সাম্য চেতনার মধ্য দিয়েই মূলত ফুটে উঠেছে নজরুলের জাতিতে-জাতিতে মিলন-সেতু নির্মাণের স্পৃহা। পরিণতিতে নজরুল হয়ে উঠেছেন বিশ্বমানুষের কবি। সত্যি বলতে কী, বাংলার প্রকৃত বিশ্বকবিই হলেন নজরুল। নজরুলের এ বৈশ্বিক রূপটি তাজমহলের মতো মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর বিস্ময়কর কাব্যগ্রন্থ সাম্যবাদী-তে। মাত্র এগারোটি কবিতার ছোট্ট এ গ্রন্থটি পারমাণবিক বোমার মতো শক্তিশালী। সাম্যবাদের এমন জোরালো স্লোগান আর কোনো কবির কণ্ঠে এর আগে উচ্চারিত হতে পৃথিবী কখনও শোনেনি। পৃথিবীর সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব গোত্র ও শ্রেণির মানুষকে এক মনুষ্যত্বের বন্ধনে বেঁধে তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছেন এক সাম্যবাদী সমাজ, যেখানে মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাই ‘সাম্যবাদী’; কবিতাটি শুরু হয়েছে এক বৈপ্লবিক উচ্চারণ দিয়ে:
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
কবিতাটি শেষও হয়েছে এক অবিনশ্বর বাণী দিয়ে:
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।
নজরুল কিন্তু নিরীশ্বরবাদী ছিলেন না কখনও। সকল ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ছিলো সমান। ‘ঈশ্বর’ কবিতায় কবি মানুষকে বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে, আকাশে-পাতালে ঈশ্বর না খুঁজে মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। কবি বলেন:
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি!
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।
সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতা ‘মানুষ’ ও ‘নারী’। এ কবিতা দুটি পাঠ না করলে নজরুলকে যেমন পুরোপুরি চেনা যায় না তেমনি আধুনিক সভ্যতার মূল স্পিরিট সম্বন্ধেও অজ্ঞতা থেকেই যায়। এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ ইংরেজিতে রচিত বলেই বিশ্বের প্রায় সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য; নজরুলের এ দুটি কবিতাও অনুরূপ অবশ্য-পাঠ্য হওয়ার দাবি রাখে; দুর্ভাগ্য যে, এগুলো আধুনিক সভ্যতার আলো থেকে অনেক দূরে, পরাধীন ভারতবর্ষের এক প্রান্তে, বঙ্গদেশে, বাংলায় রচিত হয়েছিল!
‘মানুষ’ কবিতায় কবি ধর্মের বিরোধিতা না করে ধর্মব্যবসায়ী ও কপট ধার্মিকদের মুখোশ খুলে দিয়ে জয়গান গেয়েছেন মানুষের। কবি বলেন:
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নজরুল যখন জনৈক ক্ষুধার্ত মানুষের মসজিদ ও মন্দির হতে বিতাড়িত হওয়ার করুণ কাহিনী বর্ণনা করার পর এভাবে বলেন:
তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!
কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ওই ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
তখন আমরা মর্ম-বেদনায় জ্বলি, সহমর্মিতায় ও মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একাত্মতা ঘোষণা করি তাঁর সাথে, মনে হয় আমরাও চেঙ্গিস খানের মতো মুহূর্তে ভেঙে চুরমার করে দেই যত অনিয়ম-অবিচার, সমান করে দেই সভ্যতার যত উঁচু-নিচু, বিভেদ ও বৈষম্য।
নজরুল যথার্থই বুঝেছিলেন, দেশ মানে সব ধর্ম, সব বর্ণ ও সব গোত্রের সমাহার; এদের কাউকে উপেক্ষা করে কোনো দেশ বা জাতি অগ্রগামী হতে পারে না। ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার’ কবিতায় কবি তাই দরদ ভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন:
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ।
“হিন্দু, না ওরা মুসলিম?” ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কান্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
নজরুল কেন আমাদের জাতীয় কবি, এ উচ্চারণের মধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমগ্র জাতির মর্ম-বেদনা ও আশা-আকাক্সক্ষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর অসংখ্য গানে ও কবিতায়। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় কবি দেশমাতৃকার মুক্তি-কামনায় এত বেশি উদ্বেলিত হয়ে পড়েছেন যে, তাঁর কাছে তথাকথিত কাব্যশৈলীর চেয়ে মানুষের মুক্তিই বড় হয়ে ওঠে। তিনি বলেন:
বন্ধু গো আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে।
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও , বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
প্রার্থনা করো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।
পৃথিবীর দেশে দেশে নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উন্মাদনা। মানুষ এসবের শিকার হচ্ছে। নজরুল তাই এখন প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। নজরুল চর্চা আবারও অনিবার্য হয়ে উঠেছে বিশ্ববাসীর জন্যে।
লেখক: অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন