শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মওদুদ আহমদ: তার মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন | প্রকাশের সময় : ২১ মার্চ, ২০২১, ১২:০২ এএম

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (১৯৪০-২০২১) ছিলেন একজন ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, খ্যাতনামা আইনজীবী, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক এবং লেখক। বিশেষ করে আইনবিদ, রাজনীতিক ও লেখক এই তিন পেশায়ই তিনি সমভাবে খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন। এটা পৃথিবীতে অবশ্যই বিরল। তিনি এই উপমহাদেশের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী ছিলেন। তিনি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। এই দুই পেশার মাঝেও তিনি একজন লেখক ছিলেন। লেখক হিসাবেও তিনি আলোচিত। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে প্রায় সর্বক্ষেত্রে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের অনন্যসাধারণ ভ‚মিকা রয়েছে। তিনি একজন অমায়িক ব্যক্তি ছিলেন। সবার সাথে তার অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। তার সাথে দীর্ঘ সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার। তার প্রতি আমার যে শ্রদ্ধাবোধ তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এই স্বল্প পরিসরে তার সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা সম্ভব নয়। আমি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি এবং তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

মওদুদ আহমদের জীবন অত্যন্ত বর্ণাঢ্য এবং ঘটনাবহুল। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ও সমাজ সচেতন ছিলেন। সে কারণেই স্কুলে পাঠরত অবস্থায় মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং অনেকের সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু বয়সের বিবেচনায় তাকে পরবর্তীকালে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার বাবা একজন পন্ডিত ছিলেন এবং পুত্রের জীবনে প্রভাব ফেলেছিলেন। মওদুদ আহমদ ছিলেন ধর্মপ্রাণ ও সজ্জন ব্যক্তি। সে কারণে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।
মওদুদ আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে লন্ডনের লিঙ্কন্স ইন থেকে ব্যারিস্টার অ্যাট ল’ ডিগ্রি লাভ করেন। লন্ডনে ছাত্রাবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। লন্ডনে পূর্ব পাকিস্তান হাউস নামে যে প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করেছিল, তার সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। লন্ডন থেকে দেশে ফিরে তরুণ আইনজীবী হিসেবে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ডিফেন্স লিগ্যাল টিমের একজন সদস্য ছিলেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পোস্ট মাস্টার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আস্থায়ী সরকারের আন্তর্জাতিক প্রচারণা সেলেও অবদান রাখেন। স্বাধীনতার পর তিনি দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার, বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই শুরু করেন। তিনি ‘কমিটি ফর সিভিল লিবারটিস অ্যান্ড লিগ্যাল এইড’ গঠন করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণে জরুরি নিরাপত্তা আইনে আটক অনেক নেতার পক্ষে আদালতে ভূমিকা রাখেন। এ কারণে তাকে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়। পরে ১৯৯০, ১৯৯১ ও ২০০৭ সালে জরুরি সরকারের আমলেও তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। ১৯৯৬ সালে কারাগারে থেকেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৭ সালে আমি তার সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের চম্পাকলী সেলে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। কারাগারে তিনি সামান্য সময়ও বিনা কারণে ব্যয় করতেন না। সবসময় লেখাপড়া, বইলেখা এবং ধর্ম-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ ২০১৩ সালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে গ্রেপ্তার হন। একই মামলায় আমিও গ্রেপ্তার হয়েছিলাম এবং জেলজীবন একসঙ্গে কাটিয়েছি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েই গুলশানের যে বাড়িতে ৪০ বছর বসবাস করেছেন, সেই বাড়ি থেকে উৎখাত হয়েছেন। মৃত্যুকালেও তার মাথায় ছিল ৩৭টি মামলা। মওদুদ আহমদ যে আজীবন সংগ্রামী জননেতা ছিলেন, তা সবাই স্বীকার করেন।
মওদুদ আহমদের রাজনৈতিক জীবন অত্যন্ত বর্ণাঢ্য। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে, তখন তিনি তার সান্নিধ্যে আসেন। জিয়াউর রহমান তাকে ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল সময়কালে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তার মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় সদস্য হিসেবে দেশ গঠন এবং জাতীয়তাবাদী দল গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৪ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, পরে প্রধানমন্ত্রী, ১৯৮৯ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নব্বইয়ের ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পদত্যাগের পর তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে উপ-রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৯৬ সালে পুনরায় বিএনপিতে যোগদান করে ২০০১-২০০৬ সময়কালে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় তিনি আইন-বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন।
মওদুদ আহমদ স্পষ্টবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। বিএনপির জন্মলগ্ন থেকে মওদুদ আহমদের সঙ্গে আমি বিএনপিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তিনি দলে বা সরকারে বিভিন্ন বিষয় বা ইস্যুতে বলিষ্ঠ ও সুস্পষ্ট মতামত দিতেন। তিনি অত্যন্ত গণতন্ত্রমনা ছিলেন। কোনো ইস্যুতে মতবিরোধ থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর অত্যন্ত খোলা মনে গ্রহণ করতেন এবং একাত্মতা ঘোষণা করতেন। বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক চর্চায় তিনি নিবেদিত ছিলেন। ব্যারিস্টার মওদুদ একজন পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। দেশের সমসাময়িক রাজনীতি, সংবিধান, সংসদ, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন বিষয়ে অত্যন্ত জ্ঞানগর্ব নয়টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই মূল্যবান বইগুলোতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতি, উন্নয়ন, গণতন্ত্রবিষয়ক তথ্যাদি ও পর্যালোচনা রেখে গেছেন। লেখক মওদুদ আহমদ সব সময়ই প্রশংসিত। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে একাধিক গ্রন্থে তিনি বিএনপির নানা ব্যর্থতার নির্মোহ সমালোচনা করেছেন। যতবার জেলে গিয়েছেন বের হয়েই প্রকাশ করেছেন একাধিক গ্রন্থ। জেলখানার একাকিত্বকে তিনি বই লিখে উপভোগ করেছেন। তার রচিত ১২টি বইয়ের মধ্যে অন্তত পাঁচটি বই আছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ বছরের রাজনীতির ইতিহাসের চিত্র পাওয়া যায়।
রাজনীতিক, আইনবিদ ও লেখক সত্তার বাইরে তিনি একজন শিক্ষকও। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাউজ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফায়ার্স, ফেয়ারব্যাংক এশিয়া সেন্টার এবং হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান ইনস্টিটিউটের ফেলো। তিনি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিয়ট স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফায়ার্সের ভিজিটিং প্রফেসর।
পেশাজীবী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মানবাধিকার আইনজীবী, শিক্ষক, লেখক, রাজনীতিবিদ এবং একজন বিশিষ্ট পার্লামেন্টেরিয়ান হিসেবে তিনি সব সময়ই সরব ভূমিকায় ছিলেন। তিনি রাজনীতিতে ভদ্রতা, সভ্যতা এবং অন্যরকম এক সংস্কৃতি লালন করতেন। ব্যারিস্টার মওদুদকে খন্ডিতভাবে বিচার করলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। বাংলাদেশের আলোকিত ভবিষ্যৎ এবং সমৃদ্ধির পথে তিনি তার প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করে গেছেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে হারিয়ে বাংলাদেশ একজন বিচক্ষণ ও প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হারিয়েছে। আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল একজন পথপ্রদর্শক ও অভিভাবক হারালাম। বিশেষ করে, আমি আমার একজন অত্যন্ত দক্ষ সহকর্মী হারালাম। তার পরিবারের সদস্যরা হারালো তাদের ওপরে থাকা একটি বটগাছ। আমার বিশ্বাস, রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং বিচারালয়ে মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে যে ক্ষতি হলো সে ক্ষতি পোষানোর মতো নয়। আমি তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি। পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি। আল্লাহ যেন তাকে বেহেশতবাসী করেন।
লেখক: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন