আহমেদ জামিল : গত ১৭ জানুয়ারি ঢাকা মহানগরীর কাছাকাছি দুটি এলাকা সেগুনবাগিচার মৎস্যভবনের সামনের রাস্তা এবং শাহবাগের রাস্তায় বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুই মেধাবী কিশোরী ছাত্রী সাবিহা আক্তার এবং খাদিজা আক্তারের মর্মান্তিক মৃত্যু দেশবাসীকে মর্মাহত করেছে। এ ধরনের আরো অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনা দেশবাসীকে মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ করছে। তারপরও ক্রয়ফায়ারের মতো ঘাতক বাস ও ট্রাকের চাপায় মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত রয়েছে। এভাবে অকালে ঝড়ে পড়ছে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে কত পরিবার পথে বসছে এবং কত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে অসহায় জীবনযাপন করছে তাদের খোঁজ-খবর আমরা ক’জনেই বা রাখি। এক একটি সড়ক দুর্ঘটনা যে সেসব পরিবারের কান্না তা পাষাণ হৃদয় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে কতটা মানবিক সহানুভূতি জাগায় জানি না।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলো নিজেদেরকে ‘ঘাতক নয়, জনগণের সেবক’ দাবি করে থাকেন। তবে তাদের বাস্তব কর্মকা- কি সেটা প্রমাণ করে? স্বীকার করা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য একতরফা বাস চালকদের দায়ী করা সমীচীন নয়। পথচারীদের অসতর্কতা, দায়িত্বহীনতার পাশাপাশি ক্রটিপূর্ণ সড়কপথও দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। এর পাশাপাশি হাইওয়েতে স্কুটার, নসিমন, করিমন, রিকসাভ্যানসহ অন্য ছোট আকারের যানবাহন চলাচলও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। সেই সাথে পরিবহন মালিকদের অতিমুনাফা প্রবৃত্তি এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কারণে ফিটনেস বিহীন গাড়ি চালাতে বাধ্য হন পরিবহন চালকরা। সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ এটিও। তাছাড়া খরচ কমানোর জন্য বেশির ভাগ পরিবহন মালিক শ্রম আইনে বর্ণিত কাজের সময়সীমা না মেনে পরিবহন শ্রমিকদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা কাজ করিয়ে থাকেন। ক্লান্ত ও অবসন্ন বাস চালকরা অনেক সময় অসাবাধনতা বশতঃ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন।
এসব সত্য মেনে নিয়েও একথা স্বীকার করার সময় এসছে যে সড়ক দুর্ঘটনার দায়ভার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিবহন শ্রমিক বিশেষ করে চালক বা ড্রাইভারদের ওপর বর্তে। বেশ কিছু গবেষণা প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতি, চালকদের ভুল এবং দায়িত্বহীনতার কারণে ৯১ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) ১৪ বছরের (১৯৯৮ থেকে ২০১২ সাল) তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে সড়কে প্রাণহানিকে ইরাক ও আফগানিস্তানে ভয়াবহ যুদ্ধের প্রাণহানির সাথে তুলনা করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সম্প্রতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গত বছরের সড়ক দুর্ঘটনার এক পরিসংখ্যান তুলে ধরেন তারা। তাদের হিসাব মতে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রদেয় তথ্যমতে, মোট দুর্ঘটনা হয়েছে ছয় হাজার ৫৮১টি। এই হিসাব মতে, গত বছর প্রতিদিন গড়ে দুই ডজন করে মানুষ রাস্তায় প্রাণ হারিয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হচ্ছে ৯ জানুয়ারি যে দিন যাত্রী কল্যাণ সমিতি তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওই দিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন প্রাণ হারান। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ভূমি প্রতিমন্ত্রীর ছেলেসহ ৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। যাই হোক, যাত্রী কল্যাণ সমিতি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের শ্রেণী ও পেশা যাচাই করে বলেছে, এদের ১ হাজার ৮০ জন ছাত্র, ৩০৫ জন শিক্ষক, ১৩৩ জন সাংবাদিক, ১০৯ জন চিকিৎসক, ১২৪ জন আইনজীবী, ১০৬ জন প্রকৌশলী, ৫৩৫ জন পরিবহন শ্রমিক, ৪১৯ জন চালক, ২৮০ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখার সদস্য এবং দুই হাজার ২৪১ জন পথচারী রয়েছেন।
অর্থাৎ নিহতদের বড় অংশ হলেন সাধারণ পথচারী। নিহতদের মধ্যে পেশাগতভাবে যাদের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে তাতে সম্ভাবনাময় জীবনের অবসানই শুধু বলা যাবে না, এদের অনেকের দ্বারা দেশ, সমাজ ও জাতি উপকৃতও হয়েছে। তাই এদের অস্বাভাবিক মৃত্যু দেশের সম্পদ হারানোর সাথে তুলনীয় হতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ৯১ ভাগ দায়ী বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং পরিবহন চালক। এর বিষদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলতে হয়, চালকদের অদক্ষতা, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রেষারেষি বা প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালানো, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন বা হেড ফোন ব্যবহার করার কারণে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে কমপক্ষে ৫৪ লাখ চালকের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অথচ তারা দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন। এ প্রেক্ষাপটে ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনার দায় সরকারও এড়াতে পারে না।
২০১৪ সালে আওয়ামী পন্থী পরিবহন শ্রমিক নেতা এবং নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান তার দেয়া তালিকা প্রদান করে কয়েক লক্ষ অদক্ষ পরিবহন শ্রমিককে লাইসেন্স প্রদানের জন্য সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। মন্ত্রীর সে সময়ের বহুল আলোচিত ও সমালোচিতা বক্তব্যটি ছিল, ‘বাস চালকরা রাস্তার গরু-ছাগল চিনলেই হল।’ তবে মন্ত্রীর বক্তব্যে ‘মানুষ’ কথাটি ছিল না। তাই অনেকেই তখন প্রশ্ন রেখেছেন যে, তাহলে কি মন্ত্রী মহোদয় অবাধে মানুষ গাড়ির চাকায় পিষ্ট করে হত্যার জন্য অদক্ষ পরিবহন শ্রমিকদের ঢালাওভাবে লাইসেন্স প্রদানের কথা বলেছেন? গত বছরের জুলাই মাসে মন্ত্রী শাহজাহানখানের পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তালিকা ধরে ১৯৯০ সাল থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার লাইসেন্স প্রাদন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ।
ওই বছরের ছয় মাসে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া ৩২ হাজার পেশাদার চালকের লাইসেন্স নবায়ন করে বিআরটিএ। এ থেকে এটিই স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয় যে প্রভাবশালীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার এবং চরম দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে বিআরটিএ পেশাদার মোটরগাড়ি চালকদের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ণের ক্ষেত্রে কোনো শর্তই মানছে না। এসব কারণে সড়ক পথ আজ হয়ে উঠেছে প্রচ- ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ এবং বরেণ্য সিনে চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনির মানিকগঞ্জে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর সমাজের বিভিন্নস্তরে সৃষ্ট প্রচ- ক্ষোভ ও দাবির মুখে শেখ হাসিনার সরকার সামায়িকভাবে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পরিবহন শ্রমিকদের কঠোর আইনের অধীনে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করেছিল।
এটি যে ওই বিয়োগন্তক ঘটনার ফলে সৃষ্ট গণরোষ ও ক্ষোভকে প্রশমিত করার কৌশল ছিল তার প্রমাণ মিলতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনির পরিবহন ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনার সরকার চালকের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই ধারায় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য পরিবহন চালক দায়ী বলে প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান ছিল। ঘাতকের শাস্তি তো এটিই হওয়া উচিৎ। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে নৌপরিবহন মন্ত্রীর নৈতিক সমর্থন পেয়ে তার নিজস্ব শ্রমিক ফেডারেশনের দাবি ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করে সরকার গত বছরে আগস্ট মাসে ৩০২ ধারায় মামলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে গিয়ে ৩০৪-এর (খ) ধারায় পরিবহন চালকের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ঘোষণা করে।
৩০৪-এর (খ) ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি হল ৩ বছরের জেল অর্থাৎ গুরুপাপে লঘুদ-। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা হলো দেশের সবচাইতে বড় সংঘবদ্ধ চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী। সংঘশক্তির জোরে এরা গোটা দেশ অচল করে দিতে পারে। সর্বোপরি রাজনৈতিক সংস্কৃতিগত কারণে এই লুম্পেন প্রলেতারিয়েৎ পরিবহন শ্রমিকদের বড় অংশ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শক্তিশালী সমর্থনভিত্তি। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনায় উদ্বেগ শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার ব্যপ্তি ঘটেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল জাতিসংঘ। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবে সবকিছুই অকার্যকর হয়ে রয়েছে। যেকারণে সড়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা কাউন্সিল অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিটিতে বুয়েটের শিক্ষক, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি, মালিক ও শ্রমিক নেতারা ছিলেন। ২০১২ সালের মাঝামাঝি কমিটির সদস্যরা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি মিলিয়ে ৭৮টি সুপারিশ করেন। কিন্তু এর বেশির ভাগ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই এমনটি হয়েছে। লক্ষণীয় দিক হল ৩০২ ধারা বলবৎ থাকাকালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার কিছুটা হ্রাস পায়। এই ধারায় মামলা বাতিলের পর পরিবহন শ্রমিকরা হয়ে উঠেছেন আরো বেপরোয়া। যেকারণে সড়ক দুর্ঘটনার হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ব্যক্তিত্ব ও বিবেক হীন কেনো কোনো পরিবহন শ্রমিক কর্তৃক ঠা-া মাথায় নৃশংসভাবে পথচারী, রিকসা ও স্কুটার চালককে গাড়ির চাকায় পিষ্ট করে হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে। তাই এখনই সরকার কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকবে।
মনে রাখতে হবে, জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। তাই ঘাতক পরিবহন চালকদের নৃশংসতা থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে চাই কঠোর আইনের প্রয়োগ।
য় লেখক : কলামিস্ট
লধসরষ২০১৩১২@ষরাব.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন