আবদুল আউয়াল ঠাকুর
বছর ঘুরে পবিত্র ঈদুল আজহা আবার আমাদের দ্বারপ্রান্তে। যথারীতি আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব পালিত হবে। সময় পেরিয়ে গেলে আমরা ডুবে যাব নিত্যদিনের কাজে। ব্যাপারটি যেন একেবারেই নিয়মনীতি বা এক ধরনের গদবাধা বিধি-ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। অথচ প্রকৃত বিষয় তা নয়। ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদে রয়েছে মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি গভীর ভালোবাসার নিদর্শন। এখানে পশু কেবল প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এই প্রতীক ধারণার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয় কে কতটা তাঁর নৈকট্যলাভের চেষ্টায় মশগুল। প্রত্যেক মুসলমানেরই এটা জানা যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই কোরবানি দেয়া হয় অর্থাৎ পশু কোরবানি করা হয়। কোরবানির পশুর রক্ত মাংস কিছুই তাঁর কাছে পৌঁছায় না বরং পৌঁছায় নিয়ত। আর সে কারণেই কোরবানির পশুর গায়ের লোমের সমপরিমাণ গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। এটি তাঁর অত্যন্ত করুণা ও মহানুভবতা। তিনি অনুগ্রহ করে একটি মাধ্যমকে কেন্দ্র করে মোমিনের গুনাহ মাফ করেন। সুতরাং এই মাফের সাথে কোরবানি কবুল হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কিত। এই কবুলের সাথেই রয়েছে ¯্রষ্টা তথা আমাদের মালিকের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কতটা তীব্র তার প্রমাণ রাখা। এখানে কোন পশু কত দামি তা বড় কথা নয় বরং কোন নিয়ত কতটা খাঁটি এবং কার উপার্জন কতটা হালাল তা-ই বড় কথা। এখানে এ কথাও উল্লেখ করা দরকার, ভালোবাসা হতে হয় নিখাদ। কালিমা থাকলে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে সে ভালোবাসা ভালোবাসা নয় বরং তা হচ্ছে কপটতা। যাকে ইসলামের পরিভাষায় বলা যায় মোনাফিকতা। মিথ্যাচার। আজকের দুনিয়াতে বিশ্ববাস্তবতাতে সে কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, কোরবানি কার নিয়তে, কার উদ্দেশ্যে দেয়া হচ্ছে? আমরা কাকে খুশি করতে চাচ্ছি?
ঈদুল আজহা আমাদের জাতীয় উৎসবের অন্যতম একটি। বছরে দুটি ঈদের মধ্যে এই ঈদের তাৎপর্য খানিকটা ব্যতিক্রমী। প্রধানত এই ঈদকে কেন্দ্র করে পোশাক-আশাক কেনাকাটার বাইরেও কোরবানির পশু নিয়ে অন্য রকম ব্যস্ততা থাকে। এ বছর এ আলোচনার বাইরেও সারা দেশে জঙ্গি আলোচনা বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। যদিও এ কথা নতুন করে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই যে, প্রকৃত বিবেচনায় অশুরীয় শক্তি তথা একাত্মবাদবিরোধী শক্তি দমনের অঙ্গীকার নিয়েই প্রতিবছর পালিত হয় ঈদুল আজহা। আনুষ্ঠানিকতাতে পশু জবাই থাকলেও ভেতরের চেতনা হচ্ছে মনের পশুকে কোরবানি দেয়া। এবার এই ঈদকে সামনে রেখে একদিকে যেমনি মনের পশুর আলোচনা স্থান করে নিয়েছে তেমনি উঠে এসেছে কোরবানির পশুর আলোচনাও। এ কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই যে, মানব সমাজের প্রাথমিক স্তর থেকেই সমাজে কোরবানির প্রচলন ছিল। সে সময়ের কোরবানি আর এখনকার কোরবানির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। একসময়ে কোরবানি কবুল হলো কিনা তা প্রত্যক্ষ করা যেত। এখন সেভাবে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় না। আধুনিককালে যে কোরবানির নিয়ম ও পদ্ধতি চালু রয়েছে সেটি মূলত হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সময় থেকে প্রবর্তিত। এর মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তার বিধানের প্রতি মানুষ অনুগত কিনা সেটি প্রমাণ করাই প্রধান উদ্দেশ্য। কোরবানির পুরো ধারণার সাথেই মনুষ্যত্বের বিকাশের সম্পর্ক রয়েছে। এই ত্যাগের অন্য কোনো উদাহরণ পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে এই মাসে অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র হজ। এটিও সেই আদিকাল থেকে প্রচলিত। আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে পবিত্র গৃহের তাওয়াফের কথা ঘোষণা করতে বলেছিলেন। তিনি তা-ই করেছেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এই ঘোষণা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। আর এই পবিত্রগৃহ তাওয়াফের মাধ্যমে কেবল গুনাহ মাপেরই ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
কোরবানিদাতাদের প্রধান বিবেচ্য সামর্থ্যরে মধ্যে সুন্দর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী পশু পাওয়া। এ নিয়ে একসময়ে সাধারণের মধ্যে কোনো ভাবনা না থাকলেও এখন এটিই যেন প্রধান ভাবনায় পরিণত হয়েছে। দেখা যায় কখনো বাজারে কোরবানির পশুর ক্রেতা নেই আবার কখনো দেখা যায় ক্রেতা আছে পশু নেই। এর কারণ নানাবিধ। বাস্তবতা হচ্ছে, কোরবানির পশু নিয়ে এক সময়কার বাস্তবতায় পরিবর্তন ঘটেছে যেসব কারণে তা যেমনি খতিয়ে দেখা দরকার তেমনি তদস্থলে যেসব বিষয় স্থান করে নিয়েছে তার সাথে কোরবানির চেতনাকে মিলিয়ে দেখা দরকার। বোধকরি লিখে বা বলে বুঝানোর দরকার নেই যে অনন্তকাল থেকেই দেশি গবাদিপশুতেই দেশের কোরবানির চাহিদা পূরণ হয়েছে। দেশের এসব পশুর চামড়াকেও উন্নতমানের বলা হতো। এটা অনেকেরই জানা কোরবানির পশু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একসময় গ্রামের কৃষকরা প্রতিপালন করতেন। তারাই বাছাই করে রাখতেন এর মান। এখন সে চিত্রে পরিবর্তন হয়েছে। কারণ দেশে কার্যত পশু পালনের কোনো বিচরণ ভূমি নেই বললেই চলে। এর কারণ প্রধানত কৃষিতে আধুনিকায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এখন পশুর প্রাকৃতিক খাদ্য ঘাসের মারাত্মক অভাব দেখা দিয়েছে। বিচরণ ক্ষেত্রের চেয়েও বড় সংকট হচ্ছে ধানের কুটা ও কুড়ার অভাব। সেই সাথে প্রতিপালনের জন্য স্থান ও নিরাপত্তার অভাব। এসব কারণে গ্রামেগঞ্জে এখন আর আগের মতো বলতে গেলে সেই প্রাকৃতিক উপায়ে গরু পালন করা হচ্ছে না। এই জায়গা দখল করে নিয়েছে কৃত্রিমভাবে লালন-পালন। এ জন্য মূলত অর্থনৈতিক বাস্তবতা স্থান করে নিয়েছে। কোরবানির আলোচনায় গত বছর থেকে নতুন প্রসঙ্গ স্থান করে নিয়েছে। দেশে গরু উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার প্রেক্ষিতে হয়তো কোনো মহল এটা ধরে নিয়েছিল বৈধ আমদানির সাথে রাতের অন্ধকারে ভারতীয় চোরাই গরু প্রবেশ করিয়ে কোরবানির বাজার ঠিক রাখায় কোনো অসুবিধা নেই। এর দুনিয়াবি দিকটি বাদ দিলে এটা সত্যই ভাববার রয়েছে, কোরবানির মতো এত বড় ত্যাগের উপকরণ কি সরকারিভাবে বা সমর্থনে চোরাই পশুনির্ভর হতে দেয়া সঙ্গত? অনেক দিন থেকেই এ আলোচনা ছিল। বাস্তবত যাই বলা হোক না কেন চোরাই গরুর প্রসঙ্গ ছিল ওপেনসিক্রেট। সে কারণেই এর কোনো সুরাহা হওয়ার উপায় ছিল না। গত বছর বিষয়টি অন্যভাবে চলে আসে আমাদের দেশে। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের শুরুতে হঠাৎ করে বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত। এমনকি গরু চোরাচালান রোধে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সীমান্তের কাঁটাতারে বেড়া ও গরু আসার কড়িডোরগুলোতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কঠোর নজরদারি করতে থাকে। ফলে ভারত থেকে গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কার্যত প্রতিবছর ভারত থেকে যেখানে দেশের বাজারে ২০-২৫ লাখ গরু আসত কমে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় দাঁড়ায়। সেই প্রেক্ষিতে নতুন ইতিবাচক ভাবনা ও বিবেচনা স্থান করে নেয়। ভারতীয় এই একরোখামি অত্যন্ত সহজ ও সাবালীলভাবে মোকাবিলা করেছে এদেশের খামারি তথা কৃষকরা। দেখা গেছে কোরবানির পশুর কোনো সমস্যা হয়নি। উপরন্তু ভারতের যেসব খামারি বাংলাদেশে গরু রফতানি অথবা চোরাচালানি করবে বলে সীমান্তের কাছে জড়ো করেছিল তারা সে গরুগুলো ফিরিয়ে না নিয়ে সেখানেই মেরে ফেলেছে। সেই বাস্তবায় এবার দেশে গত এক বছরে গবাদিপশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার। খামারি, চামড়া ও গোশত ব্যবসায়ী সমিতি এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রতিবছর কোরবানির চাহিদার চেয়ে এ বছর উৎপাদন বেড়েছে অনেক। ফলে কোরবানির পশুর কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক খবর। তবে কোরবানির চেতনার সাথে সাংঘর্ষিতা বোধকরি অন্যত্র। সে বিবেচনায় দেখার অবকাশ রয়েছে সুদের বিষয়টি। সে আলোচনায় আসার আগে দ্বিতীয় গুরুতর বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে নিষিদ্ধ স্টেরয়েড জাতীয় রাসায়নিক ও বিভিন্ন ইনজেকশন ব্যবহার করছে একশ্রেণির অসাধু ডেইরি ফার্মের মালিক তথা গরু খামারিরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব স্টেরয়েড ও হরমোনসমৃদ্ধ মাংস খেলে মানুষের কিডনি লিভার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ক্যান্সারও হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিক রোগীদের মৃত্যুও হতে পারে। এদিকে জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় কোরবানির গরু মোটাতাজাকরণে বিভিন্ন ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহারের পদ্ধতি বন্ধে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন।
কোরবানির পশু প্রাপ্তি তথা দেশি পশু পাওয়ার ইতিবাচক খবরের পেছনের খবর হচ্ছে, এ বছর গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকার একটি পূর্ণচক্রায়ন তহবিল তৈরি করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে খামারিদের ৫ শতাংশ সুদে মোট ৬৫ কোটি টাকার গবাদিপশু ঋণ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে কম সুদে ঋণ গবাদিপশু লালন-পালনের পরিমাণ বাড়িয়েছে। বিষয়টি নতুন নয়, তবে এবার এই আলোচনা নতুন মাত্রিকতা নিয়েছে। এর আগে কোরবানির পশু প্রসঙ্গে চোরাকারবারির যে আলোচনা করা হয়েছে বোধকরি কোরবানির চেতনার বিবেচনায় আলোচ্য সুদের বিষয়টিকেও সহজভাবে নেয়ার কোনো সুযাগ নেই। নিয়মানুযায়ী যিনি বা যারা কোরবানি দেবেন তাদের ক্ষেত্রে চোরাই গরু, সুদের টাকায় প্রতিপালিত বা বিনা সুদের টাকায় প্রতিপালিত গরুতে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ সে বাজার থেকে টাকা দিয়ে কিনে কোরবানি দিচ্ছে। তার জন্য প্রয়োজনীয় হচ্ছে তার টাকা হালাল কিনা? সে যাইহোক বর্তমান সময়ে কোরবানি নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। অনেকে এটাকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করছেন। অনেকেই কোরবানির বেশ কদিন আগে থেকেই বাড়ির সদরে গরু লটকিয়ে রাখেন, যাতে লোকজন গরুর দাম দেখে মালিকের দাম বোঝার চেষ্টা করে। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক কোরবানির কথাও সমাজে প্রচলিত রয়েছে। ভোট রক্ষায় দলীয় নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখার নিমিত্তেও কোরবানির আয়োজন করা হচ্ছে। সেসব প্রসঙ্গ ভিন্ন। যে কথা বলছিলাম তা হচ্ছে, সুদের টাকায় কোরবানির পশুর প্রতিপালনের বিষয়টি। এখানে ব্যাংকের যে প্রসঙ্গ রয়েছে তারও নানামাত্রিক আলোচনা রয়েছে। সাধারণভাবে ব্যাংকগুলো যাই বলুক প্রকৃত বিবেচনায় দেশে প্রচ- বিনিয়োগ সংকট রয়েছে। এ বিবেচনায় কোরবানির পশু প্রতিপালনের বিনিয়োগকে ইতিবাচকতায় দেখাই স্বাভাবিক। সুদে আসলে এ টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আরো একটি আলোচনা এখানে রয়েছে। প্রকাশ্যত না বললেও দেশের সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ক্রমাগত ঋণ নেয়ার কারণে সেগুলো অনেক আগেই দেউলিয়া হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক থেকে নানা উসিলায় টাকা সংগ্রহের যে অপ্রদর্শিত নিয়ম রয়েছে সেক্ষেত্রে তারা আয় তথা লাভ করতে না পারলে দেবে কোত্থেকে? ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে এ ধরনের ঋণের কোনো বিকল্প নেই। সে বিবেচনায় কোরবানির পশুর জন্য ঋণকে অবশ্যই ব্যাংকগুলোর ইতিবাচকতায় দেখার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে সুদ। এখন ভাবা দরকার সুদবিহীন কোনো পদ্ধতি পাওয়া যায় কিনা। গবাদিপশু বিশেষ করে কোরবানির পশু প্রতিপালনে সরকার ভর্তুকি দিতে পারে। লাভ-ক্ষতিকে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। আগে যেভাবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গবাদিপশু প্রতিপালিত হতো সেটিকে নার্সিং করা যায় কিনা সেটিও ভেবে দেখা যায়। যেহেতু বিষয়টি কৃষির সাথে সম্পর্কিত তাই সেক্ষেত্রে করণীয় কিছু রয়েছে কিনা সেটাও দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা ভেবে দেখতে পারেন। এ কথা বলার মূল কারণ হচ্ছে, সুদকে বলা হয় শোষণের হাতিয়ার। সুদ ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে জেনেশুনে নিষিদ্ধ টাকায় প্রতিপালিত পণ্যকে ধর্মের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত করা হচ্ছে। এর ফলে কোরবানির প্রকৃতসুফল কতটা পাওয়া যাবে বা সম্ভব এ প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। অপরিহার্যতা বাস্তবতা সময়ের সাথে তালমিলিয়ে এর কতটা কী করা যায় সেটা নিয়ে সকলেরই ইতিবাচক ভাবনা জরুরি।
কোরবানির মূল চেতনা হচ্ছে ভেতরের পশুকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটা ব্যাখ্যা করার হয়তো কোনো প্রয়োজন নেই যে, জেনে হোক না জেনে হোক আমাদের প্রশ্রয়েই বেড়ে ওঠে ভেতরের পশু, যে কিনা মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রতারিত করছে। সরিয়ে দিচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য ও ভালোবাসা থেকে। সাধারণ অর্থে যাকে দুনিয়াবি বলা হয়। ভোগাকাক্সক্ষাই হচ্ছে এর প্রধান শনাক্তকারী চিহ্ন। আজকের দুনিয়াতে যে মাত্রাতিরিক্ত সামাজিক নৈরাজ্য এর পেছনে প্রকৃত বিবেচনায় কাজ করছে ভোগাকাক্সক্ষা। যে কোনো বিবেচনাতেই বলা যাবে সমাজ মনুষ্য বসতির অযোগ্য হয়ে পড়েছে। চারদিকে হানাহানি, ব্যভিচার দুর্নীতি অনাচার যেন স্থায়ী বাসা বেঁধে রয়েছে। অথচ প্রতিবছরই আমরা লাখ লাখ পশু কোরবানি করছি। অবশ্যই ভাববার রয়েছে, কেবলই কি পশু কোরবানি করছি নাকি মনের পশুকে কোরবানি করে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন ও তাঁর নৈকট্য লাভেরও কোনো চেষ্টা-ফিকির করছি। এর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে প্রকৃত বিষয়। সমাজের বাস্তবতা দেখে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, যেভাবেই বলা যাক না কেন এ কথাই সত্যি যে, আনুষ্ঠানিকতা এবং কেবল নিয়ম পালন ছাড়া আর কিছুই হয়তো আমরা করছি না। কোরবানির মতো একটি ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদতকে আমরা পরিণত করেছি বাণিজ্যিক মাধ্যমে। কেবল টাকা উপার্জন ও লুটপাটের নিমিত্তে। এটা যে কোনো বিবেচনাতেই দুখঃজনক। ভেতরগত চেতনায় সমর্পিত না হতে পারলে কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা থেকে গোটা জাতির যে উপকার পাওয়া অর্থাৎ আল্লাহর রহমতপ্রাপ্তির আশা খুবই কম।
ভালোবাসা হচ্ছে মনের এক গোপন দলিল। যা কার্যত দুই পক্ষ ছাড়া অন্য কারো জানা থাকার কথা নয়। আল্লাহর পাগলেরা হজে যান। সেখানে গিয়ে আল্লাহতে সমর্পিত হন। মাফ চান। আল্লাহ মাফের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) এই ঘোষণার কথা জানিয়েছেন। কোরবানির মধ্যে রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা। যারা আল্লাহরগত প্রাণ, যাদের চিন্তা-চেতনা মেধামননে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসাই একমাত্র আকাক্সক্ষা আল্লাহ তাদের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। কোরবানি কবুল হওয়ার মধ্য দিয়ে সে ঘোষণাই দেয়া হয়। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের কোরবানির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হোক আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। আল্লাহ আমাদের সকলকে কবুল করুনÑ এটাই কামনা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন