প্রায় ছয় দশক আগে ১৯৬২ সালে যখন মিয়ানমার বা তৎকালীন বার্মায় সামরিক বাহিনী প্রথম অভ্যুত্থান করে, তখন দেশটির ১৬শ’ কিলোমিটার সীমান্তের সাথে থাকা ভারত আন্তঃসীমান্ত বিদ্রোহ এবং চীনের প্রভাব ঠেকানোর জন্য এবং নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও জেনারেল নে উইনের সাথে মিত্রতার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী দশকগুলোতে বেইজিং দক্ষিণ-পূর্ব এ এশীয় দেশটির ট্রাম্প কার্ড ধরে রাখা সত্তে¡ও ভারত রাজনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক, সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করে তোলে।
২০১২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩৩টি ভারতীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মিয়ানমারে ভারতের অনুমোদিত বিনিয়োগের পরিমাণ চীনের সাথে পাল্লা দিয়ে ৭৭১ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ২০২০ সালের অক্টোবরে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিঙলা এবং সেনা প্রধান জেনারেল এম এম নারাভানের সফরগুলো বেশ সমাদৃত হয়েছিল। সফরকারীরা দিল্লির এলএসআর কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সু চি’র হাতে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ওষুধের চালান হস্তান্তর করেন।
২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারত মিয়ানমার থেকে ১৫ লাখ টন ডাল আমদানির পাশাপাশি, মিজোরাম ও মিয়ানমারের মধ্যে অর্থনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য একটি সেতু নির্মাণের জন্য ২ মিলিয়ন ডলার এবং ইয়াঙ্গুনের কাছে ৬ বিলিয়ন ডলারের পেট্রোলিয়াম শোধনাগার নির্মাণের প্রস্তাবেরও ঘোষণা করে।
জানা গেছে, গত ২২ জানুয়ারি ভারতের তৈরি করোনাভ্যাকসিন কোভিশিল্ডের ১৫ লাখ ডোজ ইয়াঙ্গুনে পৌঁছে। এর আগে, ২০১৯ সালের জুলাইতে দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সামরিক চুক্তির শর্তাবলী এবং কৌশলগত সহযোগিতার অধীনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রথমে তাদের দেশ থেকে নাগা বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে দেয়। ভারত প্রত্যুত্তরে চীন সমর্থিত বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে লড়াইয়ে জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০২০ সালের নভেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত সপ্তাহে নতুন সংসদ অধিবেশন হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে আরো একটি অভ্যুত্থান করে। দেশটির নেতৃত্বে থাকা কাউন্সিলর অং সান সু চি’সহ বহু বেসামরিক প্রভাবশালী নেতাকে আটক করে তারা এবং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
অভ্যুত্থানের কারণগুলো সম্পূর্ণভাবে অনুমানযোগ্য। মিয়ামারের নির্বাচনে সু চি’র ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লিগ অফ ডেমোক্রেসি’র (এনএলডি) ঢালাও জয়। সেনাবাহিনী তাকে সত্যিকার অর্থে কখনই বিশ্বাস করেনি। তারা আশঙ্কা করেছিল যে, নির্বাচনে জয়লাভ করার পর সু চি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ নেবেন। মিয়ানমারের সংবিধানে সেনাবাহিনীর জন্য সংসদে ২৫ শতাংশ আসন রয়েছে। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল প্রতিরক্ষা, সীমান্ত অঞ্চল এবং স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রীর পদে থাকবেন এবং এইভাবে দেশটির নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবেন।
মিয়ানমার শি’র উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বেইজিং চীনের দক্ষিণ ইউনান প্রদেশকে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের সাথে এবং তারপর আরো দক্ষিণের ইয়াঙ্গুন এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের কিউকপিউর সাথে সংযুক্ত করার মতো কৌশলগত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দিকে জোর দিচ্ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মিয়ানমার সফরের সময় উভয় পক্ষই রাখাইন রাজ্যের গভীর পানি-বন্দর এবং ইয়াঙ্গুনে একটি নতুন শহর প্রকল্প, কিউকপিউ স্পেশাল ইকোনমিক জোনসহ ৩৩ টি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
চীন মিয়ানমারের বৃহত্তম বিনিয়োগকারী এবং ঋণদানকারী। দেশটি বিআরআই’র চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের আওতায় মিয়ানমারকে ৩৮টি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। মিয়ানমারে চীনের শক্তিশালী কৌশলগত শক্তি রয়েছে। মিয়ানমারের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে দেশটির সাথে কাজ করার সক্ষমতা চীনের রয়েছে।
তবে, সু চি’র আমলে মিয়ানমার বিভিন্ন দফায় আলোচনার পরেও তার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। এদের মধ্যে অনেকগুলো চীনের সাথে উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থান করছে। খুব সম্ভবত ভারতের সাথে সু চি সরকারের ক্রমবর্ধমান সখ্য এবং চীন সীমান্তে মিয়ানমারের এই বড় আকারের ব্যর্থতার কারণেই চীনকে মিয়ানমারের রাশ টানতে হয়েছে।
সামরিক বাহিনীসহ অভিজাতদের মধ্যে কিছুটা বিরক্তি থাকা সত্তে¡ও মিয়ানমারের চীনের সর্বাত্মক প্রভাব রয়েছে। মিয়ানমারের প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিবেক কাটজু বলেন, ‘এখন যদি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আবারও একটি আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে করা হয়, তাহলে তাদের চীনের আলিঙ্গনে যাওয়ার বিকল্প নেই।’ এরকম দৃশ্যপটে ভারত মিয়ামারে তার বিনিয়োগ এবং সীমান্ত রক্ষায় কী পদক্ষেপ নেবে, এটাই এখন দেখার বিষয়। সূত্র : মানিকন্ট্রোল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন