বাইক যখন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে থামল, তখন মধ্য দুপুর। নদে পানি নেই, মাছও নেই- মানুষজন বেকার। অলস সময় কাটানো মানুষ বাইকের আওয়াজ শুনেই জরো হতে শুরু করল। স্থানীয় এক সাংবাদিক পরিচয় করিয়ে দিতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ঢাকা থেকে ‘মস্তবড় সাংবাদিক’ এসেছেন খাতির যত্ন করতে হবে। শুরু হলো দৌড়ঝাঁপ। কেউ পান-সুপারির আয়োজনে দৌড়াচ্ছেন, কেউ চা-নাস্তার জন্য দূরের রানীগঞ্জ হাটে ছুটলেন। ‘চা-পান খাব না’ আপনারা আসেন কথা বলি, অতিথির মুখে শুনেও খ্যান্ত দেন না। এক দিকে চলছে, অতিথি আপ্যায়নের প্রস্তুতি; অন্যদিকে ‘ঢাকার মস্তবড় সাংবাদিক’ এর সঙ্গে আলোচনায় মেতে উঠলেন গ্রামের মানুষজন। বেশিরভাগ মানুষের গায়ে কাপড় নেই। ন্যাংটো ছেলের দল, নদের পানিতে লাফালাফি করছে। নদের পাড়ের কাচকোল গ্রামের মো. জরমাল হোসেনের পুত্র রানীগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার মো: আবদুল জলিল ব্রহ্মপুত্র নদের ইতিবৃত্ত শোনাতে শুরু করলেন। বললেন, নদে পানি না থাকায় মাছ ধরা বন্ধ, কষ্টে আছি। তার চেয়েও বেশি কষ্ট- আমাদের অভাবের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু এনজিও ঋণ দিয়ে বউ-ঝিকে কাজে নামাচ্ছে। মুসলমান হয়ে বউ-ঝিদের মাঠে কাজ করা, মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। প্রতিবাদ করার উপায় নেই; এনজিও এতো শক্তিশালী যে আপনি বিরোধিতা করলে প্রশাসনকে ব্যবহার করে আপনাকে হেনস্তা করবে। এমন অনেক ঘটনা ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ঘটেছে।
আগতদের মধ্যে পূর্ব-ভাটিয়াপাড়া গ্রামের মো. আজিরউদ্দিন চলাফেরা করতে পারেন না। তিন পুত্র সকলেই কর্মক্ষম। কিন্তু নদে পানি না থাকায় সকলেই বেকার বসে আছেন। প্রায় দিনই উপোস থাকতে হয়। বললেন, নদে পানি না থাকায় মাছ নেই; সবাই ঘরে বসে। এ সময় কিছু এনজিও মেয়েদের ঋণ দিচ্ছে জোর করে। যারা ঋণ নিচ্ছেন তারা সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। একদিনে নদে পানি নেই, মাছ নেই; মানুষ কষ্টে রয়েছে; অন্যদিকে এনজিও গরিবের উপকার করার কথা বলে ঋণ দিয়ে যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিচ্ছে। জুতামারি গ্রামের মো: তৌহিদ বললেন, নদে পানি নেই, মাছও নেই। কিন্তু এনজিওগুলো গরিব ঘরের মেয়েদের ফুঁসলিয়ে ঋণ দিয়ে গোটা পরিবারকে বিপাকে ফেলছে। গ্রামের মেয়েদের বেপর্দা করছে। নদীতে মাছ না থাকলে আগে মেয়েরা ঘরে না খেয়ে থাকত; এখন এনজিওর ঋণের সাপ্তাহিক কিস্তি দেয়ার জন্য মেয়েদের জমিতে কাজ করতে হচ্ছে। ঘরের বউ-ঝি মাঠে কাজ করলে পরিবারে কি শান্তি থাকে?
ততক্ষণে কুড়িগ্রামে চিলমারীর বেগমগঞ্জ, সাহেবের আলগা, বড়চর গ্রামের শত শত মানুষ আসতে শুরু করেছে। আবদুল জলিল বললেন, এই নদের সঙ্গে হাজার হাজার পরিবার জীবন-জীবিকা জড়িত। নদে পানি থাকলে মানুষ মাছ ধরেন; এখন পানি শুকিয়ে গেছে; মানুষ বেকার হয়ে ঘরে বসে রয়েছেন। দু’চারজন পেশা বদল করে বাদাম বিক্রি, রিক্সাচালক, শহরে গিয়ে কুলিগিরি করছেন; কিন্তু সবার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। সড়কটারী বাঁধের রাস্তায় বসবাস করেন আ: গফুরের ছেলে মো: দেলদার হোসেন। বললেন, ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে অন্য নদীর মিল পাবেন না। এই নদ প্রশস্তে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ। বন্যায় ৬ থেকে ৮ কিলোমিটার নদীর প্রশস্ত হয়। যখন দুই থেকে তিন কিলোমিটার প্রশস্ত তখনো মাছ ধরা যায়। বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। এখন পানি একেবারে শুকিয়ে গেছে। সামনে চিলমারী, রমনা গেলে বুঝবেন নদে চর জেগে উঠায় পানি কয়েকভাবে ভাগ হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এমন হলে কী মাছ পাওয়া যায়? মাছ ধরা জেলেদের নৌকা মাসের পর মাস বাঁধা থাকে।
ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ঘেঁষে উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা, দইখাওয়া, মাঝের আলগা, জাহাজের আলগা, চর দুর্গাপুর, চিলমারি উপজেলার প্যারারচর, বনগ্রাম, বাহাত্তুরচর, হাতিয়া, নাইসচর, বড়বাগ, ফেইসকারচর, দুইশগ্রাম, উত্তর খেউরিয়াচর ঘুরে দিনভর মানুষের সঙ্গে কথা বলি। সবার এক কথা ব্রহ্মপুত্র নদ ‘আল্লাহর দান’। তবে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মানুষ কষ্টে আছে। নদে পানি না থাকায় অনেকেই গরুর বাথান, মহিশের বাথান করেছেন; যাদের টাকা রয়েছে তারা নৌকা কিনে বালুর ব্যবসা করছেন; কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় প্রান্তিক জেলেরা খুবই কষ্টে রয়েছেন। তবে চরের গরিব মানুষের অভাব-অনটনকে পুঁজি করে কিছু এনজিও চরাঞ্চলে চুটিয়ে ব্যবসা করছে। নদের পাড়ের বক্তব্য ২০০৮ সালের পর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন কমে গেছে। উত্তরের বুড়গিরহাট থেকে চিলমারী পর্যন্ত নদী শাসন করা হয়েছে। সরকার নদে বøক ফেলে এবং নদ শাসন করে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু নদে পানি না থাকায় মানুষ নিদারুণ কষ্টে রয়েছে। চিলমারির গোয়ালেরচর, পাত্রখাতা, বড়ভিটা, হাঁসেরভিটা, জুতারমারি, কেল্লাবাড়ি, নয়াগ্রাম, তেলিপাড় ঘুরে বাইচর গ্রামে কথা হয় কয়েকজন মানুষের সঙ্গে। তারা জানালেন, নদে পানি না থাকায় জেলেরা নিদারুণ কষ্টে রয়েছেন। তবে যারা প্রভাবশালী তারা গরু-মহিষ প্রতিপালন করছেন। বড়ভিটা গ্রামে প্রায় দুইশ’ পরিবার। প্রতিটি পরিবারে গরু-মহিষ প্রতিপালন করা হয়। কেউ কেউ ছাগল-ভেড়া প্রতিপালন করে থাকেন। তবে এনজিওগুলো মেয়েদের ঋণ দিয়ে সংসার তছনছ করে দিচ্ছে। বড়ভিটা গ্রামের সুশীল দাসের স্ত্রী সন্ধ্যা রানী দাস বললেন, আমাদের চৌদ্দগোষ্ঠী মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। এখন গরু-মহিষ প্রতিপালন করছেন। তবে নদের পাড়ের অনেক মানুষ কৃষিকাজ করেন। তবে এক সময় এই নদে ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। আধা মণ এক মণ ওজনের বোয়াল, রুই, কাতলা, মৃগেল পাওয়া যেত। এখন পানি না থাকায় ছোট মাছও পাওয়া যায় না।
নদের পাড়ের মানুষ জানালেন, ব্রহ্মপুত্র নদ পৃথিবীর দীর্ঘতম নদ-নদীগুলোর একটি। এ নদ চীন (তিব্বত), ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। উৎপত্তি শিমায়াঙ-দাঙ হিমবাহ থেকে; যা পারখা থেকে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটারের মতো দূরে। পারখা, মানস সরোবর হ্রদ ও কৈলাস পর্বতের মধ্যবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ তিব্বতের শুষ্ক ও সমতল অঞ্চলের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে নদটি হিমালয়ের ‘নামছা বারওয়া’ চ‚ড়ার সন্নিকটে বাধা পায়। আসাম থেকে বাংলাদেশে সমভ‚মিতে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদ নামে পরিচিত। আসামের সমভ‚মিতে ব্রহ্মপুত্র একটি বিশাল নদ। বাংলাদেশে এর প্রবাহ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। কুড়িগ্রাম থেকে ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ প‚র্বাভিমুখে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদটির প্রভাবিত এলাকার আয়তন ৫,৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটার, যার ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের অবস্থান বাংলাদেশে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীটি বিনুনি ধরনের।
ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরের গ্রাম উত্তরখামার, নতুনগ্রাম, দক্ষিণখামার, সড়কটারী বাঁধ, পূর্বভাটিয়াপাড়া গ্রামের মানুষ কিছুটা আর্থিকভাবে সচ্ছল। যারা গরিব সেই প্রান্তিক মানুষের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব নেই। বড়ভিটা গ্রামের মো. রহিমুদ্দিনের পেশা মাছ ধরা। নদে পানিপ্রবাহ না থাকায় মাইলের পর মাইল চর পড়ে গেছে। নদে পানি ও মাছ না থাকায় এক ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টস চাকরি নিয়েছে। বললেন, নদে পানি নেই, মাছ নেই; সে কষ্ট সহ্য করছি। কিন্তু মেয়েদের স্বাবলম্বী করার নামে এনজিওর ঋণ দিয়ে বউ-ঝিদের ঘর থেকে বের করছে, তার বিচার কে করবে? ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে এটা মেনে নেয়া যায় না।
স্থানীয় সাংবাদিক দিনভর ঘুরেছি। এর মধ্যে রমনায় দেখা হলো ইনকিলাবের চিলমারী উপজেলা সংবাদদাতা মো: ফয়সাল হকের সঙ্গে। আমাদের জন্য সে কয়েক ঘণ্টা ধরে রমনাবাজারে অপেক্ষা করছেন। তিনি নিয়ে গেলেন জাহাজ আলগারচর। সেখানে বিভিন্নজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। চরের মানুষের বক্তব্য হলো ব্রহ্মপুত্র নদে পানি না থাকায় জেলেরা পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। মানুষ কষ্টে রয়েছে। কিন্তু অভাবের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন এনজিও ( গণশিক্ষা, উদ্দীপন, এসো দেশ গড়ি সংঘ প্রকল্প, আহা প্রকল্প) উপকারের নামে নারীদের ঘর থেকে বের করে বেআব্রু করছে; এটা ঠেকাবে কে? মুসলমান হয়ে বউ-ঝিদের চোখের সামনে বেআব্রæ দেখব, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়; কিন্তু দেখতে হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন