একাদশ শতকে মুসলিম সমাজে বিভিন্ন বাদ-মতবাদের এক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সর্বত্র গ্রিক দর্শন ও মুতাজিলা সম্প্রদায় ঘাঁটি গেড়ে বসে। এই দুই দর্শনের প্রভাবে আপামর মুসলিম সমাজ বিভক্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে দ্বীন ধর্মের কোমল বিশ্বাস থেকে সরে যেতে শুরু করে। মুসলিম মিল্লাতের এই ক্রান্তিকালে হুজ্জাতুল ইসলাম উপাধি ধারণ করে মুসলিম দর্শন তথা বিশ্ব দর্শনের প্রবাদপুরুষ হিসেবে এ ধরায় আগমন করেন বিরল প্রতিভার অধিকারী, নানাবিধ গুণাবলীর অপূর্ব সমাহার আবু হামেদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ গাজালি (রহ.)। তিনি দেশ, জাতি ও ধর্ম সকল বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এবং মহান সংস্কারকের ভূমিকা পালন করেন।
খোরাসানের একটি জিলার নাম তুস। তুসের রয়েছে প্রসিদ্ধ দুটি শহর। একটি তেহরান। আর অপরটি তুকান। ইমাম গাজালি (রহ.) ৪৫০ হিজরিতে তাহেরান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। গাজল অর্থ সুতা। বাবা মুহাম্মদ ছিলেন তথাকার একজন বড় সুতা ব্যবসায়ী। নামকরণের এই সামঞ্জস্য তার বংশকে গাজালি আখ্যায় আখ্যায়িত করেছে। কারও কারও মতে তিনি ছোট বেলায় হরিণের মতো চোখবিশিষ্ট অপরূপ সুদর্শন ছিলেন, আর গাজল অর্থ হরিণ, তাই বাবা তাকে শৈশবে আদর করে গাজালি বলে ডাকতেন। উভয় বর্ণনানুসারে তাকে গাজ্জালিও বলা হয়। আবার গাজালিও বলা হয়।
মাতৃভূমিতেই তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি। তাই গ্রামেই তিনি ফিকহ শাস্ত্রের প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন প্রখ্যাত আলেম ইমাম রাদাখানির নিকট। ইসলামের মৌলিক জ্ঞান ও ইসলামি আইনে তিনি অতি অল্প বয়সেই গভীর জ্ঞান লাভ করেন। শাফেয়ি মাজহাবের প্রখ্যাত আলেম আল জুওয়াইনি ছিলেন তাঁর অন্যতম শিক্ষক।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি জুরজান গমন করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণে আত্মনিয়োগ করেন ইমাম আবু নছর ইসমাঈল (রহ.)-এর নিকট। এ ছাড়াও তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমগণ ছিলেন তাঁর শিক্ষক। তন্মধ্যে সে সময়ের শ্রেষ্ঠতম ধর্মতত্ত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনি, আল্লামা আবু মুহাম্মদ যোবায়নি, আল্লামা আবু হামেদ আসকারায়েনি প্রমুখ আলেম অন্যতম।
ছোট বয়সেই তিনি উস্তাদের তাকরির (পাঠদান) শুনে শুনে ইলমি বিরাট তালিকাত লিখে ফেলেছিলেন। সে সময় ইসলামি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিল বাগদাদ ও নিশাপুর। বাগদাদে ইলমের সুধা পান করাতেন আল্লামা আবু ইসহাক সিরাজী। নিশাপুরে জ্ঞানের আলো বিতরণ করতেন ইমামুল হারামাইন।
বরিত ইমাম গাজালি (রহ.) মাতৃভূমি ছেড়ে চলে গেলেন তৎকালীন জ্ঞানের শহর নিশাপুর। নিশাপুরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষালয় নিজামিয়া মাদরাসা। এই নিজামিয়াতেই শিক্ষাগুরু ছিলেন ইমামুল হারামাইন। ছাত্র ইমাম গাজালি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উস্তাদের চারশো ছাত্রের মাঝে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি যে অপূর্ব মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন, সত্যি বলতে কি তাঁর উস্তাদ খোদ ইমামুল হারামাইনের ভাগ্যেও ততটা জুটেনি।
স্বীয় অসাধারণ প্রতিভা ও যোগ্যতা বলে উস্তাদ থেকে শুনা পাঠটি একবার শুনেই তা অন্যান্য সহপাঠীদের শুনিয়ে দিতে পারতেন অনায়াসে। ছাত্রজীবনেই তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা ও শিক্ষা-দীক্ষার খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আল্লামা ইবনে খাকান (রহ.) বর্ণনা করেছেন, ইমাম গাজালি স্বীয় প্রখ্যাত উস্তাদ ইমামুল হারামাইনের জীবদ্দশায়ই যথেষ্ট খ্যাতি লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। গৌরব ও মর্যাদায় এত উচ্চ মার্গে পৌঁছেছিলেন যে, স্বয়ং উস্তাদ ইমামুল হারামাইন পর্যন্ত শরয়ি সমাধানের জন্য তার দারস্ত হতেন। তবে সীমাহীন যোগ্যতার পরেও আপন উস্তাদ ইমামুল হারামাইনের সম্মান প্রদর্শনে কোন রকম ত্রæটি বা শিথিলতা প্রদর্শন করেননি।
ইমামুল হারামাইন ৪৪৮ হিজরিতে পরলোগ গমন করেন। প্রিয় উস্তাদের মৃত্যুর পর জ্ঞানস¤্রাট ইমাম গাজালি নিশাপুরের মায়া কাটিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। এ সময় সম্ভবত সমগ্র মুসলিম জাহানে ইমাম গাজালির সমকক্ষ অন্য কেউ ছিল না। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৮ বৎসর।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা সমাপ্তির পর তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের অধীনে মুসলিম বিশ্বে আধুনিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসংক্রান্ত কর্মকান্ডের জন্য সুপরিচিত নিজামুল মুলক শাসিত ইস্পাহান প্রদেশের আদালতে যোগদান করেন। বাদশাহ নিজামুল মুলকের দরবারে প্রায়ই বিভিন্ন ইলমি বিষয় নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতো। প্রত্যেকটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তিনি সেরা বিতার্কিক নির্বাচিত হন। ইলমি বাহাস মোনাজারায় এরূপ নৈপুণ্য প্রদর্শন ও নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন তার সুনাম সুখ্যাতির মাত্রাকে ব্যাপকতর করে দিলো। ছড়িয়ে পড়লো সুখ্যাতি দেশ ও বিদেশে। (চলবে)
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন