আমাকে চেনা যায়? আমার নাম করতোয়া। আমি মরে গেছি না বেঁচে আছি নিজেও জানি না। একদিন শ্রোতম্বিনী ছিলাম; এখন খাল হয়ে গেছি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভোজনপুর ইউনিয়নে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি। অতঃপর করতোয়া দিনাজপুর সদর উপজেলার সরকারপুর ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে আত্রাই নদীতে মিশেছে। আবার করতোয়া নাম ধারণ করে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় (প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন নগরীর রাজধানী) দিয়ে প্রবাহমান। গাইবান্ধায় বাঙালি এবং বগুড়াজুড়ে করতোয়া বঙ্গবন্ধু সেতুর ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নলকা সেতুর কাছে ফুলজোড় নাম ধারণ করেছে। এখন এক সময়ের শ্রোতধারার করতোয়ার পানির অভাবে অস্তিত্ব রক্ষা দায় হয়ে পড়েছে। করতোয়া নদীর কয়েকটি পয়েন্টে ঘুরে দেখা গেছে পানির অভাবে নদী কার্যত খালে পরিণত হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রথমে সিএনজি, অতঃপর বাইকে উল্লাপাড়ার হাটিকুমরুল ইউনিয়নের আলোকদিয়া জামে মসজিদের সামনে নামতেই বাইক চালক বুঝতে পারেন ‘নদীর চালচিত্র’ নিয়ে রিপোর্ট করতে এসেছি। বললেন, ‘স্যার নদী শুকানো নিয়ে রিপোর্ট লিখবেন আপনার কাছে ভাড়া নেব না। আপনি শুধু তেল খরচ ২০ টাকা দেন’। ‘আপনি দক্ষিণ দিকে গেলে প্রকৃত চিত্র বুঝতে পাবেন; নদীর অস্তিত্ব পাবেন না। দুই ধারে শুধু ধানের ফসল’ যোগ করেন তিনি। ২০ টাকা দিয়ে বাইকওয়ালার কাছ থেকে বিদায় নিতেই চোখে পড়ল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের উদ্বোধন করা একটি খোদাই করা পিলার। করতোয়া নদী থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ধানের জমিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি উদ্বোধন করেছেন বাঙালি-করতোয়া-ফুলজোড়-হুরাসাগর নদীর ড্রেজিং, পুনঃখননসহ তীর সংরক্ষণ প্রকল্প। এখানে নদী যেন মরা সরু খাল। পানির প্রবাহ নেই। রায়গঞ্জ উপজেলার তালুকদিয়া গ্রামের আয়াতুল আখন্দের পুত্র নুরুল আমিন নদীপাড়ে ধানের জমিতে পানি সেচ দিচ্ছেন। বললেন, ‘যমুনায় পানি না থাকলে করতোয়া-ফুলজোড় নদীতে পানি থাকে না। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে এ নদীর প্রশস্ত দেড় থেকে দুই কিলোমিটার হয়। বর্তমানে শুকিয়ে কয়েক গজ মাত্র। নদীর দুই ধারে বিস্তীর্ণ এলাকায় ইরি ধান চাষ করা হচ্ছে’। মোছা. নুরজাহান বাবাকে দুপুরের ভাত খাওয়াতে ধানক্ষেতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘হামার দাদার মুখে শুনেছি এই নদী দিয়ে সওদাগরী জাহাজ, লঞ্চ এবং বড় বড় বজরা চলতো। যমুনা হয়ে এই নদী দিয়ে পণ্য পরিবহন করে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করতে বগুড়া যেতো’। প্রাচীন আমলে করতোয়া নদীকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠেছে। অথচ উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, দখল-দূষণ এবং গতিপথে মানুষের হস্তক্ষেপে বিপন্ন হয়ে গেছে করতোয়া-ফুলজোড় নদী। উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী করতোয়া এখন মৃতপ্রায়।
করতোয়া নদীর কয়েক কিলোমিটার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নদীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বগুড়া অংশে। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা করতোয়ায় পানি প্রবাহ নেই। দখল আর দূষণে নদী জর্জরিত। পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর দুইপাশে ভরাট হয়ে গেছে আধা কিলোমিটার থেকে এক কিলোমিটার পর্যন্ত। সেখানে পলি জমায় স্থানীয়রা ধান, ভুট্টা, চিনাবাদাম, গম চাষাবাদ করছেন। উল্লাপাড়ার তালুকদিয়া গ্রামের ৮৫ বছর বয়সী মো. হজরত আলী স্রোতস্বিনী করতোয়া নদীর স্মৃতিচারণ করে বললেন, ‘আমার বিয়া হয় ১৯৬০ সালে। বজরায় চড়ে বউ ঘরে এনেছি। নদী ভরা পানি আর শ্রোত ছিল। কয়েকটি ঘাট ছিল। এখন করতোয়া বিভিন্ন স্থানে দখল হয়ে গেছে। আমরা যা দেখিছি তার চেয়ে এমুরো ওমুরো দখল হইচ্ছে।’
করতোয়া নদী দেখতে ক্যামেরা নিয়ে সংবাদকর্মী এসেছেন খবর পেয়ে অনেকেই জড়ো হন। তবে কয়েকজন নদীর জমি দখল করে ধান চাষ করায় ক্যামেরায় ছবি তুলে রাজী হলেন না। উৎসুক জনতার একজন করতোয়ার তীরবর্তী বাসিন্দা শরীফ উদ্দিন আমাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘এদিগি মনে করেন যে এখন শুকোয় যাইচ্ছে (করতোয়া)। এই নদীডা মনে করেন যে (বর্ষায়) ভরে যায়, জমিজমা সব কিছু ভাইঙ্গে যাইচ্ছে। পানি থাকরে মাছ ধরিচ্ছি, এখন পানি নাই মাছও নাই; তাহলি কেমনে হামরা কী কইরা খামু কও?’
বগুড়া শহর থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে এগিয়ে গেলে করতোয়ার পানিপ্রবাহ জীর্ণ নালার মতো মনে হলো। নদীর প্রশস্ততার প্রমাণ মেলে নদীর ওপর সড়ক সেতু দেখলে। সেতুর নিচ দিয়ে নদীর প্রশস্ত সীমারেখা বোঝা গেলেও নদীতে পানির প্রবাহ জীর্ণ দশা। নদীর বুকে অনেক জায়গায় চাষাবাদ হচ্ছে। নদী পাড়ের অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তারা সবাই দায়ী করেন ভারতের ফারাক্কা বাঁধকে। বগুড়ার শাহ আজিজুল হক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়ের তৌহিদুর ইসলাম। তিনি বলেন, এমনিতেই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব এবং পদ্মা শুকিয়ে যাওয়ায় করতোয়া নদীর এমন মরণদশা। এ ছাড়াও অবৈধভাবে নদী দখল, হাসপাতালের বর্জ্য, শিল্পকারখানার বর্জ্য, পলিমাটি, পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক, মলমূত্রসহ সকল প্রকার আবর্জনা ফেলে নদী ভরাট ও দূষণ করা হচ্ছে। ভারতের আগ্রাসী পানি নীতির পাশাপাশি মানব সৃষ্ট দূষণের কবলে পড়ে করতোয়া নদী বিলীন হওয়ার পথে। পানির অভাবে নদী মরে যাওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। নদীতে পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।
বগুড়া শহর থেকে করতোয়ার গতিপথ ধরে কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়। আড়াই হাজার বছর আগে এই নদীর পশ্চিম তীরে সভ্যতা গড়ে উঠে। সেখানে কয়েকজন জানান, এমনিতে পানিপ্রবাহ নেই; এর মধ্যে নদীর দুই ধার অবৈধ দখল এবং দূষণ হচ্ছে। স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এসব করছেন।
করতোয়ার নদী তীর বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। শুধু ধানের জমি। নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় কৃষক-ক্ষেতমজুরদের সঙ্গে। বাম ধারার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত মজিদুল ইসলাম নামের এক ক্ষেতমজুর জানালেন, করতোয়ার গাইবান্ধা অংশের নাম কাটাখালী। সে নদী শুকিয়ে চর পড়ে গেছে। ভরা বর্ষাতে বন্যার কবলে পড়ে এই জনপদ। গাইবান্ধার কাটাখালী নদী গোবিন্দগঞ্জ থেকে করতোয়া নামে প্রবাহিত। করতোয়া নামে এ ধারাটি বাঙালি নদীর সঙ্গে মিশে যমুনায় পড়েছে। গাইবান্ধার মৎস্যজীবী আইনুর হক বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকায় মাছ কমে গেছে। এই জন্যি অনেক জেলে পেশা বদর করে এলাকা থেকে উঠে গেছে। আর হামরা যারা আগে থ্থেকেই মাছ মারি, আমরাতো আর অন্য কাজ কইরতে পারি না। সারাদিন তিনশ টাকার মাছ হলিও করতোয়ায় আছি’।
গত কয়েকদিন দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর ছোট-বড় নদ-নদী ঘুরে হতাশ হতে হলো। অধিকাংশ নদীতে পানিপ্রবাহ নেই, শুকিয়ে মৃতপ্রায়। আবার কোনো কোনো নদী দখল-দষণে নদ-নদীগুলো প্রকৃত নদীর চরিত্র হারাতে বসেছে। নদী শুধু চাষাবাদের পানি চাহিদাই মেটায় না; নদ-নদী উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ওই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। নদীই বহু প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। ভারতের পানি আগ্রাসী নীতির কারণে দেশের উত্তরাঞ্চরের নদীগুলো তার আপন সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে। সেই সঙ্গে নদীতে বাস করা প্রাণী-উদ্ভিদের আবাসস্থল বিলুপ্ত হচ্ছে। এসবকিছু প্রভাব ফেলেছে জীববৈচিত্র্যে। পদ্মায় পানিপ্রবাহ নীচে নেমে যাওয়ায় শাখা-প্রশাখা নদীগুলোর অন্যতম করতোয়া শুকিয়ে গেছে। এক সময়ের শ্রোতধারায় করতোয়া ভারতের মোদী সরকারের তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখা এবং চুক্তি অনুযায়ী পদ্মায় পানি না দেয়ায় প্রবাহ হারিয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের একশ্রেণির অবিবেচক মানুষের লোভ ও কান্ডজ্ঞানহীনতায় করতোয়ার এখন মরণদশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন