শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

হিজড়া-৬ : সম্পত্তির উত্তরাধিকার

মুফতী মোঃ আবদুল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:৪১ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ইতোপূর্বে ইমামগণের বরাতে যে-গবেষণাপ্রসূত অভিমত (দু’অবস্থার সমষ্টির অর্ধেক? না কি ছোট অংশ?) বা সিদ্ধান্তের কথা আলোচিত হয়েছে; তা একান্তই সাবালক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ‘সাময়িক’ বা ‘ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি’ হতে উত্তরণের প্রয়োজনে ‘সতর্কতা অবলম্বন’ নীতির আলোকে একটা ব্যবস্থাপত্র মাত্র; তা অন্যান্যদের অনুরূপ স্থায়ী বিধান বা সমাধান নয়।

৪। ইতোপূর্বে ‘বাহরুর রায়িক’ ইত্যাদি সূত্রে আলোচিত বিষয়টি অর্থাৎ ‘হিজড়া’দের প্রাপ্য অংশ ঘিরে ব্যাপক যে-আলোচনা বা অভিমতের প্রসঙ্গ বিভিন্ন কিতাবে বিদ্যমান তা কেবল জটিল হিজড়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; অন্য দু’প্রকার হিজড়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। যে-কারণে এ বিজ্ঞ গ্রন্থকার অর্থাৎ ‘আল-ফিকহুল হানাফী ফী ছাওবিহিল-জাদীদ’ গ্রন্থকার অপরাপর সব বক্তব্য এড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ সাবালক হওয়ার পর যেহেতু একজন হিজড়া সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই অহিজড়া নারী বা পুরুষের কাতারে ঢুকে পড়ছেন; তাই সাধারণ রীতিতেই একজন অহিজড়া নারী বা পুরুষের অনুরূপ তারাও নিজ নিজ অংশ সমান্তরালে পেয়ে যাবেন। সুতরাং এদের নিয়ে আলোচনার কলেবর না বাড়িয়ে গ্রন্থকার আল্লামা মাহমূদ তুহমান চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসহ কেবল জটিল হিজড়াদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে শেষ করেছেন।

মোটকথা, হিজড়া মানেই তাদের উত্তরাধিকার প্রশ্নে সংশয়-ঝামেলা আছে বা হিজড়া মানেই তারা কম বা ছোট অংশটি পাবে; অথবা হিজড়া মানেই তাদের সম্পত্তির প্রয়োজন নেই -এসব কথা বলা’র অধিকার কারও থাকতে পারে না।

হিজড়া-৭: নির্মম ও নির্দয় আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন

নির্মম ও নির্দয় আচরণ:
৩। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বর্তমানকার সর্বাধিক বাস্তব তথ্য-উপাত্ত, সত্য ছড়িয়ে পড়ার গণ-মাধ্যম ‘ইউটিওব’ এর বিভিন্ন চ্যানেল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অধম যেটুকু বুঝতে পেরেছি; তাতে দেখা যায়, ধনী-দরিদ্র ও সুখী-সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যেও মুক-বধির, আতুর-বিকলাঙ্গ ইত্যাদি প্রতিবন্দীর অনুরূপ বিভিন্ন পরিবারে হিজড়াদের অস্তিত্ব রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, এসব প্রতিবন্দীদের তো আমরা আমাদের পরিবার ও সমাজ-স্বজন থেকে দূরে ঠেলে দেই না? ভবঘুরে বা নিরুদ্দেশের পথে অঘোষিতভাবে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করি না? তা হলে হিজড়াদের আমরা পরিবার থেকে কেন দূরে ঠেলে দেই? তাদেরকেও এক প্রকার প্রতিবন্দী জ্ঞান করে আমরা নিজেদের পরিবার-সংসারে আপন করে রাখতে পারবো না কেন? এ হিজড়া জনগোষ্ঠি তো অপরাপর প্রতিবন্দীদের তুলনায় অনেক সচল, সবল ও সক্ষম! এরা তো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর বোঝা না হয়ে বরং সমাজ-সংসারের অনেক কাজ, সেবা ও শ্রমদানে মৌলিক বিবেচনায় সক্ষমতা রাখে!

অধম গবেষক বেশ কয়েকজন হিজড়া’র জবানবন্দি শুনে, বিশেষত সুন্দরী হিজড়া গোপালগঞ্জের ‘রূহানী’ যে তার নানীর সঙ্গে ৬মাস ভারতে থেকে এসে বর্তমানে সায়দাবাদে অবস্থান করছে; হিজড়া ‘আলেয়া নূর’ যে ইতোপূর্বে নারায়ণগঞ্জে ছিল এবং বর্তমানে সে ঢাকা’র গুলশান এলাকায় কারও আশ্রয়ে রয়েছে; এ ছাড়াও হিজড়া দীপাসহ এমন আরও অনেকেই রয়েছে -যারা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে স্পষ্টভাবে বলছে, “সমাজ-সংসারের আমাদের প্রতি যে অনীহাভাব, আমরা মনে হয় যেমন কিনা অস্পৃশ^ একটা জাতি বা জীব; এমনকি খোদ আমাদের পরিবার-পরিজনেরও এমন একটা ভাব-ভঙ্গি যে, আমরা বেরিয়ে গেলে বা অন্য কোথাও চলে গেলেই যেন পরিবার ও জ্ঞাতি-গোষ্ঠির লোকজন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। তার কারণ, আমি একটি ভাই বা একটা বোন হিজড়া হওয়াতে অন্য ভাই-বোনদের বিয়ে-শাদীর সমস্যা হয়ে যায়! লোকজন তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে চায় না! আমরা হিজড়াদের কারণে খোদ আমাদের পরিবার-পরিজনেরই সমস্যা হয়ে যায়। যে কারণে নিজ স্বজন ও পরিবারের অন্যদের উক্তরূপ বিড়ম্বনার কথা শুনে ও দেখে, আমরা নিজে থেকেই আপন ঘর-ছাড়া হয়ে যাই। আবার ভাই-বেরাদর আপনজনও অনেকক্ষেত্রে মুখে না বললেও, তাদের আচরণ, হাব-ভাব, অবস্থা-পরিস্থিতির ভাষায় যেন বলে দিচ্ছেন, ‘তোমরা একদিকে বা কোথাও চলে যাও! তা হলে আমরা বাঁচি’!”

কেবলই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ব্যাপার:
সম্মানীত পাঠক! যেসব পরিবারে জন্মগত বা রোগ-ব্যাধি, দূর্ঘটনা ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট কোন খোঁড়া-আতুর, মুক-বধির ইত্যাদি প্রতিবন্দী সদস্য থাকে সেসব পরিবারের অপরাপর ছেলে-মেয়েদের কি বিবাহ-শাদী অনুষ্ঠিত হয় না? তা হলে একজন হিজড়া সদস্য ওই পরিবারে বিদ্যমান থাকলে অন্য অহিজড়া সদস্য বা ভাই-বোনের বিয়ে-শাদী প্রশ্নে সমস্যা হবে কেন? তার কী যুক্তি বা বাস্তব ও বিজ্ঞানসম্মত কী সমস্যা আছে? কোন সমস্যা নেই। কেবল আমাদের মানসিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। অধমের জানা মতে ইমলামী শরীয়তে এমন নূন্যতম কোন ইঙ্গিত, বিধান, বর্ণনা অবর্তমান যে, হিজড়াদের সঙ্গে বিবাহ-শাদী করা যাবে না বা দেয়া যাবে না বা তাদের পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করা যাবে না; কিংবা তাদেরকে পরিবার ও সমাজ-সংসারে আপন করে রাখলে কোন সমস্যা আছে; কিংবা এদের বেলায় কোন কুলক্ষণ বা সুলক্ষণ আছে বা থাকতে পারে! কিছুই নেই। বরং তাদেরকে আপন করে রাখার, অহিজড়াদের অনুরূপ তাদেরও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করার, প্রয়োজনীয় দীন-ঈমান-আমল তাদেরকেও শেখানো এবং তাতে অভ্যস্থ করে গড়ে তোলার কথা, তাদের নামায-রোযা, বিবাহ-শাদী, কাফন-দাফন-জানাযা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদি সব বিষয়ই সবিস্তারে শরীয়া আইনে বিবৃত হয়েছে।
লেখক : মুফতী : ইসলামী ফাউন্ডেশন, বায়তুল মোকাররম, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন