পানির অপর নাম জীবন। জীব জগতের অস্তিত্ব রক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখছে পানি। পানি আমাদের পিপাসার্ত হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করে। মহান প্রতিপালকের এক অপার দান পানি, পরিবেশ সংরক্ষণের মৌলিক উপাদান পানি। রাসায়নিকভাবে পানি হলো ঐ২ঙ; এটি সার্বজনীন দ্রাবক। পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় ৭৫ শতাংশ পানি দ্বারা আবৃত। পৃথিবীর মোট পানি সম্পদের শতকরা ৯৭ ভাগ হলো লবণাক্ত পানি, আর বাকি ৩ ভাগ হলো স্বাদু বা মিঠা পানি। একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুপেয় পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। USA Environment Protection Agency-এর সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাভাবিকভাবে একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষের প্রতিদিন ২-৩ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। এছাড়াও নৈমিত্তিক জীবনে সুপেয় পানির নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। যেমন-রান্না, পান করা, ওযু-গোসল, টয়লেটসহ প্রতিদিন একজন মানুষের জন্য ২০০ লিটার পানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে সুপেয় পানির পরিমাণ ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বিশেষত শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ, ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন এবং নগরায়নের সাথে সাথে কৃষিজ, পৌর এবং শিল্পকারখানা থেকে সৃষ্ট পানি দূষণ মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরের মত এবারও ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস পালিত হল। ২০২১ সালে এই দিবসের প্রতিপাদ্য : ‘ঠধষঁরহম ডধঃবৎ’। ‘পানি অমূল্য সম্পদ’ পানির অপচয় রোধ করা তাই অনিবার্য; তাহলেই কেবল ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতি গড়ে উঠবে। যেমনি বলা হয় ‘জল বাঁচান, ধরণী বাঁচান’। বিশ্ব পানি দিবসের এই প্রতিপাদ্যটি সময়োপযোগী হয়েছে। আমাদের জীবন ধারণের জন্য বায়ুর পরেই জরুরি হলো পানি। পানি মহান স্রষ্টার এক মহানিয়ামত। জীবন বাঁচানো ও সুস্থতার জন্য অক্সিজেনের পরেই পানির প্রয়োজন। মানুষের দৈহিক ওজনের শতকরা ৭০ ভাগই পানি। মাংসপেশীতে ৫০%, চর্মে এবং কোষ বহিঃস্থ কলায় ২০% এবং রক্তে প্রায় ৭% পানি থাকে। পুরুষের দৈহিক ওজনের ৬০% এবং মহিলাদের ৫০% পানি দ্বারা গঠিত। দেহে পানির অভাবে সমস্যা : দেহে পানির অভাব হলে তৃষ্ণা পায়। সাথে সাথে তৃষ্ণা দূর করতে না পারলে বিভিন্ন রোগ ও দৈহিক সমস্যা হয়। দেহ থেকে ঘামসহ বিভিন্ন কারণে পানি বের হলে পানির ঘাটতি হয়। এতে খনিজ পদার্থ মূত্রের সাথে কিডনি ও মূত্রথলিতে জমা হয়ে পাথর হয়। দেহে পানির ঘাটতি হলে বারবার বমি, রক্তপাত, পাতলা মলত্যাগ হয়। দেহের জলীয় অংশের শতকরা ১০ ভাগ পানি বের হলে শারীরিক অবস্থা বিপজ্জনক হয়। তখন রক্ত সংবহনে ব্যাঘাত ঘটে, খাদ্য হজম হয় না, পুষ্টিশোষিত হয় না, তাপ বাড়ে, কিডনি বিকল হয়, গ্যাস্ট্রিক হয়, দেহ নিস্তেজ হয়। শরীর দুর্বল হয়, ত্বক খসখসে হয়, কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ বিভিন্ন সমস্যা হয়। পানির বেশি ঘাটতি হলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। কিডনি বিকল হয়ে মাংস পেশী ফুলে উঠে। দেহে পানির কাজ : দৈনিক পূর্ণবয়স্ক পুরুষের তিন লিটার, মহিলাদের ২.৫ লিটার, যুবক-যুবতীদের ৩ লিটার, শিশুদের ১.৫ লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। প্রতিদিন স্বাভাবিক কারণে একজন পূর্ণবয়স্ক দেহ থেকে ২.৫ লিটার পানি বের হয়। জাপানে চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণের মানব দেহে পানির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এক গবেষণা রিপোর্টে লেখা হয়েছে যে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দৈনিক ৫ লিটার পানি পান করলে তার জীবনে ৫০০ রোগ হবে না। বিশেষ করে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পান করার গুরুত্ব দিয়েছে ঐ রিপোর্টে। মানবদেহের জৈবিক, রাসায়নিক ভৌতিক ও বিপাকীয় কাজে পানির বিকল্প নেই। খাদ্য গ্রহণের পরপরই পানি পান না করে ৩০ মিনিট পরে অল্প পানি পান করলে খাদ্য হজম ভাল হয় এবং ২-৩ ঘন্টা পরে বেশি পরিমাণ পানি পান করলে পরিপাককৃত পুষ্টি রক্তে শোষিত হয়। খাদ্য খাওয়ার সময় পানি পান করলে পাচকরস দুর্বল হয়। ফলে খাদ্য হজমে ব্যাঘাত ঘটে। চর্মরোগ বা ত্বকজনিত সমস্যা দূর করতে অর্থাৎ ত্বক মসৃণ ও আকর্ষণীয় করতে পানি পান করা প্রয়োজন। যৌনশক্তি অক্ষুণ্ণ রাখা ও বৃদ্ধি করতে নিয়মিত প্রচুর পানি পান করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সহবাসের পর পানি পান করলে দ্রুত যৌনশক্তি ফিরে আসে। তাই আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, তোমরা যে পানি পান কর সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কী ? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আন, না আমি বর্ষণ করি ? - সূরা ওয়াকি’আ।
ডা: মাও: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবাইল : ০১৭১৬ ২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন