স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। এটি কোনো দলীয় রাজনৈতিক ব্যাপার নয়, বাঙ্গালী মুসলমানের হাজার বছরের রাজনৈতিক বিবর্তনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক মতভিন্নতার প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণের একটি ক্ষুদ্র অংশ স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে সেই বিভাজনের কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। তবে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে এসেও বিভাজনের সুবিধাবাদি রাজনীতি এখনো সক্রিয় রয়েছে। গত এক দশকে সেই বিভাজনের ঘাঁ’কে আরো তীক্ষ্ণ ও রক্তাক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর আগে পুরো দশক ধরে যে দলটি দেশের শাসনভার পরিচালনা করছে, সেই দলের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই স্বাধীনতা সংগ্রাম চূড়ান্ত পরিনতি ও বিজয় লাভ করেছিল। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তি, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন। তার সেই প্রয়াসে পদ্ধতিগত ভুল থাকলেও শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম এবং ঐকান্তিক সদিচ্ছা ছিল প্রবল। একজন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ার মূলে ছিল তার সমর্থক রাজনৈতিক কর্র্মীদের বিশৃঙ্খলা, অসততা ও দেশাত্মবোধের সংকট। এসব চোর-জোচ্চোরদের নিয়ে তিনি অনেক আক্ষেপ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বাধীনতার চারদশক পেরিয়ে সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে দেশের শাসনভার যখন আওয়ামীলীগের হাতে, তখন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সুবর্ণজয়ন্তীকে অর্থবহ করে তোলার রাজনৈতিক কার্যক্রমই ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু আওয়ামী লীগের সভানেত্রীই নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা এটিই তার সবচেয়ে গর্বিত পরিচয়। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন তার পক্ষেই সবচেয়ে বেশি সম্ভব। দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীনরা যতই উচ্চকণ্ঠ হোক, আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, সাম্য এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার। স্থিতিশীল, উন্নত, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে মুক্তিযুদ্ধের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যসমূহের সফল বাস্তবায়নই একমাত্র পথ। এসব লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলে জাতির স্বাধীনতাও লক্ষ্যচ্যুত হতে বাধ্য।
নতুন সহশ্রাব্দের শুরুতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি ক্রেডিবল জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলী জোট সরকার গঠণ করেছিল। সেই জোটের সামনে কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষাভিসারি এজেন্ডা না থাকায় তারা মেয়াদ শেষে পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসা নিয়ে সন্দিহান হয়ে তত্ত¡াবধায়ক ব্যবস্থার উপর অযাচিত হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় আরেকটি পক্ষ এক-এগারোর সামরিক অভ্যুত্থান এবং অসাংবিধানিক সরকার কায়েম করে বাংলাদেশে একটি অনাকাক্সিক্ষত রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দেয়। তবে সেই অসাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে জাতি আবারো দুই বিপরীতমুখী প্ল্যাটফর্মের মধ্যে একটি অঘোষিত রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতা প্রত্যক্ষ করেছিল। দেশের শাসকশ্রেণীর দুই শীর্ষ নেত্রী একই সময়ে কারাবন্দি হওয়া এবং পাশাপাশি জেলে থেকে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়ার দৃষ্টান্তও সে সময়ে দেখা গিয়েছিল। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন ঐক্য দেখা গিয়েছিল। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিটি সংকট ও ক্রান্তিকালে এমন রাজনৈতিক ঐক্যই জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ আবারো একটি অনিশ্চিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সংকটের আবর্তে নিক্ষিপ্ত হলেও সেই ঐক্যপ্রক্রিয়া আর দেখা যায়নি। একদিকে মিয়ানমার থেকে আগত দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংকট, এনআরসি-সিএএ’র নামে ভারতের সৃষ্ট উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক ও ডেমোগ্রাফিক সংকট এবং একের পর এক একপাক্ষিক ও জনগণের অংশগ্রহণবিহীন নির্বাচন এবং পুলিশি নিপীড়নের মধ্য দিয়ে একটি প্রতিহিংসা ও স্পর্শকাতর রাজনৈতিক সংকটকে ধারণ করেই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী এবং স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেছে। অনেক স্বপ্ন ও প্রত্যাশার এই মাহেন্দ্রক্ষণ জাতির জীবনে বার বার আসেনা। সুবর্ণজয়ন্তীর এই বিশেষ ঐতিহাসিক সময়টাকে বিভাজন, প্রতিহিংসা ও পুলিশি নিবর্তনের থাবায় রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত হল কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে সমাধানের পথ সৃষ্টি না করলে এই বিভাজন থেকে মুক্তির পথ সুদূরপরাহত।
বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা অনেক বড় রাজনৈতিক ঘটনা হলেও ১৯৭১ সালের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা বিশ্ব সংবাদ হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী শিরোনাম হতে পারতো তা হয়নি। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকায় এসব ঘটনা যেভাবে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতো বাংলাদেশের সাতকোটি মানুষের স্বাধীনতার লড়াই সে তুলনায় অনেক কম গুরুত্ব লাভ করেছিল। মধ্যপ্রাচ্য এবং দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষ প্রান্তে ইন্দো-সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট বাংলাদেশের গেরিলা যোদ্ধারা পশ্চিমা গণমাধ্যমের কাছে অনেকটা অচ্ছুতই রয়ে গিয়েছিল। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ষোলই ডিসেম্বরের চূড়ান্ত মুহূর্তে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্যপটেও বাংলাদেশ আর্মির চিফ কমান্ডার জেনারেল এমএজি ওসমানি বা মুক্তিবাহিনীর কোনো প্রতিনিধিত্ব না রাখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রতিনিধিত্বকে অগ্র্হ্যা করার দৃশ্যপটই উঠে আসে। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমরা কখনোই জাতিগতভাবে বিভক্ত ছিলাম না। তা নাহলে ১৯৪৭ সালে হাজার মাইল দূরের পাকিস্তানের ইউনিয়নভুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও ঐতিহাসিক ধারাক্রমে কিছু মানুষের মতভিন্নতা ও দ্বিধাবিভক্তির ইতিহাস রয়েছে। আমেরিকান সিভিল ওয়ার থেকে শুরু করে সাতচল্লিশের ভারতভাগ, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম এবং একাত্তুরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই সত্য সপ্রমাণিত। প্রতিটা যুদ্ধের সাথেই আছে বর্ণবাদী বিভক্তি, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যার ইতিহাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বা গৃহযুদ্ধ অবসানের পর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে কোথাও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, কোথাও রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন, কোথাও যুদ্ধাপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ করার রাজনৈতিক প্রয়াস দেখা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও কলঙ্কমুক্ত করতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে কোনো রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠণ করা না হলেও বাকি সবগুলো উদ্যোগই প্রয়োগ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় ও কোলাবরেটর আইনে মামলা এবং স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে এসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচার করার উদাহরণ বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় জাতিকে আবারো ঐক্যবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার গণপ্রত্যাশা পূরণ করাই ছিল শাসকদলগুলোর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে তাদের মধ্যে কোনো প্রয়াস বা আগ্রহ দেখা যায়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি বা গোল্ডেন জুবিলি যেকোনো জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। স্বাধীনতা যেমন দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের পরম আকাক্সিক্ষত বস্তু, একইভাবে স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীকে আবাহন করা এবং একে অর্থবহ করে তুলতে এবং অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ লড়াইকে আরো শক্তিশালী করে তুলতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়াই এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলিত রাজনৈতিক উদ্যোগ হিসেবে গৃহিত হওয়াই ছিল গণমানুষের কাছে সবচেয় আকাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে আমরা এক ভয়ঙ্কর বৈশ্বিক মহামারীর সম্মুখীন, বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত রোহিঙ্গারা মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর যে সামাজিক-অর্থনৈতিক ও ডেমোগ্রাফিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসা, আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদ-নদীর উপর একতরফাভাবে বাঁধ দিয়ে, পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতি এবং দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও আঞ্চলিক ও আন্তজার্র্তিকভাবে বাংলাদেশ বিরোধীশক্তির তৎপরতার বিরুদ্ধে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার পথকে নিষ্কন্টক করার প্রয়াসই হতে পারতো এই সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য। কিন্তু এই সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ সময়টিতে আমরা কি দেখলাম? আমরা দেখলাম, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমন ঠেকাতে একটি গ্রুপ হঠাৎ করেই দেশে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরী করেছে। সেই উত্তেজিত জনতাকে ঠেকানোর নামে সরকারিদল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, গুলি করে ধর্মপ্রাণ মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষকে আরো বিক্ষুব্ধ ও সংক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এভাবেই আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব মুখর হয়ে ওঠার সময়টাকে রক্তাক্ত সংঘাতময় মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর নয়, আগেও তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন, এসব সফরের মাঝখানে নতুন এমন কিছুই ঘটেনি যে তার আগমনকে ঘিরে প্রতিবাদের ভাষাকে রক্তাক্ত যুদ্ধে পরিনত করতে হবে! দেশের রাজনীতির অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা এজেন্টরাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে কলঙ্কিত করতে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিরোধ-বিভক্তিকে স্থায়ী রূপ দিতে সরকারিদল ও সরকারি বাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। মূলত দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের নেতৃত্বে এবং শিক্ষার্থী ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সমর্থনে গড়ে ওঠা বৃহত্তম একটি সামাজিক সংগঠন। ধর্মীয় চেতনা সম্পৃক্ত সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষা ও আবেগকে পুঁজি করে এই সংগঠনটি বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে মবিলাইজ করতে সক্ষম হয়েছে। মোদি বিরোধী আন্দোলনে এই সংগঠনের নেতারা প্রথমে বড় বড় হুঙ্কার ছাড়লেও শেষ পর্যন্ত ২৬ মার্চ নরেন্দ্র মোদির আগমনের দিন কার্যত মোদির আগমন পথ বা রাজধানী কেন্দ্রিক তাদের কোনো বড় কর্মসূটি ছিল না। ছাব্বিশে মার্চ ঢাকার বায়তুল মোকাররমে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে প্রতিবাদকারিদের চেয়ে পুলিশের বাড়াবাড়ি অনেক বেশি ছিল বলে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়। চট্টগ্রাম বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নরেন্দ্র মোদির কোনো সফরসূচি না থাকলেও সেখানকার সাধারণ মুসল্লিদের বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল কিনা তা নিশ্চয় সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখবেন। ছাব্বিশ ও সাতাশ তারিখ চট্টগ্রামের হাটহাজারি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলিতে ১৭ জন হেফাজত কর্মীর মৃত্যুর দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে কোনো বিদেশি অতিথির আগমনকে কেন্দ্র করে এমন নৃশংস ও রক্তাক্ত ঘটনা যারা ঘটিয়েছে, তারা বাংলাদেশের সপক্ষের শুভ শক্তির প্রতিনিধি হতে পারে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানকে কলঙ্কিত করা এবং রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে জাতির ভেতরকার সামাজিক-রাজনৈতিক বিরোধকে আরো উস্কে দিয়ে জাতীয় ঐক্য ও শক্তিশালী বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করাই যেন তাদের লক্ষ্য ছিল।
স্বাধীনতার আড়াইশ’ বছর পেরিয়ে এসে বিশ্বের এক নম্বর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার শপথ বক্তৃতায় বলেছেন, ‘নাউ মোর দ্যান এভার, উই হ্যাভ টু চুজ হোপ ওভার ফিয়ার, ইউনিটি ওভার ডিভিশন, ট্রুথ ওভার লাইজ অ্যন্ড সায়েন্স ওভার ফিকশান’। নানা ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর বিশাল আমেরিকা যখন ভয়ের চেয়ে প্রত্যাশা, বিভক্তির স্থলে ঐক্য, মিথ্যার জায়গায় সত্য এবং কল্পকাহিনীর জায়গায় বিজ্ঞানকে বেছে নেয়ার কথা বলছেন, তখন একক ভাষা, প্রায় একক ধর্মীয় ও নৃতাত্তি¡ক জাতিগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র সমতল বাংলাদেশে আমরা কৃত্রিম, উদ্ভট সব সমস্যা সৃষ্টি করে জিইয়ে রেখে দেশের সম্ভাবনা, স্বাধীনতার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা বিনষ্ট করছি।
উপনিবেশ সমূহে বিভাজন-বিভক্তি ঔপনিবেশিক শাসকদের রাজনীতির হাতিয়ার ছিল। উপনিবেশোত্তর বিশ্বে সেই ধারা এখনো অব্যাহত রেখে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চেষ্টা করছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদী শক্তি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির দ্ব›দ্ব অমূলক-অর্থহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবকে দলমত নির্বিশেষে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণে সর্বদলীয় সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিনত করা অসম্ভব ছিল না। তার কোনো প্রয়াস সরকারের পক্ষ থেকে না থাকলেও দেশের জন্য এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সময়কে যারা সাধারণ মানুষেররক্তে কলঙ্কিত করেছে, তারা কখনো দেশের কল্যাণকামি শক্তি হতে পারে না। গত বছর মে মাসে করোনা মহামারির সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে স্থানীয় পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে সারা আমেরিকায় সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। মিনিয়াপোলিসের পুলিশ অফিসার ডেরেক সুভিন যখন জর্জ ফ্লয়েডের গলায় লাঠি ও হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিল তখন পথচারি এক কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরী সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে তা ভাইরাল হয়ে যায় এবং সারাদেশের মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। বলা হচ্ছে, মাত্র কয়েক মিনিটের ভিডিও আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীকে বদলে দিতে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। সেই ডেরেক সুভিনসহ সংশ্লিষ্টদের বরখাস্ত করার পর এখন তাদের বিচার চলছে। সেই বিচার কার্যক্রম এখন টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে। জনগণের রাষ্ট্রে এটাই স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের দাবী। স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীতে মোদি বিরোধী বিক্ষোভ দমনের নামে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রক্তাক্ত তান্ডব চালিয়ে যেসব মানুষকে হত্যা করা হল, সেসব ঘটনার সাথে পুলিশ সদস্য, হেফাজতকর্মী বা তৃতীয় পক্ষের যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিচার নিশ্চিত করা সরকার ও পুলিশ বাহিনীর অনেক বড় দায়িত্ব। যারা স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীর সময়ে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটিয়ে গৌরবময় ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে তারা যেই হোক, তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন