গত কয়েক মাস ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা- রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানের মানুষ খাবার পানির তীব্র সঙ্কটে থাকার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। শুধু যে খাবার পানির সঙ্কট তাও নয়, অনেক স্থানে দৈনন্দিন ব্যবহারের পানিও পাচ্ছে না মানুষ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা প্রচেষ্টা চলছে। রেডক্রিসেন্ট, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্যোগেও কোথাও কোথাও গ্রামবাসীকে তাদের প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এভাবে পাহাড়ের পানি সঙ্কটের সমাধান হবে বলে নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ নেই। বান্দরবানের আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, থানচি, রাঙামাটির লংগদু, বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, মাটিরাঙাসহ অনেক স্থানেই পানির জন্য এখন হাহাকার চলছে। কোনো কোনো স্থানে সাময়িকভাবে পানি সরবরাহের চেষ্টা থাকলেও সবখানে সেটাও সম্ভব নয়। কেননা, এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে সড়ক যোগাযোগ নেই। ফলে সেসব স্থানে পানিবাহী গাড়ি নিয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। আর এ সমস্যা শুধু যে এবারই হচ্ছে তাও নয়, বরং দীর্ঘদিন থেকেই পাহাড়ের শুষ্ক মৌসুম তথা গ্রীষ্মকালে পানির সঙ্কট থাকে। তবে সঙ্কটের মাত্রাটা যেন ক্রমেই বাড়ছে, এটাই ভয়ের কথা।
একটা সময় ছিল, যখন যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে পাহাড়ের এ সঙ্কটের কথা বাইরে থেকে খুব একটা জানা যেত না। কিন্তু এখন সে সমস্যা নেই। গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় যে কোনো সঙ্কট-সমস্যার কথা সহজেই প্রচার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে সঙ্কটগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় নিয়ে ভাবার সুযোগও অবারিত হচ্ছে। সরকার জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এ সঙ্কট চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার প্রকল্পও দিচ্ছে। জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউনিসেফ থেকেও এ ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছে। কিন্তু যে হারে প্রকল্প এবং বরাদ্দ আসছে সে হারে তা পাহাড়ের মানুষের পানি সঙ্কট মোকাবিলায় কাজে লাগার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না, এটাই হতাশার বিষয়।
গত বছর তথা ২০২০ সালে খাগড়াছড়ির জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল একটি বেসরকারি টেলিভিশন। ‘পানি বেচে জমিদার’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি দেখে আঁৎকে উঠা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আসলে পাহাড়ের মানুষের পানি সঙ্কট মোকাবিলায় আসা কোটি কোটি টাকা কীভাবে হরিলুট হচ্ছে তার চিত্রই ফুটে উঠেছে প্রতিবেদনটিতে। এই অবস্থা কি শুধু খাগড়াছড়ির? বাকি দুই জেলাতে কি এই ধরনের অনিয়ম হচ্ছে না? সেটা বিশ্বাস করা যায় কীভাবে? কারণ, বান্দরবান এবং রাঙামাটির বাসিন্দাদেরও একই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সেখানেও তো পানির জন্য হাহাকার চলছে। সরকারি প্রকল্প-বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যয় বা বাস্তবায়ন হলে তো সঙ্কট বাড়ার কথা নয়, ক্রমান্বয়ে কমে আসার কথা। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না।
সম্প্রতি পানি সঙ্কটের সবচেয়ে করুণ চিত্রগুলো গণমাধ্যমে আসছে আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি এবং দীঘিনালা থেকে। একটি পাতকুয়া কিংবা একটি টিউবওয়েলের পাশে শতাধিক পানির কলসির লাইন সত্যিই বেদনাদায়ক। যেসব স্থানের চিত্র গণমাধ্যমে আসেনি বা কম এসেছে সঙ্কট কিন্তু সেসব স্থানেও আছে। তীব্রতা হয়তো একটু কম বলে সেটা নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে না, তাই বলে সঙ্কট অস্বীকার করা যায় না। লংগদু উপজেলার গুলশাখালীর যুবলক্ষ্মীপাড়া-রহমতপুর দিয়ে একটি খাল বয়ে গেছে। এই খালের পানি গ্রীষ্মকালে কমে গেলেও কখনো একেবারে শুকিয়ে যায়নি আগে। গত কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে সেই খালের তলা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। অথচ, এই খালের পানিতে বিস্তীর্ণ জমিতে চাষাবাদ হতো। কোনো কোনো জমিতে বছরে তিন ফসল পরিপূর্ণভাবেই ফলানো যেত। কিন্তু এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকার কারণে বছরের প্রধান মৌসুম বোরো ধানের চাষ করতে পারছে না কৃষকরা। কুয়ো খনন করেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির অভাবে অনেকের বাগানের আম, লিচু ঝরে পড়ছে। পানি এবং ঘাস না থাকায় গবাদি পশু মরছে, যারা কোনো রকমে তাদের গবাদি পশু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন তাদের নিত্যদিন ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। অথচ, বিগত দশ বছর আগেও এই অবস্থা ছিল না। এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন করতেই হবে। তা নাহলে পাহাড়ের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ শুধু বাড়বেই।
এই অবস্থার কারণ কী? সেটা আগে খুঁজে বের করা দরকার। তাহলেই হয়তো সমাধান সম্ভব হবে। বলা হয়ে থাকে, বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলের ঝর্ণা এবং ঝিরিগুলো থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন চলছে। ফলে ঝর্ণা-ঝিরিগুলোর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। রাঙামাটির শুভলংয়ের ঝর্ণাগুলো থেকে পাথর উত্তোলন করা হয় না, কিন্তু এখানেও শুষ্ক মৌসুমে ঝর্ণা থেকে কোনো পানি ঝরতে দেখা যায় না। একসময় তো অবস্থা এমন ছিল না। আগেও শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে গেছে, তবে একেবারে শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। তাহলে কি পাহাড়ে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে, যার কারণে পাহড়ের গভীরে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে? সেটাই বা বলি কী করে? গত কয়েক বছরে তো অতি বৃষ্টির কারণে পাহাড়ধ্বসের ঘটনাও ঘটছে। তাহলে এ সঙ্কটের কারণ কী? আসলে প্রকৃত কারণ বের করতে হলে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। সেটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তবে আপাতত দৃষ্টিতে যা দেখা যায়, তাতে ধারণা করা যায়, নানা কারণেই পাহাড়ে পানির সঙ্কট বাড়ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো এখন অনেকটাই বৃক্ষহীন, যেদিকেই তাকানো যায় ন্যাড়া পাহাড় চোখে পড়ে। কোনো কোনো স্থান থেকে অবাধে তোলা হচ্ছে পাথর। অথচ, পাহাড়ের পরিবেশের আদ্রতা রক্ষায় বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই। আর ঝর্ণার উৎস পাথরও আজ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এর ফলে এখানকার পরিবেশ আজ চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে। তাই বর্ষায় অতি বৃষ্টি, গ্রীষ্মে অতি খরা পাহাড়ের নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। বাস্তবভিত্তিক ব্যাপক পরিকল্পনা ছাড়া এর থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই। পাহাড়ের পানির সবচেয়ে বড় উৎস কাপ্তাই লেকও আজ বিপন্ন। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের সাথে আসা বিপুল পলিমাটি তলায় জমা হওয়ার কারণে লেকের গভীরতা প্রতিনিয়তই কমছে। ফলে লেকের পানি ধারণ ক্ষমতাও কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। এই অবস্থায় কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প সচল রাখতে শুষ্ক মৌসুমে লেকের তলা পর্যন্ত শুকিয়ে ফেলতে হচ্ছে। এটাও এর চারপাশের পাহাড় বা সমভূমির স্বল্প গভীরের পানির স্তর মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আরো একটি কারণ হতে পারে। তাই, কাপ্তাই লেকের গভীরতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ের বিভিন্ন ঝর্ণা বা নালাগুলোর পাশে বাঁধ দিয়ে বর্ষার পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারের পরিকল্পনাও করা যেতে পারে। অবাধে পাথর উত্তোলন ঠেকাতে হবে, সর্বোপরি ব্যাপকভিত্তিতে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পাহাড়গুলোকে আবারো সবুজে ঢেকে দিতে হবে। তাহলেই পাহাড়ের বাসিন্দাদের পানির সঙ্কট থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হতে পারে।
পাহাড়ের বাসিন্দাদের পানি সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ এখন অতি জরুরি। তা নাহলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকায় এর বিরূপ প্রভাব অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর সরকারি পরিকল্পনা এবং বরাদ্দের সুফল পেতে হলে ‘পানি বেচে জমিদার’দের সরাতে হবে। কেননা, দুর্নীতিবাজদের মাধ্যমে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেও সুফল পাওয়ার আশা করা যায় না। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, পাহাড়ের মানুষদের জন্য সরকার এমন পানিব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করবে যাতে, আগামীতে কোনো টিউবওয়েল বা পানির গাড়ির পাশে শত শত কলসি নিয়ে মানুষকে লাইন ধরে অপেক্ষা করতে না হয়। পাশাপাশি, এখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের চাষাবাদ, গবাদি পশু পালনও যেন কষ্টসাধ্য না হয়।
sayedibnrahmat@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন