বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মালয়েশিয়ায় সাতদিন

প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উবায়দুর রহমান খান নদভী
অভাবনীয়ভাবেই ১০ আগস্ট ২০১৬ রওনা হয়েছিলাম কুয়ালালামপুর। তিনদিন আগে সম্মেলনের দাওয়াত পেলাম। বিশ্বের পাঁচ শতাধিক ডেলিগেটকে দাওয়াত করা হয়েছে মালয়েশিয়ার রাজধানীতে ইসলামপ্রচারক সূফী, দরবেশ ও উলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে। ইসলাম নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান, অপপ্রচার প্রতিরোধ, উগ্রবাদী ব্যাখ্যা দূরীকরণ এবং ঐতিহ্যবাহী কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়ন নিয়ে। সারা দুনিয়ার এত স্কলার ছুটে আসছেন শুনে মনটা ভরে ওঠে। তিনদিনের ভেতর ভিসা টিকিট ঠিকঠাক করে আমার হাতে তুলে দেন সম্মেলনের আয়োজক প্রতিষ্ঠানের লোকেরা। আমি ছিলাম অসুস্থ। ম্যাক্সিলোফেসিয়াল একটি অস্ত্রোপচারে যেতে হবে। টেস্টগুলো সারছিলাম। পেইন কিলার দিয়ে ব্যথা চেপে রেখেছি। নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক চলছে। অতীতের মতো টালবাহানা না করে চিকিৎসা সম্পন্ন করার কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন সম্পাদক মহোদয়। এরমধ্যে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাদ রেখে আমাকে যেতে হলো এয়ারপোর্ট। সম্মেলনকে গুরুত্ব দিয়ে মাননীয় সম্পাদক আমাকে মালয়েশিয়া ঘুরে আসার অনুমতি দিলেন। আল্লাহর রহমতে আমি সেখানে ভালো ছিলাম, প্রথমে লিকুইড খাওয়া শুরু করলেও দুইদিন পর থেকে শক্ত খাবার নিতে পেরেছি এবং এখন দেশে ফিরেও অনেকটাই সুস্থবোধ করছি। এখন আবার রওয়ানা হচ্ছি হজের উদ্দেশে। একান্তে আল্লাহকে ডাকার এই তো সুযোগ। চিকিৎসায় যাওয়ার আগে কিছুটা সময়ও পাওয়া গেল।
রাত এগারোটায় প্লেন ছেড়ে পৌঁছুলো প্রায় চার ঘণ্টা পর। যখন নামলাম তখন কুয়ালালামপুর ফজরের পর। এয়ারপোর্টের ভেতর নামাজ পড়লাম। বাইরে সম্মেলনের ফেস্টুন হাতে অভ্যর্থনাকারীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাকে তারা রিসিভ করলেন। কাছাকাছি সময়ে আরও কিছু মেহমান অনেকগুলো দেশ থেকে আসছেন বলে এয়ারপোর্টেই কিছুক্ষণ বসলাম। রাষ্ট্রীয় পর্যটন অফিস আমাদের কিছু বইপত্র দিল। ক্যাফেতে হালকা নাশতা কফি সেরে শহরের পথে রওনা হই।
তিনটি দিন আমাদের কেটে যায় সম্মেলনের ব্যস্ততায়। এর মধ্যে দ্বিতীয় দিন নিজের মায়ের আকস্মিক অসুস্থতার কথা শুনে পটিয়ার মুফতি শামসুদ্দিন জিয়া সাহেব দেশে ফিরে আসেন। এরপর ৩/৪ দিন আমরা মালয়েশিয়া ঘুরে বেড়াই। মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ, মাওলানা শরীফ মোহাম্মদ ও মাওলানা কামাল ইবনে শিহাব বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেন। অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি সম্মেলনকেন্দ্রে এসে আমাদের খুঁজে বের করেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরূপে আছেন এমন ৭/৮ জন এসে আমাদের সাথে সময় কাটান। প্রবাসে থাকা আত্মীয়-স্বজন এসে অনেককে ঘুরতে নিয়ে যান। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে আমার সময় ভালোই কাটে। আয়োজকরা একদিন বাঙালি এলাকার উতারায়া মসজিদে আলোচনার ব্যবস্থা করেন। বাদ মাগরিব মুফতি মিজানুর রহমান সাহেব ও বাদ এশা আমি একই বিষয়ের ওপর দীনি আলোচনা করি। বিষয় ছিল দীন ও দীনদার কথা দুটির সঠিক অর্থ কী? গভীর রাতে আমরা নিজেদের থাকার জায়গায় ফিরে আসি। এ মসজিদটি বাংলাদেশের মানুষ আবাদ রেখেছেন। দাতা যদিও একজন মাদ্রাজি মুসলমান কিন্তু তার বর্তমান বসবাস মালয়েশিয়াতেই। অনেক অর্থ-বিত্তের মালিক এ তরুণ খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি। অনুষ্ঠান শেষে তার সাথে কথা বলে বুঝতে পারি দীনি বিষয়ে তার উৎসাহ-উদ্দীপনা বিপুল।
দুইজন প্রবাসী তরুণ ও একজন পিএইচডি গবেষণারত আলেম একদিন আমাদের মালয়েশিয়ার গর্ব আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে নিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় দেখে আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত হই। পাহাড়ের পটভূমিতে এত বিরাট ও সুন্দর আয়োজন সত্যিই নয়নাভিরাম। বিশাল মসজিদের পাশে ইলমে ওহী বিভাগ। বৃহদায়তন লাইব্রেরি, বুক ও জার্নাল শপ। ক্যাফেটরিয়া, স্টেডিয়াম, হেলিপ্যাড ও অভ্যন্তরীণ বাস-স্টপ। শুধু শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্রদেরই গাড়ি আছে ৫০ হাজার। এসব রাখার সুশৃঙ্খল দৃশ্য দেখে খুশিই লাগে। গাড়িতে করে আমরা গোটা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখি। স্থাপত্য বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, অর্থনীতি বিভাগ, আইটি বিভাগ প্রতিটিই যেন একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিকেল ও বিজ্ঞান বিভাগ অন্য জায়গায় এর চেয়ে বড় ক্যাম্পাসে। ছাত্রদের থাকা ও অন্যান্য ফ্যাকাল্টির জন্য শুনেছি আরও দশগুণ জায়গা নিয়ে নতুন ক্যাম্পাস হচ্ছে। এখানে এক প্রহরব্যাপী গাড়িতে করে আমরা ঘুরে দেখলাম হযরত আসমা হল, ওরা বলে মহল্লা আসমা, মহল্লা খাদিজা, মহল্লা আয়েশা, মহল্লা নুসাইবা, মহল্লা হালিমা সাদিয়া, মহল্লা সুমাইয়া ইত্যাদি। সব ছাত্রী হল। পাহাড়ের ওপর পর্দাসম্পন্ন সুরম্য বহুতল ভবন এসব। তাদের জন্য খেলার জায়গা, মিটিং রুম, জিমনেসিয়াম সবই পর্দাবৃত ও আলাদা। দেখলাম কর্মীদের কোয়ার্টার, প্রশাসনিক ভবন, মহল্লা সিদ্দীকে আকবর, মহল্লা ওমর, মহল্লা উসমান, মহল্লা আলী এসব ছাত্রদের হল। ক্যাফেটরিয়ায় আরবদের জন্য বিশেষ রান্না, ইন্ডিয়া আফ্রিকা ও পাকিস্তানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ঠিকাদার। সুলভ মূল্যে তারা সারা পৃথিবী থেকে আগত নানা দেশের ছাত্রদের উপযোগী খাদ্য সরবরাহ করে। দেশ-বিদেশের চিন্তাবিদ ও গবেষকদের সেখানে গিয়ে গবেষণা ও পড়ালেখার যে স্কিম রয়েছে তার আওতায় সপরিবারে থাকার সুন্দর ব্যবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করে রেখেছেন। নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও উন্নত এ বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক সুনাম শুনেছিলাম। দেখেও সন্তুষ্ট হলাম।
মসজিদে প্রবেশ করে কিছু নামাজ পড়ে নিতে নিতে পরিচিতরা খবরাখবরি করে ফেলেন। ছাত্র ও শিক্ষক মিলিয়ে বেশ কয়জন মসজিদে ছুটে এলে তাদের সাথে কথা বলে কিছুটা সময় কাটাই। অবশ্য এরপর আরেকদিন আমরা দুপুরের খাবার খেতে বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিলাম। বাধা-নিষেধ ভুলে গিয়েই সেদিন আরবীয় খাবার পছন্দমতো নিয়ে মজা করে খেয়েছি। আর ভ্রমণ, পর্যটন, পরিদর্শন ও উপভোগের এমন সুযোগ করে দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া আদায় করেছি। মহল্লা আলীর ক্যাফেটরিয়ায় চোখের সামনে রকমারি ফলের জুস তৈরি করে দেওয়ার ব্যবস্থা দেখে অভ্যাসের বাইরে আমি একটু বেশি পরিমাণ জুস খেয়ে অস্বস্তি বোধ করি। ঘণ্টাখানেক পর এ কষ্ট দূর হয়। মূলত ক্যালোরি ও সুগার অধিক গ্রহণ করায় আমার এ কষ্ট হয়েছিল।
একদিন আয়োজকরা আমাদের নিয়ে যান রাজধানীর দর্শনীয় স্থানগুলো দেখাতে। এদিন আমাদের সাথে ছিলেন হংকং ইসলামিক এডুকেশন সেন্টারের চেয়ারম্যান কারী তৈয়ব কাসেমী। সরহিন্দ মুজাদ্দেদে আলফেসানীর খানকার সাজ্জাদানশীন সৈয়দ সাজেদ আলী শাহ ছাড়াও বৃটেন থেকে আগত একজন বড় আলেম। প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় পুত্রজায়া পার্লামেন্ট হাউজ। গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদসদৃশ্য এ সুরম্য ভবনটি প্রথম দৃষ্টিতে দেখে যে কেউ ভাববে এটি একটি মসজিদ। কিন্তু না। এটি মালয়েশিয়ার আইনসভা। পাশেই প্রধান রাষ্ট্রীয় মসজিদ। অসাধারণ সুন্দর ও বিশাল এ মসজিদটির কোনো তুলনা হয় না। সামনের বিশাল চত্বর পার হয়ে আমাদের গাড়ি যখন মসজিদের প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তখন বৃষ্টিভেজা প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। বিদেশি নারী-পুরুষ পর্যটকেরা নিয়ম মেনে মসজিদের গেইটে প্রবেশ করছে। যাদের পোশাক সংক্ষিপ্ত বা যারা অমুসলিম তারা গায়ে একটি বড় গাওন পরে মসজিদ আঙিনায় প্রবেশ করছেন। মূল মসজিদের ভেতরে কিছুটা জায়গা তাদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বড় রোব গায়ে জড়িয়ে মাথা ও বুক ঢেকে তারা মসজিদের কিছু অংশ দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। মুসলিম মহিলারা চলে যাচ্ছেন মহিলা নামাজ ঘরের দিকে। মূল মসজিদের এক-তৃতীয়াংশজুড়ে মহিলাদের নামাজের ব্যবস্থা। অকল্পনীয় সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, ¯িœগ্ধ ও বর্ণিল পরিবেশ। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় মেহরাবে। কিছু নামাজ পড়ে মসজিদের চারপাশ ঘুরে দেখি। বিশাল স্থাপত্য। আমাদের ধারণার চাইতে অনেক বড় ও ভাবনার চেয়েও সুন্দর। দূর পর্যন্ত যতদূর দেখা যায় পানির দীর্ঘ লেক। ওপারে তার সবুজের সমারোহ, গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা, প্রশাসনিক ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, প্রাসাদোপম অট্টালিকা ও বিশ্বমানের হোটেল। দূরে দেখা যায় লেকের এপার-ওপারে বেঁধে দেওয়া শৈল্পিক এক সেতু।
কিছুদূর গিয়ে দেখি পানির পশ্চাৎপটে নির্মিত আরেকটি মসজিদ। সুপ্রিম কোর্ট থেকে সোজা পশ্চিমে সুলতান জয়নাল আবেদীন মসজিদ। বিশাল মার্কেট, খাবারের দোকান ও পর্যটনকেন্দ্র। উপরে বিভিন্ন তালীমি ও সাংস্কৃতিক অফিস। আরও উপরে দরজা-জানালার প্রয়োজনমুক্ত একটি খোলামেলা বিশাল মসজিদ, যাতে এসি ও ফ্যানের ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। চারপাশ খোলা, দীর্ঘ ক্যানেলের ওপর পানি ও বাতাসের প্রাচুর্যে প্রাকৃতিকভাবে শীতল এ মসজিদ ২০ হাজার মুসল্লীর উপযোগী। মূল ভবনে ছয় হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারে। মসজিদটির একটিই প্রবেশপথ। মসজিদের সমনে বড় তোরণ দিয়ে কেবল পশ্চিমেই যাওয়া যায়। যতই মানুষ হোক কাউকে কেউ ডিঙাতে হয় না। মসজিদ দেখতে যাওয়া বিশিষ্ট মেহমানদের কেক ও পানির বোতল হাদিয়া দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সারাদিন পর্যটকদের খেদমত করছে। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে সুলতান সালাহউদ্দীন আব্দুল আজিজ মসজিদে। এ মসজিদ বিভিন্ন বই-পত্র ও ক্যালেন্ডারের পাতায় দেশ-বিদেশের মানুষ দেখতে পায়। এ ছাড়া সুলতানের প্রাসাদ ও শরীয়া আদালত এলাকায় দেখতে পাই বিলায়াহ মসজিদ। সুলতান মসজিদ ও বিলায়াহ মসজিদ এতই বিশাল ও সুন্দর যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি কোন শব্দে বা কোন ভাষায় এসবের বড়ত্ব সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করব তা ভেবে পাচ্ছি না। হারামাইন শরীফাইন ছাড়া দুনিয়ার খুব কম মসজিদকেই মালয়েশিয়ার এ কয়েকটি মসজিদের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সুলতান মসজিদ ও বিলায়াহ মসজিদ সম্বন্ধে আমি কোনো বর্ণনা দিচ্ছি না। কারণ, যতই আমি বলার চেষ্টা করি তা বাস্তবের কাছাকাছিও যাবে না। এ কেবল স্বচক্ষে পরিদর্শন বা প্রামাণ্যচিত্রেই পাওয়া সম্ভব।
একদিন নিয়ে যাওয়া হয় সুলতানের প্রাসাদ পরিদর্শনে। মালয় ভাষায় যাকে বলে, ‘এস্তানা নেগারাহ’। সুলতান সেদিন দেশে ছিলেন না। ঘণ্টাখানেক পরে তিনি বিদেশ থেকে ফিরবেন জেনে আমরা আর অপেক্ষা করলাম না। কাছেই মসজিদ নেগারাহ, এটি মালয়েশিয়ার জাতীয় মসজিদ। এত উঁচু মিনার যে আনাড়ি লোকেরা তা সহজে ক্যামেরায়ও ধারণ করতে পারবে না। মসজিদের ভেতরটা অপূর্ব সুন্দর। প্রতিটি মসজিদের মতো এখানেও পর্যটকের ভিড়। দেশি-বিদেশি, নারী-পুরুষ, মুসলিম-অমুসলিম হাজারো পর্যটক। সকলে নিয়ম মেনে ভেতরে ঢুকছে। মুসলমানরা মসজিদে নামাজ পড়ছে। অন্যান্য মসজিদের মতো আমরা এখানেও কিছু নামাজ পড়লাম। চারপাশে খোলা করিডোরে অনেক মানুষ বসে বিশ্রাম করছে। সামনে ও পাশের বাগানে খেলছে শিশুরা।
মালয়েশিয়ার প্রকৃতি ও আবহাওয়া অনেকটাই বর্ষার বাংলাদেশের মতো। লতা-পাতা, গাছ-পালাও এদেশের পার্বত্য এলাকার কাছাকাছি। বাংলাদেশের ঝোঁপঝাড় ও জঙ্গলের পরিচিত রূপ রাজধানী কুয়ালালামপুরের অলিতে গলিতে। খুব ভালো করে খেয়াল না করলে যে কেউ নিজেকে সিলেট, চট্টগ্রাম বা রাজশাহীতে রয়েছে বলে ভুল করবে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও পরিকল্পিত উন্নয়ন মালয়েশিয়াকে এগিয়ে দিয়েছে। এর মূলে রয়েছে দেশটির সুস্থ রাজনীতি ও দায়িত্বশীল নেতৃত্ব। কোনো কোনো এলাকায় ৯৮ ভাগ মুসলমান। তাবলীগী জামাতের কাজ খুবই জোরদার। ভারত, পাকিস্তান থেকে ফারেগ হওয়া আলেমের সংখ্যা প্রচুর। বাংলাদেশি আলেমদের যাতায়াতও কম নয়। প্রচুর হেফযখানা ও মাদরাসা রয়েছে। স্কুল-কলেজেও রয়েছে প্রয়োজনীয় দীনি শিক্ষা। ইন্ডিয়ান ও চায়নিজেরা জনসংখ্যায় প্রচুর। গড়ে এরা ও স্থানীয় মালয়রা কোনো কোনো এলাকায় শতকরা ৮০ ও ২০।
নেগারাহ মসজিদের সম্মুখভাগে জাতীয় কবরস্থান। এখানে মালয় ইতিহাসের নায়কদের কবর রয়েছে। কয়েকজন সুলতানের কবরও আলাদাভাবে সংরক্ষিত করা আছে। একটি কবর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজীব রাজাকের পিতা সাবেক মন্ত্রী তুং আব্দুর রাজ্জাকের। আশেপাশে আরও রাজা, মন্ত্রী ও নেতাদের কবর। চারটি কবরের জায়গা সংরক্ষিত। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও রাজকীয় ব্যক্তিবর্গের জন্যই রাখা আছে বলে জানাল একজন গাইড। মসজিদের মূল ভবনে সাবেক খতীবদের ছবি ও পরিচিতি, পাশে একটি করে ছবি যেখানে সুলতান বা প্রধানমন্ত্রী তাদের পেছনে নামাজ পড়ছেন।
আরেকদিন আমরা কুয়ালালামপুরের পাকিস্তানি মসজিদে গেলাম। ঘুরে দেখলাম ইন্ডিয়া মসজিদ। খোলা চত্বর, সুপার মার্কেট, চেইন শপ ইত্যাদি। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার ও অন্যান্য নামকরা স্থাপত্যও দেখা হলো। অনেকে টুকটাক কেনাকাটা করলেন। আমার বা আমার পরিবারের কোনো কিছুর প্রয়োজন ছিল না বলে কিছুই কিনলাম না। চট্টগ্রামের একজন প্রবাসী তরুণ কিছু চকলেট হাদিয়া দিলেন। একজন খতিব সাহেব একটি হাতব্যাগ কিনে দিলেন। সফরের সময় অন্তত ৩০ জন বাংলাদেশি আলেম-ওলামার সাথে দেখা হলো। যারা কোনো কাজে মালয়েশিয়ায় আছেন। একে একে অন্য দেশের মেহমানরা বিদায় হয়ে গেলেন। বাংলাদেশি সাথীরাও নিজ নিজ বন্ধু-স্বজনদের আতিথ্যবরণ শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমিও ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছি। কারণ, দেশে ফিরেই আবার আমার হজের সফর। শরীরও তেমন ভালো না। ঢাকায় অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ততা।
শেষদিন আমরা গেলাম মালয়েশিয়ার দর্শনীয় স্থান গেন্টিং হাইল্যান্ডস নামক পর্বতে। মাটি থেকে ৬ হাজার ফুট উঁচু এ পাহাড়ে চার লেনের মসৃণ রাস্তা তৈরি করে মালয়েশিয়ার সরকার এ দুর্গম অঞ্চলকে শহরের সমান সুগম করে রেখেছে। যেদিন আমরা যাই সেদিন ক্যাবল কার কারিগরি কারণে বন্ধ ছিল। এর আগে সিঙ্গাপুর ও তায়েফ শহরে ক্যাবল কারে চড়েছি বলে এখানে আমার চড়ার ইচ্ছাও ছিল না। তবে উন্নত মডেলের শক্তিশালী প্রাইভেট ভলভো গাড়িতে পর্বত-চূড়ায় ওঠার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই আনন্দদায়ক। উড়ে যাওয়া মেঘমালা আমাদের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছিল। পর্বতচূড়ার সাত তারকা হোটেলগুলো, বৌদ্ধমন্দির ও অন্যান্য স্থাপত্য মেঘে ভেজা। ভর দুপুরে আমাদের গায়ে শীত লাগছে, মনে হয় ভিজে যাচ্ছি আমরা। আবার নিচে নামতে শুরু করলাম। পথে পাহাড়ের চূড়ায় একটি মসজিদ। কারুকার্য ও কাঠের ব্যবহার অপূর্ব। জোহরের নামাজ পড়ে আমরা আবার নামতে শুরু করলাম। ঘণ্টাখানেক পর রাজধানীতে ফিরে আটদিন আমাদের যারা মায়া-মমতা ও শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছিলেন সেসব সাথীকে বিদায় জানিয়ে ছুটলাম এয়ারপোর্টের দিকে। মাগরিব পরে উঠলাম ফ্লাইটে। নানা কারণে দেরি করে রওয়ানা করতে হলো রাত সাড়ে ৮টায়। যখন আমরা ঢাকায় নেমেছি তখন রাত ১১টার কিছু বেশি। দেশে ফিরে স্মৃতিতে লালন করছি সবুজ সুন্দর মালয়েশিয়া। আধুনিকতার সকল আয়োজন যেখানে ইসলাম ও দেশপ্রেমের ¯িœগ্ধতায় মাখা। ধর্ম, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সঙ্গে নিয়ে কীভাবে উন্নতির শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছেন মালয়েশিয়ার আত্মবিশ্বাসী, উদার ও দক্ষ নেতারা। আমি মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশের নেতৃবন্দকে কিছু শিখতে বলব।
লেখক : সাংবাদিক, ইতিহাস, রাষ্ট্র ও সমাজতত্ত্ববিদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন