রুমান হাফিজ
রাসেল, জনি ও তুহিন ওরা তিনজন বোতল কুড়াচ্ছিল। হঠাৎ করে বৃষ্টি আসায় দৌড়ে গিয়ে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে আশ্রয় নেয়। অনেক সময় হয়ে গেল বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে বৃষ্টি আসার ফলে তাদের তেমন বোতল কুড়ানো হয়নি। বোতল যাই হোক না কেন, এগুলো বিক্রি করতে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে হবে মহাজনের দোকানে। তা না হলে আজ আর বিক্রি করা সম্ভব হবে না। প্রতিদিনের কুড়ানো বোতলগুলো প্রতিদিনই ওরা সেখানে বিক্রি করে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ না দেখে জনি বললÑ ‘চল বিষ্টিতে ভিইজ্যা যাই’। এ কথা শুনে তুহিন বলেÑ ‘আরে বিষ্টি তো বেশি অইতাছে, একটু কমুক যামুনে’। তুহিনের কথায় সম্মতি দিয়ে রাসেল বলেÑ ‘হ, কমলে যামুনে, অহন ভিইজ্যা গেলে আমগো জ্বর-উঠবার পারে।’
এদিকে সময়টা সন্ধ্যার কাছাকাছি প্রায়। কোনো উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে ওরা বৃষ্টিতে ভিজেই ছুটে চলল। বোতল বিক্রি শেষ করে তিনজন যার যার ঘরের দিকে রওয়ানা দেয়। ঘরে এসে কাপড় পাল্টে নেয় রাসেল। শরীরটাতে কেমন যেন কাঁপন অনুভূত হচ্ছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একমাত্র রাসেল আর মা ছাড়া কেউ নেই তাদের ঘরে। রোড-এক্সিডেন্টে ভ্যানচালক বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে খুব কষ্টে চলছে তাদের সংসার। ইসলামপুর বস্তির ছোট্ট একটা ঝুপড়ি ঘরে তাদের বসবাস। মা বিভিন্ন বাসায় কাজ করেন আর রাসেল বোতল কুড়িয়ে যা পায় তা দিয়ে কোনোমতে চলছে তাদের। মায়ের খুব ইচ্ছে ছিলÑ একমাত্র ছেলে রাসেলকে পড়ালেখা করানোর। কিন্তু কি আর করা। যেখানে একমুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে আবার পড়ালেখা!
খুব ভোরে একটা বাসায় কাজ শেষ করে ঘরে ফিরেন মা। এসে দেখেন রাসেল মুঘাচ্ছে। একি! এই সময় তো রাসেল ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। কী হয়েছে এই ভেবে যখন মা রাসেলের পাশে বসে মাথায় হাত বোলান তখন তো তিনি রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেলেন। রাসেলের শরীর হতে খুব গরম তাপ বের হচ্ছে। মায়ের হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙে রাসেলের। তাকিয়ে রয় মায়ের দিকে। মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। মা গরম পানি করে রাসেলকে মুখ-হাত ধুয়ে দেন। প্রতিদিনের মতো নাস্তা খেতে দেন রাসেলকে। কিন্তু রাসেল তা কোনোভাবে খেতে পারছে না। তার চোখ দুটো সূর্যের মতো লাল রঙ ধারণ করেছে। ছেলের এই অবস্থায় মা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সে পরিমাণ টাকা তো নেই। যাই হোক পাশের পরিচিত ফার্মেসি থেকে কিছু ওষুধ নিয়ে এলেন। এদিকে ঈদের বাকি আর মাত্র চার থেকে পাঁচ দিন। সবাই তো ব্যস্ত ঈদের কেনাকাটায়। কার খবর কে রাখে। খুব ইচ্ছে ছিল রাসেলের এই ঈদে একটা নতুন জামা কেনার। কিন্তু কই আর হলো! সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েই তো এই অবস্থা। তা না হলে ঈদের আগে যে কয়দিন ছিল বোতল কুড়িয়ে অন্তত একটা জামা কেনার টাকা তো পাওয়া যেত। ভীষণ-জ্বরের ঘোরে বিছানায় শুয়ে এসবই ভাবছে রাসেল।
আজ ঈদের দিন। বস্তির অন্যরা যে যার মতো করে ঈদের কেনাকাটা করেছে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর কারো কারো গায়ে নতুন জামা, এদিক সেদিক ছোটাছুটি, হৈহুল্লোড় করে মাতিয়ে তুলছে পুরো বস্তি। অসুস্থ শরীর নিয়ে ঝুপড়ি ঘরের বারান্দায় বসে এসবই দেখছে রাসেল। মনের মাঝে বারবার উঁকি দিচ্ছে ঈদে নতুন জামা না পাওয়ার বেদনা। “আমি যদি এ কয়দিন বোতল কুড়াতে পারতাম, তাইলে তো ঠিকই একটা নতুন জামা কিনবার পারতাম। কিন্তু জ্বর আইসা তো সব কিছু ডিশমিশ কইরা দিলো।” রাসেলের কণ্ঠে আবারও-হতাশার সুর। মা একটা ছোট বাটিতে করে সেমাই খেতে দেন রাসেলকে। রাসেল শুধু চামচ দিয়ে বাটির সেমাইগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে কিন্তু মুখে তুলতে ভুলে যায়। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ে রাস্তার দিকে। ছোট্ট দুইটা ছেলে একটা কাগজের ব্যাগ হাতে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। হুড়মুড় করে এক দৌড়ে তারা এসে পড়ে রাসেলদের ঝুপড়ি ঘরে। এ তো তারই বন্ধু জনি আর তুহিন। রাসেলের পাশে বসে দুই বন্ধু। একটা নতুন জামা ব্যাগ হতে বের করে রাসেলের হাতে দেয় তুহিন। কিছু সময়ের জন্য ‘থ’ হয়ে রইল রাসেল।
‘কিরে, কী ভাবতাসিস?’ রাসেলকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করে জনি।
“তুই নতুন জামাটা পইড়া নে, আমরা একলগে বাইরে বেড়াতে যামুনে” হাসিমুখে কথাটা বলে তুহিন।
জামাটা হাতে নিয়ে রাসেল এক দৌড়ে ছুটে যায় মায়ের কাছে।
“মা, মা, আমার বন্ধুরা আজ আমার লাইগ্যা ঈদের নতুন জামা-কিইন্যা আনছে।” রাসেলের সাথে জনি এবং তুহিনও চলে আসে মায়ের কাছে। ছেলের খুশিতে মায়ের চোখেও ঈদের আনন্দ চিকচিক করছে। “তোরা আমার ছেলের লাইগ্যা নতুন-জামা...।” মা তাদের তিনজনকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ঈদের আনন্দ এসেছে রাসেলদের ঘরেও।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন