দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি নির্মাণের পর থেকেই এর নকশার ত্রুটিসহ নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উঠছে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই মহাসড়কটি যথাযথভাবে নির্মিত হয়নি। ফলে সড়কের বিভিন্ন অংশে খানাখন্দক সৃষ্টি হয়ে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সংস্কারও করা হচ্ছে ভাাঙ্গাচোরা সড়কাংশ। কিন্তু টেকসই হচ্ছে না। সড়কের যাত্রাবাড়ি আট লেন অংশে এমন সংস্কারের মাস দুয়েকের মাথায় আবার যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে। নিয়ম অনুযায়ী, মোটা পাথরের প্রলেপের উপর কুচি পাথরের প্রলেপ দিয়ে ফিনিশিং করতে হয়। সেটা করা হয়নি। মোটা পাথরগুলো এখন কোথাও উঁচু কোথাও নিচু হয়ে মহাসড়কটি অসমান হয়ে আছে। এর উপর দিয়েই চলাচল করছে যানবাহন। লকডাউনে মহাসড়কে যান চলাচল কম থাকায় এর বেহাল দশা ফুটে উঠেছে। ১৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের গুরুত্বপূর্ণ চার লেনের মহাসড়কটি এরই মধ্যে ভঙ্গুর দশায় পতিত হয়েছে। সক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত গাড়ি ও ওজন নিয়ে চলার কারণে মহাসড়কটিতে সৃষ্টি হয়েছে রাটিং (রাস্তা দেবে যাওয়া বা ফুলে যাওয়া)। বাইন্ডার্স কোর্স ও বিটুমিন কার্পেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেগুলো সংস্কারে সওজ অধিদপ্তরের মোটা অংকের টাকা ব্যয় হচ্ছে। সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার লেনের মহাসড়কটিতে প্রকৌশল ও নকশাগত ত্রুটির কারণে শুধু স্থায়িত্ব কমছে না, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।
যেকোনো সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের সময় এর যথাযথ নকশা প্রণয়ন থেকে শুরু করে এর স্থায়িত্বকাল নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি এর উপর দিয়ে কী পরিমাণ এবং সর্বোচ্চ কত ওজনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে তার হিসাব করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নির্মাণের সময় এসব হিসাব করা হলেও তার যথার্থতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মহাসড়কটি নির্মাণের পরপরই এর বিভিন্ন অংশে নির্মাণ ত্রুটি দেখা দেয়। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করার ফলে নির্মাণের কিছু দিনের মধ্যেই ভেঙ্গেচুরে যায়। কোথাও কোথাও রাটিং বা উঁচু-নিচু হয়ে ঢেউয়ের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়ক নির্মাণে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা। তবে নকশায় ত্রুটি, নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার এবং ওভারলোডিং নিয়ন্ত্রণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিনিয়ত খরচ বেড়ে চলেছে। এ খরচ কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কেউ বলতে পারে না। তবে আমাদের দেশে যেকোনো প্রকল্প মানেই একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের স্থায়ী ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হওয়া। রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে নানাভাবে অর্থ ব্যয়ের উছিলায় তারা নিজেদের পকেট ভারি করে।
আমাদের দেশে প্রতি কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়। মহাসড়কে গড়ে কিলোমিটার প্রতি খরচ হয় প্রায় পনের কোটি টাকা। ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশি ব্যয় হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যে, কিলোমিটার প্রতি সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে, তা আন্দাজ করতে সমস্যা হয় না। অথচ, দেশের প্রধানতম এ মহাসড়ক নির্মাণ নিয়ে নানা অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা শুরু থেকেই শোনা যাচ্ছে। যেকোনো সড়ক নির্মাণের আগেই এর প্রাথমিক স্থায়িত্বকাল থেকে শুরু করে এর মেয়াদ কত হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে করতে হবে, তার বিশদ পরিকল্পনা আগে থেকেই করা হয়ে থাকে। দেখা যায়, আমাদের দেশে সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে সবচেয়ে বেশি খরচ হলেও উল্লেখিত বিষয়গুলো মানা হয় না বললেই চলে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কটি যেন অনেকটা অবহেলা ও অযত্নের মধ্য দিয়ে চলছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, লকডাউনের এ সময়ে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কম থাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেসব সমস্যা রয়েছে, তা মেরামতের একটি ভালো সুযোগ ছিল। এ সুযোগে মহাসড়কটির ত্রুটি-বিচ্যুতি সারিয়ে তোলা যেত। এ কাজটি কেন করা হলো না, সংস্কারের সুযোগটি কেন গ্রহণ করা হলো না, এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নিয়মিত সংস্কার ও উপযুক্ত তত্ত¡াবধান ছাড়া এই মহাসড়কের স্বাভাবিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এজন্য সংস্কারকাজ যাতে সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে হয়, টেকসই হয় তার প্রতি যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আশা করবো, যত দ্রুত সম্ভব মহাসড়কটির মেরামত ও সংস্কারে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন