শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আপনি রমযান কিভাবে কাটাবেন

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
[রোযার আদবগুলো হলো, * সাহরী ও ইফতারে হারাম খাবার পরিহার করা। * অপাত্রে তথা নাজায়িয বস্তু বা বিষয় দেখা থেকে বিরত থাকা। * যবানের যথাযথ হেফাযত করা। অর্থাৎ মিথ্যা, গিবত-শেকায়াত, চোগলখোরী, অশালীন কথাবার্তা ইত্যাদি থেকে স্বীয় জিহবাকে হেফাযত করা। * কানকে সর্ব প্রকার অন্যায় ও পাপের কথা শ্রবণ থেকে বিরত রাখা। * অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও যেমন হাত-পা ইত্যাদিকে সর্ব প্রকার গুনাহ ও অন্যায় কাজ-কর্ম থেকে হেফাযত করা। * যথা সম্ভব পানাহারে সংযমী হওয়া। * রোযা অবস্থায় অল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্বের কথা বেশি বেশি স্মরণ করা। * সর্বদা এই ভয়ে কম্পিত থাকা আমার রোযা আল্লাহর দরবারে কবূল হয় কি না? * রোযা কবূলের জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করা। * দুনিয়ার সকল বস্তু থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন থাকা।] ২. প্রতি রাতে তারাবীহের নামায আদায় করা। এটি রমযানের রাতের বিশেষ আমল। এ মাসের অবারিত খায়র-বরকত, রহমত-মাগফিরাত লাভের ও ঘোষিত প্রতিদান প্রাপ্তির জন্য তারাবীহের প্রভাব অপরিসীম। এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় তারাবীর নামায আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। [বুখারী:১/২২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা:৬/৯৮] অপর বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আউফ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন ,‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর ফরয করেছেন রমযান মসের রোযা আর আমি সুন্নাত করেছি তারাবীহর নামায। সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে এবং তারাবীহর নামায আদায় করবে, সে ঐ দিনের মত পবিত্র হয়ে যাবে, যেদিন সে মাতৃ উদর থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।’( সুনানে নাসাঈ: ১/২৩৯; মুসান্নাফে আবী শায়বা: ৫/২২৯-২৩০) ৩. হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত জিবরাঈল আ. রমযানুল মুবারকের প্রতি রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাক্ষাত করতেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে কুরআন মাজীদ শুনাতেন। [বুখারী, হাদীস:৬, ১৮৬৪] তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত রমযানে অধিক পরিমাণে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা। পূর্ববর্তী বুযুর্গদের জীবনী ঘাটলে পাওয়া যায় যে, তাঁরা নিজেরা এবং পরিবারের সদস্যগণ প্রতি রমযানে বহুবার কুরআন মাজীদ খতম করতেন। ৪. দান-খায়রাত সর্বাবস্থাতেই অনেক বড় আমল। রমযানুল মুবারকে তার গুরুত্ব ও মর্তবা আরও বেড়ে যায়। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন। রমযানুল মুবারকে তাঁর দানের হাত আরও প্রসারিত হতো। [বুখারী, হাদীস:৬, ১৮৬৪] ৫. সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইফতারের সময় রোযাদার যখন দুআ করে তখন তার দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। অর্থাৎ তার দুআ কবূল হয়। [ ইবনে মাজা, হাদীস: ১৭৫৩] সাহাবী আবূ হুরায়রার বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ১. ন্যায় পরায়ণ শাসকের দুআ। ২. রোযাদার ব্যক্তির দুআ ইফতারের সময় পর্যন্ত। ৩. মজলুমের দুআ। [আহমাদ, হাদীস: ৮০৪৩; তিরমিযী, হাদীস:৩৫৯৮; ইবনে মাজা, হাদীস:১৭৫২] বর্ণিত হাদীসগুলোর আলোকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, রমাযান মাসের দুআগুলো অবশ্যই কবূল হয়। তাই মাহে রমযানে অধিকহারে দুআ ও ইস্তিগফার করা উচিত। ৭. তাহাজ্জুদ নামাযের ফযীলতের কথা কম-বেশী সকলেরই জানা। রমযানে যেহেতু সাহরীতে উঠাই হয়, তাই একটু আগে উঠে কয়েক রাকআত তাহাজ্জুদ পড়া খুবই সহজ। এ দ্বারা সারা বছর তাহাজ্জুদের অভ্যাসও গড়ে উঠতে পারে। তাই এ ব্যাপারে সকলের যতœবান হওয়া উচিত। ৭. কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ [সূরা কদর] সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতে মশগুল থাকবে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। [বুখারী, হাদীস:২০১৪] বিভিন্ন হাদীস দ্বারা এ কথা প্রমণিত হয় যে, লাইলাতুল কদর পুরো রমাযানের যে কোনো রাতেই হতে পারে। তবে রমাযানের শেষ দশকে হওয়ার সম্ভবনাই প্রবল। তাই লাইলাতুল কদরের অপার ফযীলত লাভের নিমিত্তে পুরো রমযান একে তালাশ করতে থাকা উচিত। না পারলে অন্তত শেষ দশকে কোমর বেঁধে লাগবে এর অনুসন্ধানে। ৮. শবে কদর প্রাপ্তির সবচেয়ে সহজ ও উত্তম উপায় হলো, রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা। কারণ ইতিকাফকারী সর্বদাই আল্লাহর ধ্যান-খেয়াল ও ইবাদত-বন্দিগীতেই মাশগুল থাকেন। কাজেই তাঁর শবে কদর প্রাপ্তির বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। এ ছাড়াও ইতিকাফের অনেক ফযীলত রয়েছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-‘আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে [কাবা শরীফকে] পবিত্র কর তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’ (সূরা বাকারা/১২৫) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুই জন নেহায়াত বড় মাপের নবীকে বায়তুল্লাহ পুন:নিমার্ণের পর পরই ইতিকাফকারীদের জন্য তা পবিত্র করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর দ্বারাই মূলত ইতিকাফের গুরুত্ব ও মহত্ব আন্দায করা যায়। আরও আন্দায করা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল দ্বারা। তিনি মদীনায় আগমনের পর অন্য অনেক আমল মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দিলেও মৃত্য পর্যন্ত ইতিকাফের আমল কোনো সময় ছাড়েননি। আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্য পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফ করেছেন। এরপর তার পূণ্যবতী জীবন সঙ্গিনীগণও ইতিকাফ করেছেন। [বুখারী: হাদীস, ২০২৬; মসলিম: হাদীস, ১১৭২] সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ইতিকাফকারী সর্ব প্রকার পাপ হতে মুক্ত থাকে এবং অন্যরা বাইরে আমল করে যে নেকী লাভ করে সে ইতিকাফে থেকে বাইরের আমলগুলো না করেও সেই পরিমাণ নেকী লাভ করে। [ইবনে মাজা: ১৭৮১] অপর বর্ণনায় এসেছে, সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. মসজিদে নববীতে ইতিকাফ অবস্থায় ছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁকে সালাম দিয়ে চুপ করে বসে গেলন। তাকে দেখে ইবনে আব্বাস রা. বললেন, ব্যাপার কি? তোমাকে খুব বিষণ্ণ ও চিন্তাক্লিষ্ট মনে হচ্ছে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূলের চাচাতো ভাই! হাঁ, নিশ্চয় আমি চিন্তিত ও পেরেশান। কারণ জনৈক ব্যক্তির কাছে আমি ঋণী এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজার দিকে ইশারা করে বললেন, ঐ কবর ওয়ালার ইজ্জতের শপথ, সেই ঋণ আদায়ের সামর্থ আমার নেই। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস রা. বললেন, আমি কি তোমার জন্য তার কাছে সুপারিশ করব? লোকটি বললেন, আপনি যা ভালো মনে করেন। এ কথা শুনে ইবনে আব্বাস রা. তৎক্ষণাত জুতা পরে মসজিদের বাহিরে এলেন। এটি দেখে লোকটি বললেন, হযরত, আপনি হয়তো ইতিকাফের কথা ভুুলে গেছেন। তিনি বললেন, না; ভুলি নাই। (তখন তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছিল) বেশি দিনের কথা নয়, (মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওজার দিকে ইশারা করে বললেন) আমি এই কবরওয়ালার নিকট শুনেছি, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজ মুসলিম ভাইয়ের কোনো হাজত পুরণার্থে রওনা হয় এবং তাতে সে চেষ্টা করে, তা তার দশ বছর ইতিকাফ করার চেয়েও উত্তম হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ইতিকাফ করে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন, যার দূরত¦ আকাশ ও জমীনের মধ্যবর্তী স্থান হতেও বেশি। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী: ৩৬৭৯] একদিন ইতিকাফের এই পরিমাণ সওয়াব হলে দশ বছর ইতিকাফের কি পরিমাণ সওয়াব হবে? এক বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি রমযান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করবে, তার এই ইতিকাফ নেকী ও শ্রেষ্ঠত্বের বিবেচনায় দুটি হজ¦ ও দুটি ওমরার সমপর্যায়ের হবে। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৩৬৮০, ৩৬৮১] অন্য এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ইতিকাফকারী প্রতিদিন একটি করে হজে¦র সওয়াব পায়। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস: ৩৬৮২] ৯. প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য হলো সর্বদা গুনাহ মুক্ত থাকা। বিশেষ করে রমযানে এ ব্যাপারে বেশি যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ গুনাহ রোযার রুহকে নষ্ট করে দেয়। এ ছাড়া রমযানে আমলের ফযীলত ও প্রতিদান যেমন বেশি, গুনাহের ক্ষতি ও ভয়াবহতাও তেমন বেশি। ১০. সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, জান্নাতের দরজাগুলো এ মাসে খুলে দেওয়া হয় আর বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহান্নামের দরজাসমূহ এবং শয়তানদের বন্ধি করা হয় শিকলে। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৭১৮৪; সুনানে নাসায়ী:১/২৩০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস:৮৯৫৯] অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি রমযান মাসে একটি নফল আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে একটি ফরয আদায় করল। আর যে ব্যক্তি রমযান মাসে একটি ফরয আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরয আদায় করল। [শুআবুল ঈমান, বায়হাকী: ৩/৩০৫-৩০৬] তাই এই সুযোগে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদতের অভ্যাস গড়ে তোলা যায় সহজেই। কাজেই রমযানে অলস ও অনর্থক কাজে সময় ব্যয় না করে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদত করা উচিত। এভাবে পুরো রমযান মাস কাটানো গেলে আমাদের রমযান হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত ও জীবন্ত রমযান। লাভ করা যাবে মাহে রমযান সংক্রান্ত বর্ণিত সকল ফাযায়েল। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন