শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহান একুশে সংখ্যা

বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০২ এএম

বাংলা ভাষা সাহিত্যের উন্নয়ন ও বিকাশে মুসলমান শাসক ও সাহিত্যসেবীদের অবিস্মরণীয় অবদান ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রকৃত পক্ষে তাদের হাতেই বাংলা ভাষার মুক্তি ঘটে এবং সাহিত্যের বিকাশ তরান্বিত হয়। সুবিখ্যাত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’-এর লেখক শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন একথাই অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন তার ‘বঙ্গ-ভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব’ শীর্ষক লেখায়। লেখাটি দীর্ঘ। আমরা তার কিছু অংশ এখানে ছাপা হলো।

মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল। এই ভাষাকে এ্যান্ডারসন, স্ক্রাইন, কেরী প্রভৃতি সাহেবেরা। অতি উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করিয়াছেন। কেরী বলিয়াছেন, “এই ভাষার শব্দসম্পদ ও কথার গাঁথুনি এরূপ অপূর্ব যে, ইহা জগতের সর্বপ্রধান ভাষাগুলির পার্শ্বে দাঁড়াইতে পারে।” যখন কেরী এই মন্তব্য প্রকাশ করেন, তখন বঙ্গীয় গদ্য সাহিত্যের অপোগন্ডত্ব ঘোচে নাই: সে আজ ১২৫ বৎসর হইল। ইউরোপীয় পন্ডিতেরা বলিয়াছেন এমন কোন ভাব নাই, যাহা অতি সহজে, অতি সুন্দর ভঙ্গিতে বাঙ্গলা ভাষায় প্রকাশ না করা যায় এবং এই গুণেই ইহা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির সমকক্ষ। ক্রাইন বলিয়াছেন, “ইটালী ভাষার কোমলতা এবং জার্মান ভাষার অদ্ভুত ভাব প্রকাশ করিবার শক্তি এই মধুরাক্ষরা এবং স্বছন্দগতি বাঙ্গলা ভাষায় দৃষ্ট হয়।”

এই সকল অপূর্ব গুণ লইয়া বাঙ্গলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। পন্ডিতেরা নস্যাধার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং “তৈলাধার পাত্র” কিম্বা পাত্রাধার তৈল” এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্ত ছিলেন। তাঁহারা হর্ষচরিত হইতে ‘হারং দেহি মে হরিণি› প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিষ্কার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিলেন এবং কাদম্বরী, দশকুমারচরিত প্রভৃতি পদ্য-রসাত্মক গদ্যের অপূর্ব সমাসবদ্ধ পদের গৌরবে আত্মহারা হইতেছিলেন। রাজসভায় নর্তকী ও মন্দিরে দেবদাসীরা তখন হস্তের অদ্ভুত ভঙ্গী করিয়া এবং কঙ্কণ ঝঙ্কারে অলি গুঞ্জনের ভ্রম জন্মাইয়া প্রিয়ে, মূঞ্চময়ি মানমনিদানং” কিম্বা “মুখর মধীরম, ত্যজ মঞ্জীর” প্রভৃতি জয়দেবের গান গাহিয়া শ্রোতৃবর্গকে মুগ্ধ করিতেছিল। সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পন্ডিতমন্ডলী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল-তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।

হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভূমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভূমি হইল। তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুরমত এদেশবাসী হইয়া পড়িলেন। হিন্দুর নিকট বাঙ্গলা ভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল।

বঙ্গভাষা অবশ্য বহু পূর্ব হইতে এদেশে প্রচলিত ছিল, বুদ্ধদেবের সময়ও ইহা ছিল, আমরা ললিত বিস্তরে তাহার প্রমাণ পাইতেছি। কিন্তু বঙ্গ-সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। তাহা আমরা পরে দেখাইব।

চারিদিকে হিন্দু প্রজা, চারিদিকে শঙ্খ ঘণ্টার রোল, আরতির পঞ্চপ্রদীপ, ধূপ ধূনা, অগুরুর ধোঁয়া-চারিদিকে রামায়ণ মহাভারতের কথা, এবং ঐ সকল বিষয়ক গান। প্রজাবৎসল মুসলমান সম্রাট স্বভাবতই জানিতে চাহিলেন, “এগুলি কি?” পন্ডিত ডাকিলেন, -তিনি তিলক পরিয়া, শিলা দোলাইয়া, নামাবলী গায়ে দিয়া হুজুরে হাজির হইয়া বলিলেন, “এগুলি কি জানিতে চাহিলে আমাদের ধর্মশাস্ত্র জানা চাই। দ্বাদশ বর্ষাকাল ব্যাকরণ পাঠ করিয়া ইহার মধ্যে প্রবেশাধিকার হইতে পারে।” এই ঝুনো নারিকেল না ভাঙ্গিয়া ভিতরের শাঁস খাইবার উপায় নাই। বাদশা ক্রুদ্ধ হইলেন, আমি ব্যাকরণ বুঝি না, রাজ-কাজ ফেলিয়া আমি ব্যাকরণ শিখিতে যাইব, তাহাও বামুন আমাকে পড়াইবে না,-ও সকল হইবে না। দেশী ভাষায় এই রামায়ণ-মহাভারত রচনা কর।” গৌড়েশ্বর দেশী ভাষা শিখিয়াছিলেন, না হইলে প্রজা শাসন করিবেন কীরূপে? তিনি পুরোদস্তুর বাঙ্গালী সাজিয়াছিলেন-সে কথা পূর্বেই লিখিয়াছি। দেশী ভাষায় ধর্মগ্রন্থ রচনা করিতে হইবে, এই আদেশ শুনিয়া পন্ডিতের মুখ শুকাইয়া গেল, ইতরের ভাষায় পবিত্র দেব-ভাষা রচনা করিতে হইবে, চন্ডালকে ব্রাহ্মণের সঙ্গে এক পংক্তিতে স্থান দিতে হইবে! কিন্তু শত শত কল্লুক ভট্ট, রঘুনন্দন, শত শত স্মৃতি লিখিয়া শত শত বছরে যাহা না করিতে পারেন, শাহানশাহ্ বাদশাহের একদিনের হুকুমে তাহা হয়-রাজশক্তি এমনই অনিবার্য। অগত্যা প্রাণের দায়ে ব্রাহ্মণকে তাহাই করিতে হইল। পরাগলী মহাভারতে উল্লিখিত আছে, “শ্রীযুত নায়ক সে যে নসরত খান, রচাইল পাঞ্চালী সে গুণের নিধান।” এতদ্বারা প্রমাণিত হইতেছে, হুসেন শাহের পুত্র নসরত শাহ মহাভারতের বঙ্গানুবাদ করাইয়াছিলেন। পাঞ্চালী (পাঁচালী) অর্থ মহাভারত। নসরতের আদেশে রচিত মহাভারতের উল্লেখ আমরা পাইয়াছি, কিন্তু পুস্তকখানি এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। এই গ্রন্থ অনুমান ১৪১৮ খৃষ্টাব্দে রচিত হইয়াছিল। তখনও নসরত সম্রাট হন নাই-তাঁহাকে শুধু ‘নায়ক’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ চট্টগ্রাম বিজয়ের জন্য পূর্বাঞ্চলে প্রেরিত হন, তাঁহার বংশধরগণ ফেনী নদীর তীরস্থ পরাগলপুরে (নোয়াখালী জেলায়) এখনও বাস করিতেছেন, এখনও তাঁহারা তথাকার ভূম্যাধিকারী। এক সময়ে পরাগল খা ও তৎপুত্র ছুটি খাঁর প্রতাপ এই প্রদেশে পরিব্যাপ্ত ছিল, ছুটি খাঁর সম্বন্ধে কবি শ্রী করণ নন্দী লিখিয়াছেন, “ত্রিপুরা নৃপতি যার ভয়ে এড়ে দেশ/পর্বত গহবরে গিয়া করিল প্রবেশ।” তখন ত্রিপুরার রাজা ছিলেন মহারাজ ধর্মমাণিক্য। তাঁহার মত এত বড় পরাক্রমশালী রাজা ত্রিপুরার ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। তাঁহার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চাণক্যতুল্য রাজনীতি-বিশারদ রায়চান। এহেন সম্রাটও ছুটি খাঁর ভয়ে উদয়পুরের পার্বত্য দুর্গের নিভৃত কোণে আশ্রয় লইয়াছিলেন বলিয়া শ্রীকরণ নন্দী আমাদিগকে জানাইয়াছেন। হুসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ কবীন্দ্র পরমেশ্বর নামক জনৈক সুপন্ডিত কবিকে মহাভারতের অনুবাদ রচনা করিতে নিযুক্ত করেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর বহু স্থানে পরাগল খাঁর প্রশংসা করিয়াছেন, ‹শ্রীযুক্ত পরাগল খান পদ্মিনী ভাস্কর তিনি। রস বােদ্ধা’, ‘গুণগ্রাহী’ ইত্যাদি বিশেষণ তাঁর প্রতি সর্বদা প্রযুক্ত হইয়াছে। কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রী করণ নন্দী উভয়েই মহাভারত অনুবাদের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিয়াছেন। কবীন্দ্র লিখিয়াছেন, “নৃপতি হুসেন শাহ গৌড়ের ঈশ্বর/তান হক সেনাপতি হওন্ত লস্কর।। লস্কর পরাগল খান মহামতি/পঞ্চম গৌড়েতে যার পরম সুখ্যাতি। সুবর্ণ বসন পাইল অশ্ব বায় গতি। লস্করী বিষয় পাই আইবন্ত চাহিয়া/চাটিগ্রামে চলি গেল হরষিত হৈয়া। পুত্র পৌত্রে রাজ্য করে খান মহামতি/পুরাণন শুনস্ত নিত্য হরষিত মতি।।”

কবীন্দ্র পরমেশ্বর সংস্কৃতে বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন এবং তিনি মহাভারতের স্ত্রী-পর্ব পর্যন্ত অনুবাদ রচনা করেন। পরাগলের বিজয়দৃপ্ত সুযোগ্য পুত্র ছুটি খাঁ শ্রী করণ নন্দীর। দ্বারা মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের অনুবাদ সংকলন করাইয়াছিলেন।

শ্রী করণ নন্দী তাঁহার গ্রন্থের ভূমিকায় ঐতিহাসিক অনেক কথাই লিখিয়াছেন। পরাগল খাঁর আদেশে বিরচিত মহাভারতের এক জায়গায় কবীন্দ্র পরাগল-তনয় ছুটি খাঁর উল্লেখ করিয়াছেনঃ “স্তনয় ছুটি খাঁ পরগ উজ্জ্বল/কবীন্দ্র পরমেশ্বর রচিল সকল।”

সেই স্বভাবের নিভৃত পরম সুন্দর নিকেতন চন্দ্রশেখর পর্বতের ক্রোড়দেশে, শ্যামল বনস্পতি সচল মুক্তার পংক্তির ন্যায় নিঝরধরা অধ্যুষিত পরম রমণীয় রাজধানীতে বসিয়া প্রজারঞ্জক বা মহাবীর মুসলমান সেনাপতিরা হিন্দু পন্ডিতের দ্বারা রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ করাইয়াছিলেন। তাঁহাদের কীর্তি জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হউক-এই ছিল হৃদয়ের আকাক্সক্ষা। সে কামনা চরিতার্থ হইয়াছে। আজ ৪৫০ বৎসর পরে তাঁহাদের মাতৃভাষার গৌরবের সঙ্গে প্রজারঞ্জক এই রাজাদের কাহিনী দেশবিত হইয়াছে। পরাগল খাঁর পিতা রাস্তি খানের সমাধি এখনও পরাগল পুরে বিরাজিত। ঐ পল্লীতে বিশাল পরাগলী দীঘি এখনও সেই মহামান্য লস্কর খানের স্মৃতি বহন করিয়া তরঙ্গায়িত হইতেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন