বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুনশী মেহেরুল্লাহ এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব

প্রকাশের সময় : ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাহমুদ শাহ কোরেশী
একসময়ে উপযুক্ত তথ্যের অভাব ছিল প্রকট। তাই আমাদের অতীতের সমাজ নায়কদের সম্পর্কে লেখতে গেলে খুবই অসুবিধা হতো। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমার অভিসন্দর্ভের প্রয়োজনে ইউরোপে বসে মুনশী মেহেরুল্লাহ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমি সমস্যায় পড়ে যাই। আমার হাতের কাছে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই সাহেবের মূল্যবান আলোচনা ও বিলাতের গ্রন্থাগারে নোট করা শেখ হাবিবুর রহমান রচিত কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহ গ্রন্থের কিছু তথ্য। এখন হঠাৎ হাতে এলো মুস্তফা নূরউল ইসলামের ‘মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ’ শীর্ষক অতি ক্ষুদ্র, মাত্র ৪৬ পৃষ্ঠার কিন্তু প্রচুর তথ্যসমৃদ্ধ জীবনী গ্রন্থ। এটি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত মাত্র ১ (এক) টাকা দামের অত্যন্ত মূল্যবান বই।
মুস্তাফা সাহেবের লেখায় রেফারেন্সস্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে ড. আনিসুজ্জামানের প্রবন্ধ ‘মেহেরুল্লাহ ও জমিরুদ্দিন’ (সাহিত্য পত্রিকা শীত সংখ্যা ১৩৬৭-তে প্রকাশিত) এর কথা। যা হোক সে সময়ে আমি ফরাসি ভাষায় বেশ কিছু লিখেছিলাম (১৯৬৫/১৯৭১) যা এ বছর আল্লাহর মর্জি হলে ইংরেজিতে ছাপা হবে।
বিখ্যাত ফরাসি লেখক অঁদ্রে মালরো বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা প্রদান প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘তার কাছে বই যে শুধু প্রয়োজনীয় রূপে থাকবে তা নয়, একজন বুদ্ধিজীবীর জীবনে আসলে একটি আদর্শ তাকে ঘিরে রাখবে এবং তার জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করবে।’
মফস্বলের বাংলায় বসবাস করেও এ রকমের এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি মুনশী মেহেরুল্লাহর মধ্যে। খুব স্বল্প শিক্ষিত অনেকটা স্বশিক্ষিত এই মুনশী কিন্তু সমকালে তার স্বধর্মীদের ওপর এমন মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে, তাকে মুসলিম বাংলার রামমোহন আখ্যা দেয়া হয়েছিল (মোহাম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ. ১৬ ১২৫, ১২৮-১২৯)।
মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭) ধর্মীয় ঐতিহ্যসম্পন্ন এক দরিদ্র পরিবারে যশোহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তার পিতৃবিয়োগ ঘটে। কিন্তু মায়ের প্রভাবে মেহেরুল্লাহ বাল্যে বিদ্যালয়ের পড়াশোনা, পরে জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। কৈশোরে ছ’বছর তিনি দুই মহানুভব ব্যক্তির আশ্রয়ে থেকে আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষা আয়ত্তে আনার প্রয়াস চালান। তাছাড়া ধর্ম বিষয়ে অধিকতর জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সব সময় সচেষ্ট থাকেন।
জীবিকা হিসেবে তিনি দর্জির কাজ গ্রহণ করেন এবং অল্প বয়সেই এতে দক্ষতা অর্জন করেন। এ পর্যায়ে স্থানীয়ভাবে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার তাকে প্রভাবিত করে। তার আশপাশে অনেকেই খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু মেহেরুল্লাহ ধর্মান্তর গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। শুধু তাই নয়, তিনি খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকদের পদ্ধতি অবলম্বন করে ইসলামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে হাটে-বাজারে বক্তৃতা করতে থাকেন। এ সময়ে ধর্মান্তরিত মুসলমান জন জমিরুদ্দিন ‘আসল কোরান কোথায়?’ শীর্ষক এক রচনা করে বিশ্বাসীদের মধ্যে হতাশার সূচনা করেন। তখন মুনশী মেহেরুল্লাহ সাপ্তাহিক ‘সুধাকর’ পত্রিকায় ‘ইশায়ী বা খ্রিস্টানী ধোঁকা ভাজন’ শীর্ষক এক দীর্ঘ প্রবাদ প্রকাশ করে (২০ চৈত্র, ২৭ চৈত্র, ২ বৈশাখ, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৩০০) জমিরুদ্দিনের জবাব দেন। তারপর ‘আসল কোরান সর্বত্র’ শীর্ষক ভিন্ন রচনায় এই বিতর্কের অবসান ঘটান। খোদ জমিরুদ্দিন রণে ভঙ্গ দিয়ে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করেন। দু’য়ের মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্ব হয় এবং মেহেরুল্লাহ জমিরুদ্দিনের ইসলাম গ্রহণ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, একদা আর্থিক অনটনে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মেহেরুল্লাহর অর্থে এ ছাড়াও ইসমাইল হোসেন শিরাজীর ‘অনল প্রবাহ’ ও শেখ ফজলুল করিমের ‘পরিত্রাণ কাব্য’ প্রভৃতিও সেদিন প্রকাশ লাভ করতে পেরেছিল।
তবে মুনশী মেহেরুল্লাহর রচিত গ্রন্থাদি বা পুস্তিকাসমূহ সেকালে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল কেননা তিনি খুব জোরালো ভাষায় ইসলামের পক্ষাবলম্বন করে বিরোধী কুৎসা ও অপপ্রচার প্রতিহত করেন। বর্তমানে তার সমস্ত রচনা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেলেও নানা সূত্রে তার রচিত নি¤েœাক্ত রচনাবলীর নাম এবং কখনো কখনো কিছু স্মৃতি পাওয়া যায়Ñ
খ্রিস্টীয় ধর্মের অসারতা,
খ্রিস্টান-মুসলমানে তর্কযুদ্ধ
রদ্দে খ্রিস্টীয়ান ও দলিলোল ইসলাম
হিন্দু ধর্ম-রহস্য ও দেবলীলা,
মেহেরুল ইসলাম/ইসলাম রবি,
বিধবা গঞ্জনা ও বিষাদ-ভা-ার,
পাঞ্জেনামা, সাহেব মুসলমান,
জোওয়াবোন্নাছারা,
বহু ঈশানম-ল এবং চার্লস ফ্রেঞ্চের এসলাম গ্রহণ!
জন জমিরুদ্দিনকে লেখা (১৩০৪ সালের ১৮ বৈশাখ) একটি পত্রে মেহেরুল্লাহ বিনয়ের সঙ্গে লেখেন :
“যদিও আমি ভাল বাঙ্গালা জানি না; তথাপি ক্রমে কয়েকখানি পুস্তক-পুস্তিকা প্রকাশ করিয়াছি। তাদ্বারা সমাজের কতদূর উপকার সাধিত হইয়াছে, বলিতে পারি না, তবে এই মাত্র জানি যে এখন আমি খোদার ফজলে সমুদয় বঙ্গীয় মুসলমানের ¯েœহ আকর্ষণ করিয়াছি। আমি দরিদ্র লোকের সন্তান হইলেও আমার আর কোনো বিষয়ের অভাব অনুভব করিতে হয় না।”
‘হিন্দু-ধর্ম-রহস্য ও দেবলীলা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন :
“ধরিতে গেলে, বর্তমান ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান এই সম্প্রদায়ই ভারতের প্রধান অধিবাসী। বাস্তবিক আমাদের এই দুয়ের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ হওয়াই সর্ব প্রকার অমঙ্গলের কারণ হইয়াছে। আমার ধর্মের বিভিন্নতাই সে বিবাদের মূল। হিন্দু যাহাকে পুণ্য, মুসলমান তাহাকে পাপ ও মুসলমান যাহাকে পুণ্য, হিন্দু তাহাকে পাপজ্ঞানে একজন অন্যজনকে ঘৃণা ও হিংসার চক্ষে দেখিতেছেন। অতএব, আসুন, আমরা অকপট মনে, আমাদের বিবাদীয় বিষয়গুলোর সূক্ষ্মালোচনা দ্বারা মীমাংসা এবং কল্পনার অনুসরণ পরিত্যাগপূর্বক প্রকৃত সত্যানুরাগী হইয়া পরস্পর বিবাদ নিষ্পন্ন করি।”
মুনশী মেহেরুল্লাহর অসামান্য ব্যক্তিত্ব উনিশ শতকের শেষপাদে মুসলমান সম্প্রদায়কে বিধর্মী প্রচারণা থেকে উদ্ধার করেছে এবং হানাফী মতাবলম্বীদের শক্ত অবস্থানে উন্নীত করেছে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মোহাম্মদ মাহদী হাসান ২৫ অক্টোবর, ২০১৯, ১১:০৯ পিএম says : 0
মুন্সী মেহেরুল্লাহ নূরানী মাদরাসা
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন