শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সড়কে কবে থামবে মৃত্যুর মিছিল?

| প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

সড়কে আর কত প্রাণ ঝরবে, পুরানো এ প্রশ্নের আজ পর্যন্ত কোনো জবাব মেলেনি। সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি যেন অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সড়কে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে কিংবা আহত হচ্ছে। সর্বশেষ প্রকাশিত খবর মতে, গত রোববার ফরিদপুরের মধুখালিতে ট্রাক ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের ৬ জনসহ ৯জন মারা গেছে। এছাড়া অন্যান্য স্থানে মারা গেছে আরো ৯জন। এর মধ্যে ভাঙ্গায় পৃথক দুর্ঘটনার দুই কলেজছাত্রসহ ৩জন, সাভারে ট্রাক চাপায় এক কলেজছাত্র, মাগুরায় প্রাইভেট কারের সঙ্গে সংঘর্ষে এক মোটরসাইকেল আরোহী, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে ব্র্যাকের কর্মী ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ট্রাক চাপায় এক বৃদ্ধ মারা গেছে। এই একদিনের সড়ক দুঘর্টনার প্রকৃতি থেকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যানবাহনের মুখোমুখী সংঘর্ষ ছাড়াও যানবাহনের চাপায় মানুষ মারা গেছে। মোটরসাইকেল আরোহীও মারা গেছে। সন্দেহ নেই, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার এবং মোটরসাইকেল চালকদের বেপরোয়া যানচালনাই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। এ বিষয়ে আমরা সবাই অবহিত যে, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালক। তাদের অদক্ষতা, অহেতুক প্রতিযোগিতা, জেদ ও অপরিনামদর্শিতার জন্যই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে। এইসঙ্গে দুঘর্টনার অন্যান্য কারণও আছে। যেমন, রাস্তাঘাটের ত্রুটি ও বিশৃংখলা, পথচারিদের ট্রাফিক আইন না মানা ইত্যাদি। আমরা কারণগুলো জানি। কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে, তাও কমবেশি জানি। বিশেষজ্ঞরা তা আমাদের বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন। তারপরও অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। সড়ক দুর্ঘটনা কমা তো দূরের কথা বরং দিনকে দিন বাড়ছে। পত্রপত্রিকায় ফেব্রুয়ারি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় কতজন মারা গেছে, তার একটা পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে। দেখা গেছে, ওই মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৮ জন নিহত হয়েছে। চলতি মাসের হিসাব পেতে আরো অপেক্ষা করতে হবে। এ পর্যন্ত সড়কে যত প্রাণহানি হয়েছে, তাতে অনুমান করার যায়, ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে প্রাণহানির সংখ্যা এ মাসে বাড়বে।

আমরা বহুদিন ধরে শুনে আসছি, চালকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, ডোবটেস্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে, পথচারিদের পথচলার নিয়ম-কানুন শিক্ষা দিতে হবে, রাস্তা প্রসারিত ও দখলমুক্ত করতে হবে, রাস্তার পাশ থেকে বাজারঘাট তুলে দিতে হবে, সড়ক-মহাসড়কে অযান্ত্রিক ও ব্যাটারিচালিত যান চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে, প্রতিটি যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকতে হবে, মালিকদের বৈধ সার্টিফিকেটধারী চালক নিয়োগ করতে হবে, ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে ইত্যাদি। এসবের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে উচ্চ আদালতের দিক-নির্দেশনা পর্যন্ত আছে। অথচ কোনো তাকিদ ও দিক-নির্দেশনাই কার্যকর হচ্ছে না। বিআরটিএ, যানবাহন মালিক-শ্রমিক, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় যুগপতভাবে এর জন্য দায়ী। টাকা দিলে লাইসেন্স পাওয়া যায় চালকের, ফিটনেস সাটিফিকেট পাওয়া যায় যানবাহনের। একথা কি বিশ্বাস করা যায় যে, দেশের যানবাহনের সংখ্যার তুলনায় চালকের সংখ্যা অনেক কম? তাহলে বাকী যানবাহন চালাচ্ছে কারা? বলা বাহুল্য, ভুয়া লাইসেন্সধারীরাই চালাচ্ছে। এদের কম পয়সায় নিয়োগ দিচ্ছে মালিকরা। ধীরগতির অযান্ত্রিক ও ব্যাটারিচালিত যান, নসিমন-করিমন ইত্যাদি দিব্বি সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করছে। কেউ তাদের রুখছে না। কোথাও সুচারু ট্রাফিক ব্যবস্থার বালাই নেই। অনেক বলেন, বিআরটিএতে ঘুষবাণিজ্য ওপেন সিক্রেট। অন্যদিকে বাস বা ট্রাক মালিক সমিতি সরকারী দলের সঙ্গে যুক্ত। বাস-ট্রাক শ্রমিকরাও তার ব্যতিক্রম নয়। সরকারী দলের হওয়ায় তারা সাতখুন মাপের সুবিধা ভোগ করছে। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, অভিযোগ আছে, দায়িত্বপালনে যতটা ব্যস্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে বা-হাতের কাজে। ডোবটেস্ট যারা করবে বা করাবে, উভয়পক্ষই কেমন জানি নিষ্ক্রিয়। ফলে যা হওয়ার, তাই হচ্ছে। রাস্তাঘাট, সড়ক-মহাসড়কে, কোথাও নিয়ম-শৃংখলা নেই। সর্বত্র বিশৃংখলা ও আইন অমান্য করার প্রতিযোগিতা চলছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, যতদিন বিআরটিএ, বাস-ট্রাক মালিক সমিতি, বাস-ট্রাক শ্রমিক সমিতি, পুলিশ ও প্রশাসন ঠিক না হবে ততদিন সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমবে না। আমরা বিস্মিত হই, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্বিকার ভূমিকা দেখে।

সড়ক দুর্ঘটনার দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। ২০২০ সাল মূলত করোনাকাল হলেও ওই বছর, যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ৪ হাজার ৮৯১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ৬ হাজার ৬৮৬ জন এবং আহত হয়েছে ৮ হাজার ৬০০ জন। করোনাকাল না হলে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা যে আরো বেশি হতো, তাতে সন্দেহ নেই। আমরা লক্ষ্য করেছি, কখনো কখনো গোটা পরিবার দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শেষ হয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি দুর্ঘটনায় নিহত হয় কিংবা আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে। এসব পরিবার নিরালম্বন হয়ে পড়ে। এদের দু:খ-কষ্ট ও কান্না কেউ শোনে না। দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছি, অথচ এতদিনে সড়ক দুর্ঘটনাসহ কোনো দুর্ঘটনাই সফলভাবে রুখতে পারার সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। আমরা রাস্তাঘাটসহ কোনো ক্ষেত্রেই নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। পরিবেশকে নাগরিকবান্ধব করতে পারিনি। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও মাটিদূষণ, শব্দদূষণ ইত্যাদি দূষণে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকিতে নিক্ষিপ্ত। রোগব্যধির তান্ডব, স্বাস্থ্যহানি ও পুষ্টিহীনতার তো কথাই নেই। আমরা সুযোগ পেলেই উন্নয়নের জয়গান করি। কিন্তু উন্নয়ন যাদের জন্য, সেই নাগরিক সাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা, তাদের সুস্বাস্থ্য, সহজ-সচ্ছল জীবনযাপন অনিশ্চিতই হয়ে আছে। এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু হতে পারে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ২৪ মার্চ, ২০২১, ১২:৪৬ পিএম says : 0
When our country will be ruled by Allah's Law [Qur'an]
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন