকা সর্বোপরি মা রওশন আরা শিল্পীর সঙ্গে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, আমরা কর্মজীবী মা। সেই সাতসকালে বাড়ি থেকে বের হই, ফিরতে কখনো কখনো রাতও হয়ে যায়। এই এতটা সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হয় বলে সন্তানদের কাছে থেকে সব সময় এদেরকে পাহারা দেওয়া বা সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। তবু মুঠোফোন থাকায় প্রতিমুহূর্তেই চেষ্টা করি এদের মুহূর্তে মুহূর্তে খোঁজখবর নেয়ার। যে কোনো সমস্যাকে গুরুত্ব সহকারে নেয়ার। নিন্দনীয় বিষয়ে বা ভুলত্রুটিগুলোকে ধৈর্য সহকারে মিটিয়ে ফেলতে। যাতে সন্তানরা তাদের সমস্যাগুলোকে একান্তই নিজের সমস্যা ভাবে না। পায় সত্যিকারের নির্ভরতা এবং যে কথাটি বলতেই হচ্ছে, তা হলোÑ বিপথগামী সন্তানদের সঠিকপথে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্বও অনেকাংশে মায়েদেরই। সে ক্ষেত্রেও হতে হবে ধৈর্যশীল। তাই আসুন, একজন সমাজসেবী হিসেবে নয়, মা হিসেবে সবার প্রতি অনুরোধÑ আমরা আমাদের সন্তানদের ভালোলাগা মন্দলাগার প্রতি আন্তরিক হই এবং এদের যথার্থ মানসিকতা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা নিতে পারি। শুধু পাশাপাশি অবস্থা করেই নয়, প্রকৃত অর্থে পাশে থাকার চেষ্টা করে। বুঝে নিই এদের প্রকৃত মঙ্গল, প্রকৃত চাওয়া-পাওয়া, একান্ত সুখ-দুঃখ। অতিরিক্ত অবাঞ্ছিত বিষয়গুলোও জানান এই সমাজ সেবিক মা রওশন আরা শিল্পী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন