শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নজরুলের ‘ব্যথার দান’ এবং তাঁর ‘মানসী’

প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শেখ দরবার আলম

॥ এক ॥
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম গ্রন্থ ‘ব্যথার দান’। এটি একটি গল্পগ্রন্থ। এই ‘ব্যথার দান’ তিনি উৎসর্গ করেছেন তার ‘মানসী’কে।
ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে জ্যৈষ্ঠ ১৪১৩-য় প্রকাশিত ‘নজরুল রচনাবলী’র প্রথম খ-ের নজরুল জন্ম শতবর্ষ সংস্করণে ৪৪৮ পৃষ্ঠায় দেখেছি যে, এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। আর এর ৪৬৩ পৃষ্ঠায় দেখেছি এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১লা মার্চ। অতএব বোঝা গেল যে, ‘ব্যথার দান’-এর প্রকাশ তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
‘নজরুল রচনাবলী’-র এই প্রথম খ-ের নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণে গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’-এর কোনো সূচিপত্র নেই। আষাঢ় ১৩৯০ এ পুনর্মুদ্রিত আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাবলী’র প্রথম খ-ে ‘ব্যথার দান’-এর যে সূচিপত্র আছে সেখানে দেখানো হয়েছে যে, ‘ব্যথার দান’ শীর্ষক এই গল্পগ্রন্থটির অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলো হলো যথাক্রমে ‘ব্যথার দান’, ‘হেনা’, ‘বাদল-বরিষণে’, ‘ঘুমের ঘোরে’, ‘অতৃপ্ত কামনা’ এবং ‘রাজবন্দীর চিঠি’।
‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘হেনা’ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল কার্তিক ১৩২৬ [অক্টোবর-নভেম্বর ১৯১৯]-এ কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ত্রৈমাসিক মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য়। এটা সেনাবাহিনীতে ‘হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম’-এর পাঠানো গল্প। [‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থের নাম গল্প ‘ব্যথার দান’ ছাপা হয়েছিল মাঘ ১৩২৬ [জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৯২০]-এ ত্রৈমাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’-য়। এটিও সেনাবাহিনী থেকে পাঠানো ‘হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম’-এর পাঠানো গল্প।
‘ব্যথার দান’ গল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ফাল্গুন ১৩২৬ [ফেব্রুয়ারি-মার্চ ১৯২০]-এর মাসিক ‘নূর’-এ। ‘হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম’ তার এই গল্পটিও পাঠিয়েছিলেন সেনাবাহিনী থেকে।
সেনাবাহিনী থেকে ফিরে নজরুল কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করার পর ‘অতৃপ্ত কামনা’ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল শ্রাবণ ১৩২৭ [জুলাই-আগস্ট ১৯২০]-এ ত্রৈমাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’-য়। এই শ্রাবণ ১৩২৭ [জুলাই-আগস্ট ১৯২০]-এ-ই মাসিক ‘মোসলেম ভারত’-এ ছাপা হয়েছিল রুপক গল্প। ‘বাদল রবিষণে’। ‘বাদল বরিষণে’ ছাপার সময়টি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
মনে রাখতে হবে যে, সচিত্র মাসিক মোসলেম ভারত সে সময়ে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাসরত এম আফজালউল হক সাহেবের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হতো এবং পরে প্রকাশক হিসেবে তিনিই তাদের ‘মোসলেম পাবলিশিং হাউস’ থেকে গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ প্রকাশ করেছিলেন। ‘ব্যথার দান’ প্রকাশের মৌখিক চুক্তি যখন হয় তখন নজরুলও থাকতেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসেই সুহৃদ মুজফফর আহমদের সঙ্গে।
‘রাজবন্দীর চিঠি’ শিরোনামে গল্পটি কবি রাজদ্রোহের অভিযোগে প্রেসিডেন্সি জেলে রাজবন্দি হিসেবে হাজত বাসকালে লিখেছিলেন তার এক বছর সশ্রম কারাদ- হওয়ার আগের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩ [১লা মাঘ ১৩২৯] তারিখ সোমবার। ‘নজরুল-রচনাবলী’তে ‘ব্যথার দান’-এর উল্লিখিত প্রকাশ তারিখের প্রায় এক বছর পর। তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, এ বিষয়ে এখনো অনুসন্ধান, উদ্ধার ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত অনেক কাজ করার আছে।
অন্তত ‘রাজবন্দীর চিঠি’ শিরোনামের গল্পটি লেখার আগেই ‘ব্যথার দান’-এর কোনো সংরক্ষণ ১৫ চৈত্র ১৩২৮ [২৯শে মার্চ ১৯২২ : ২৯ শে রজব ১৩৪০] তারিখ বুধবারের আগেই যে প্রকাশিত হয়েছিল সে প্রমাণ এই শেষোক্ত তারিখে মোহাম্মদ আফজাল-উল হকের কাছে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের চিঠিতেই আছে।
॥ দুই ॥
দৈনিক কাগজের এমনকি কোনো কোনো সাময়িক পত্রের নিবন্ধে প্রয়োজনীয় অনেক তারিখ তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে আসার সুযোগ থাকে না। এখানে কেবল এটুকুই উল্লেখ করছি যে, মোহাম্মদ আফজাল-উল হক সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া যে বিবরণ আবদুল আজীজ আল-আমান সাহেব তার ‘নজরুল পরিক্রমা’ গ্রন্থের ২১৬ থেকে ২১৮ পৃষ্ঠায় দিয়েছেন তাতে মনে হয় যে, গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’-এর প্রথম সংস্করণ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কোনো এক সময়ে অবশ্যই প্রকাশিত হয়েছে। শ্রাবণ ১৩২৭ [জুলাই-আগস্ট ১৯২০]-এর মাসিক ‘মোসলেম ভারত’-এর ১ম খ- : ৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত রুপক গল্প ‘বাদল বরিষণে’ প্রসঙ্গে ২১৮ পৃষ্ঠার শেষ দিকে আব্দুল আজীজ আল আমান সাহেব যা লিখেছেন সেটা সত্য হলে এমনটাই বিশ্বাস করার অত্যন্ত সঙ্গত কারণ আছে। ‘ব্যথার দান’-এর এই প্রথম সংস্করণের মূল্য ধার্য করা হয়েছিল সম্ভবত এক টাকা।
ঢাকার মল্লিক ব্রাদার্স থেকে ১৯৮৮-র জুলাই মাসে প্রকাশিত আমার ‘অজানা নজরুল’ গ্রন্থের ৬৫৭ পৃষ্ঠায় আমি উল্লেখ করেছিলাম যে, ‘ছায়ানট’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর ১৯২১ [কার্তিক ১৩২৮]-এ কলকাতার কলেজ স্কোয়ার [ইস্ট], এই ঠিকানাস্থিত মোসলেম পাবলিশিং হাউস থেকে। দাম : পাঁচ সিকা।
‘ব্যথার দান’-এর আগের দুটো সংস্করণের মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্ভবত ঠিক এভাবেই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ব্যথার দান’-এর তৃতীয় সংস্করণের মূল্য ধার্য করা হয়েছিল দেড় টাকা। কিন্তু এরপরও মনে রাখতে হবে যে, ‘রাজবন্দীর চিঠি’ শীর্ষক গল্পটি এই সংস্করণেও নিশ্চয়ই ছিল না। ‘বাদল বরিষণে’ লেখার আগেই গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’ প্রকাশের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছিল। মুজফফর আহমদের ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’য় সেটা স্পষ্ট।
ঢাকায় এখন সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত কলকাতার সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার মতো আর কোনো উপযুক্ত সাহিত্য পত্রিকা নেই। থাকলে এ বিষয়ে আরো একটু বিস্তারিত লেখা যেত।
॥ তিন ॥
নজরুলের গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’-এর উৎসর্গপত্রে আছে :
“মানসী আমার! মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে
ক্ষমা করো নি,
তাই বুকের কাঁটা দিয়ে
প্রায়শ্চিত্ত ক’রলুম।”
চব্বিশপরগনায় কবি শাহাদাৎ হোসেন এবং ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবদের এলাকায় হাড়োয়া পীর গোরাচাঁদ হাইস্কুলে এইট ক্লাসে পড়ার সময় এই উৎসর্গপত্র পড়ে খুবই উতলা হয়েছিলাম। কী সংবেদনশীল! কত স্পর্শকাতর মনের কথা। কত অপরিসীম সংবেদনশীল মন, স্পর্শকাতর মন ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের! ‘মাথার কাঁটা’টা তো নজরুল জীবনে অবাস্তব নয়!
আবার সেনাবাহিনী থেকে ১৯২০ এর মার্চে বাংলা মুলুকে ফিরে তিনি যখন কলকাতায় থাকার জন্য বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে আসেন তখনো আরো অনেক কিছুর সঙ্গে এই ‘মাথার কাঁটা’টা ছিল সঙ্গে! সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সময়ও এই ‘মাথার কাঁটা’টা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এই মানসীটা কে?
‘ব্যথার দান’-এর সবকটি গল্পেও সেটা কি খুঁজে পাওয়া সহজ?
নজরুল আত্মজীবনী লেখেননি। বলেছেন তার সাহিত্যেই রয়ে গেছে তার জীবনী।
আজ মনে হয় তার মানসীকে খুঁজে পাওয়া যাবে অন্তত সেনাবাহিনী থেকে পাঠানো তার গল্পগুলোর মধ্যে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তার জীবনীর তথ্য দরকার।
॥ চার ॥
এরপর সেই নজরুল জন্মশতবর্ষ পূর্তির সময় ঢাকার জিপিও-র সাবেক সুপারিনটেনডেন্ট শ্রদ্ধেয় ডিএফ আহমদ সাহেব বাসায় এসে তার নজরুল বিষয়ক কয়েকটি বই দিয়ে গেলেন। তার লেখা ‘কবি নজরুল ও সপ্ত দিকপাল’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে, নজরুলের কিঞ্চিৎ দূর সম্পর্কের চাচা, সে সময়ে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমারই দোমোহানীতে বসবাসরত কাজী কায়েম হোসেনের কন্যা হাসনাই হলেন নজরুলের উল্লিখিত মানসী।
কাজী কায়েম হোসেন ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের আব্বা কাজী ফকীর আহমদের ছোট চাচা কাজী নজীবুল্লাহর সন্তান। কাজী নজিবুল্লাহ তার সন্তান কাজী কায়েম হোসেনকে আসানসোল পাঠিয়ে শিক্ষিত করেছিলেন। অনেক কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে কাজী কায়েম হোসেন লেখাপড়া শিখে কম্পাউন্ডারি করে হোমিও চিকিৎসক, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং বর্ধমান কোর্টের জুরার হয়েছিলেন। তার আর্থিক সচ্ছলতা হতদরিদ্র হয়ে পড়া নজরুল পরিবারের সঙ্গে তার পরিবারের একটা ব্যবধান সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ডিএফ আহমদ তার ওই গ্রন্থের ৩৩ এবং ৩৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, কাজী কায়েম হোসেনের স্ত্রী নিজেদেরকে ‘খাস’ এবং চুরুলিয়ার উভয়ের কাজী পরিবারের অন্য অংশকে অর্থাৎ নজরুলরা যে অংশের সেই অংশকে ‘আম’ বা সাধারণ মানুষ বলে গণ্য করতেন। নজরুলের আব্বা কাজী ফকির আহমদের জীবদ্দশাতেই কাজী কায়েম হোসেনের বাড়িতে আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে নজরুল যখন ‘সপ্তম শ্রেণীর’ বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে ডবল প্রমোশন পেয়ে ‘নবম শ্রেণীতে’ ওঠেন তখন কাজী কায়েম হোসেনের বাড়িতে নজরুলের ডাক পড়ে।
কাজী কায়েম হোসেনের হাসনা নামে তেরো বছরের একটি মেয়ে ছিলেন। নজরুল মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়ি এলে হাসনাদের বাড়িতে যাওয়া শুরু করেন। হাসনার মা তাকে ‘আম’ ‘খাসের’ তুলনা দিয়ে সাবধান করে দেন। এমনই একটা সময়ে নজরুল একতরফাভাবে একটা ভুল করে বসেন।
হাসনার মাথায় তারের টুকরোর মাথায় নানা রঙের বল বসানো কাঁটা দিয়ে ছক করে চুল বাঁধা থাকত। উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই এই জাপানি কাঁটা ব্যবহার করত। নজরুল একদিন হঠাৎই আবেগের বশে হাসনার মাথার একটি কাঁটা উঠিয়ে নিলে হাসনা অগ্নিশর্মা হয়ে নজরুলকে বলেন, ‘কী স্পর্ধা! তুমি আমার মাথায় হাত দেবার কে?’
হাসনা কাঁটা ফেরত না নিয়েই চলে যান।
নজরুল কাঁটাটা নিয়ে বিধ্বস্ত হৃদয়ে বাড়িতে ফেরেন।
আর কোনো দিন তাদের দেখা হয়নি।
প্রায় দুই বছর পর নজরুল চলে যান সেনাবাহিনীতে ‘১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে’। ‘এই সময়েই’ হাসনার বিয়ে হয়ে যায় আসানসোলের কোনো এক সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন পদের ডাক্তারের সাথে। “ঝ’রে প’ড়ে যায় না বলা প্রেমের একটি অপ্রস্ফুটিত কুসুম।”
‘কবি নজরুল ও সপ্ত দিক পাল’ গ্রন্থে কবির এলাকার মানুষ এবং একটু দূরসম্পর্কের হলেও আত্মীয় ডি এফ আহমদের দেওয়া এই বিবরণের কোনো কোনো অংশ আমি অনেক প্রয়োজনে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে পরিবেশন ক’রলাম।
লেখক : নজরুল গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন