শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

আপনি রমযান কিভাবে কাটাবেন

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৪ এএম

মাহে রমযানের আজমত, মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাস আল্লাহর নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ সময়। মুমিনের পাথেয় অর্জনের ভরা মৌসুম। ইবাদত বন্দেগীর বসন্তকাল। এ মাসের একটি বৈশিষ্ট হলো, কুরআন মাজীদ, তাওরাত, যাবুর, ই্িঞ্জল ও হযরত ইবরাহীম আ. এর সহীফাসহ সকল প্রকার আসমানী কিতাব এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। [আল মুজামুল আওসাত,তবরানী, হাদীস:৩৭৪০] এ মাসে পূর্ণ কুরআন লওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর কুরআন মাজীদের সর্ব প্রথম ওহীও এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। রমযানের অন্য কোনো ফযীলত বর্ণিত না হলেও এই একটি ফযীলতই তার মর্যাদা ও মহাত্ম প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল। মাহে রমযানের মর্যাদা ও মহাত্মের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,‘রমযান মাস হলো সেই মাস, যাতে নাযিল হয়েছে কুরআন, যা মানুষের হেদায়াত ও সুপথ প্রাপ্তির সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্যকারী। কাজেই তোমাদের যে কেউ এ মাসটি পাবে, সে যেন অবশ্যই এ মাসের রোযা রাখে। [বাকারা:১৮৫] সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. বলেন, যখন রমযানুল মুবারকের আগমন ঘটল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের মাঝে বরকতপূর্ণ মাস রমযান এসেছে। এ মাসের রোযা আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর ফরয করেছেন। জান্নাতের দরজাগুলো এ মাসে খুলে দেওয়া হয় আর বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহান্নামের দরজাসমূহ এবং শয়তানদের আবদ্ধ করা হয় শিকলে। এ মাসে রয়েছে এমন একটি রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যাকে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হলো, তাকে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হলো। [আহমাদ, হাদীস: ৭১৮৪; নাসায়ী: ১/২৩০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস: ৮৯৫৯] মুমিন বান্দা যেন এ মাসের মহামূল্যবান ও অতি বরকতময় সময় পূণ্যের কাজে ব্যয় করতে পারে এবং মুনাফিক ও পাপীদের মতো কল্যাণ ও বরকত থেকে মাহরুম না থাকে, সে লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা রমযানের শুরু থেকেই পৃথিবীময় এমন আবহ সৃষ্টি করেন, যা পুরো পরিবেশকেই খায়র ও বরকত দ্বারা আচ্ছাদিত করে দেয় এবং তাদের পূণ্য ও প্রতিদানের সুসংবাদ দিতে খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো আর পাপাচার ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহান্নামের দরজাসমূহ। সর্ব প্রকার ফাসাদ অনিষ্ট থেকে রক্ষা করতে শিকল পড়িয়ে আবদ্ধ করা হয় দুষ্ট ও কুমনন্ত্রতাদা শয়তান ও জিনদের। এরপর আহবান করা হয় কল্যাণের পথে অগ্রসর হতে এবং অন্যায় ও পাপের পথ থেকে নিবৃত্ত থাকতে। এ মর্মে সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেছেন, ‘যখন রমযানুল মুবারকের আগমন ঘটে, তখন দুষ্ট ও কুমনন্ত্রতাদা শয়তান ও জিনদের শিকল পড়িয়ে আবদ্ধ করা হয় এবং বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহান্নামের দরজাসমূহ। ফলে পুরো মাস কোনো দরজাই খোলা হয় না। আর খুলে দেওয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো। ফলে পুরো মাস কোনো দরজাই বন্ধ করা হয় না। একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে- হে কল্যাণের প্রত্যাশী! সামনে অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের অন্বেষী! থেমে যাও। আর পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেন এ মাসের প্রতি রাতে। [তিরমিযী:১/৪৭; ইবনে মাজা:১১৮-১৮৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৬/৯৫, হাদীস: ৮৯৬০] এ ছাড়াও রমযানের আরও অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। সে যাই হোক, মাহে রমযানের এ সকল ফাযায়েল পেতে চাইলে নিম্ন বর্ণিত নিয়মে পুরো রমযান মাস কাটানো উচিত। ১. পুরো মাস রোযা রাখা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। এটি এ মাসের প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল। তাই প্রতিটি মুসলমান পুরো মাস রোযা রাখবে। এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’ (বাকারা:১৮৩) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই রমযান মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে।” (বাকারা:১৮৫) সাহাবী আবু হুরায়রা রা. এর বাচনিক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমরা রমযানের চাঁদ দেখ, তখন থেকে তোমরা রোযা রাখ। আর যখন শাওয়ালের চাঁদ দেখ, তখন থেকে রোযা বন্ধ কর। যদি আকাশ মেঘলা থাকে, তাহলে ত্রিশ দিন রোযা রাখ। (বুখারী: হাদীস, ১৯০৯; মুসলিম: হাদীস, ১০৮০) উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, রমযান মাসের রোযা ফরয ও ইসলামের অবশ্য পালনীয় বিধান। শরয়ী ওযর ব্যতীত তা না রাখার কোন অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রোযাদারের জন্য রয়েছে অফুরন্ত ও অবারিত নেআমত ও পুরষ্কারের ওয়াদাও। সাহাবী আবু হুরায়রার রা. বাচনিক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ (বুখারী, হাদীস: ১৮৬৩; মুসান্নাফে আবী শায়বা, হাদীস:৮৯৬৯) অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী হযরত আবু উমামা রা.বর্ণনা করেন,‘আমি বললাম, ইয়া রাসূলাুল্লাহ! আমাকে কোনো আমলের নির্দেশ দিন। তিনি বললেন তুমি রোযা রাখ। কেননা রোযার সমতুল্য কোন কিছইু নেই। আমি আবার বললাম ইয়া রাসূলাুল্লাহ! আমাকে কোনো আমলের নির্দেশ দিন। তিনিও পূণরায় সেই কথাই বললেন, তুমি রোযা রাখ। কেননা রোযার সমতুল্য কোন কিছুই নেই।’ মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে, আমি বললাম ইয়া রাসূলাুল্লাহ! আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বললেন ‘তুমি রোযা রাখ। কারণ রোযার সমকক্ষ কোনো কিছইু নেই। আমি দ্বিতীয়বার তাঁর নিকট এসে একই কথা বললে, তিনি বললেন, রোযা রাখ।’( মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:২২১৪৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীস:২৫৩০; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস: ১৮৯৩) অপর আরেক বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী সাহল ইবনে সাদ রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রোযাদারের জন্য জান্নাতে বিশেষ একটি দরজা আছে। যার নাম রাইয়ান। এই দরজা দিয়ে কেবলমাত্র রোযাদারই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। যখন সর্বশেষ রোযাদার ব্যক্তি তা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন সেই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। যে সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, সে জান্নাতের পানীয় পান করবে। আর যে সেই পানীয় পান করবে সে আর কখনও তৃর্ঞ্চাত হবে না।’ (সুনানে নাসায়ী :১/২৪১;১/১৫৯; বুখারী: ১/২৫৪) আবু হুরায়ারা রা এর. বর্ণনায় এসেছে,নবী কারীম সা. ইরশাদ করেন, রোযা হলো, জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভের ঢাল এবং সুরক্ষিত, সুদৃঢ় দূর্গ। (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হদীস: ৩৫৭১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৯২২৫) সাহাবী আবু হুরায়রার বর্ণনায় মহানবী সা. ইরশাদ করেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেক কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, কিন্তু রোযার বিষয়টি ভিন্ন। কারণ রোযা একমাত্র আমার জন্য। এর প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব। রোযাদার বান্দা কেবলমাত্র আমার জন্যই স্বীয় মনোবাসনা পরিত্যাগ করেছে এবং পানাহার বর্জন করেছে। (মুসলিম: ১/৩৬৩; ইবনে মাজা: ১১৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা: ৬/১০৪) রোযার এ সকল ফাযায়েল তখনই পাওয়া যাবে যখন রোযার আদবগুলোর প্রতি যথাযথ লক্ষ্য রেখে রোযা রাখা হবে। কারণ আদব বিহীন রোযা হয় প্রাণহীন। আর প্রাণহীন দেহের কোনোই মূল্য নেই। (চলবে)
লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন