শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মাইক্রো-অটোর রাজত্ব মহাসড়কে

দূরপাল্লার বাস বন্ধ : বাস স্টপেজগুলো এখন মাইক্রো স্টপেজ! সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি নন বাস মালিকরা

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০২১, ১২:০১ এএম

করোনায় বিধি-নিষেধের মধ্যে বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লার বাস। অন্যান্য যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। চেকপোস্টগুলোতে নেই পুলিশের তৎপরতা। এই সুযোগে মহাসড়ক দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে অবাধে যাত্রী পরিবহন করে চলেছে মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা, মালবাহী পিকআপসহ বিভিন্ন যান। এতে করে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
এদিকে, কঠোর বিধি-নিষেধের মধ্যে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ রুটে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সরকার। তাতে বন্ধই থাকছে দূরপাল্লার বাস চলাচল। সরকারের এ সিদ্ধান্তে খুশি নন গণপরিবহন মালিকরা। করোনা মহামারিতে নিজেদের আর্থিক লোকসান পুষিয়ে নিতে তারা দূরপাল্লায় বাস চলাচলের অনুমতি চাইছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, সরকার দোকানপাট শপিংমল সবই খুলে দিয়েছে। আমরা বাস চলাচলের অনুমতি চেয়ে সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছি। এখন ৬ মে থেকে শুধু সিটিতে চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। এতে কী হবে? সিটিতে কয়টা গাড়ি চলে? সব তো দূরপাল্লার বাস। তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি যাতে ঈদের আগে দূরপাল্লার বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।
গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিং এ সাংবাদিকদের মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, মানুষের জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচল করবে। শুধু শহরের মধ্যেই বাস চলাচল করবে। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে পারবে না। তবে এখনই লঞ্চ ও যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান।
গত ৫ মে থেকে কঠোর বিধি-নিষেধ শুরুর দিন থেকে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন। এর ফলে পরিবহন খাতের বিপুল মানুষ জীবন-জীবিকা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এর আগে, গত বছরেও কয়েক দফা গণপরিবহন বন্ধ করে পরে আবার সীমিত আকারে চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সরকার। পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগ, এবার গণপরিবহন বন্ধের পর সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার কথা বলা হলেও তা শ্রমিকদের কাছে খুব একটা পৌঁছায়নি। আবার মালিকরাও এ সময়টিতে তাদের তেমন কোনো সহায়তা করেনি। অবশ্য এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি চলমান বিধি-নিষেধের মধ্যে প্রায় ৪৫ হাজার পরিবহন শ্রমিককে সহায়তা দিয়েছেন। এরই মধ্যে গণপরিবহন চালুসহ তিন দফা দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালে বিক্ষোভ মিছিল করে পরিবহন শ্রমিকরা। গত রোববার সকাল থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদ, ফুলবাড়িয়া, গাবতলী, মহাখালী বাস টার্মিনালে জড়ো হতে থাকেন পরিবহন শ্রমিকরা। তারা বিভিন্ন দাবি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন হাতে নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল অংশ নেন। শ্রমিকরা জানান, দীর্ঘদিন গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তারা পরিবার পরিজন নিয়ে খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দুই বেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার মতো টাকাও নেই। অনেকেই অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছেন। একই অবস্থা বাস মালিকদেরও। কোম্পানীগঞ্জ রুটের তিশা পরিবহনের মালিক খন্দকার ওমর ফারুক বলেন, করোনায় আমার মতো সাধারণ মালিকদের ভিক্ষার থালা নিয়ে রাস্তায় বসার মতো অবস্থা হয়েছে। অনেকেই ইতোমধ্যে বাড়িছাড়া হয়েছে। কেউ কেউ অভাবে গাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, গত বছর থেকে বাস বন্ধ রেখে আমরা সাধারণ মালিকরা দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছি। সরকার আমাদের কিস্তির সুদের টাকা মওকুফ করলেও রক্ষা পেতাম। সরকারি প্রণোদনার কথা উল্লেখ করে এই বাস মালিক বলেন, সবাই পাচ্ছে, কিন্তু আমরা বাস মালিকরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও সরকারি কোনো সাহায্য পাচ্ছি না। আমরা তাহলে কিভাবে বাঁচবো? দূরপাল্লার বাস বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটাতে আমরা মোটেও খুশি না। সিটি সার্ভিসে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না, দূরপাল্লার বাস কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলাচল করেছে। তাহলে দূরপাল্লার বাস চললে অসুবিধা কি ছিল? তিনি অবিলম্বে দূরপাল্লার বাস চলাচলের অনুমতি প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
এদিকে, করোনা ভাইরাসের সংক্রামণ রোধে সরকার তিন দফায় সারা দেশে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছেন। চলমান লকডাউনে সংক্রামণের ঝুঁকি এড়াতে গণপরিবহন বন্ধ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ দেশের সবগুলো মহাসড়কে গণপরিবহন বলতে শুধুমাত্র বাস চলাচলই বন্ধ রয়েছে। বাসের বিকল্প হিসেবে অবাধে চলছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশা, লেগুনা, পিকআপভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন। এসব যানবহানে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। সেদিকে কারো কোনো নজর নেই।
জানা গেছে, মহাসড়কের বাস স্টপেজগুলো এখন মাইক্রোবাস স্টপেজে রূপ নিয়েছে। প্রতিটি স্টেশনের দুই ধারে সারি-সারি দাঁড়িয়ে আছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, লেগুনা। আবার মহাসড়ক দখল করে ওই প্রাইভেট পরিবহনগুলো এলোপাথারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় স্টেশন এলাকাগুলোতে যানজটও সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সিএনজি অটোরিকশা ও মাইক্রোবাসের রাজত্ব চলছে। ঢাকার পোস্তগোলা থেকে যাত্রী তুলে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করে চলেছে শতাধিক মাইক্রোবাস ও কয়েকশ’ অটোরিকশা। প্রতিটি মাইক্রোবাসে ১৩-১৪ জন, প্রাইভেটকারে ৪-৫ জন যাত্রী নিয়ে গাদাাগাদি করে ছুটে চলছে। এতে করোনা সংক্রামণ আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। প্রতিটি স্টেশন এলাকায় টোলের নামে চাঁদা দিয়ে হাইওয়ে পুলিশের সামনেই ওইসব যানবাহনগুলো অবাধে চলাচল করছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ময়নামতি সেনানিবাস, নিমসার, চান্দিনা, মাধাইয়া, ইলিয়টগঞ্জ, গৌরীপুর বাস স্টেশন এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি স্টেশনে মহাসড়ক দখল করে সারি সারি মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকারে দূরপাল্লার যাত্রী ওঠানো ও নামানোর কাজ চলছে। ময়নামতি সেনা নিবাস এলাকা থেকে ঢাকায় ৩৫০-৪০০ টাকা, চান্দিনা স্টেশন এলাকা থেকে ৩০০-৩৫০ টাকা ভাড়ায় যাত্রী তুলছে। ওইসব পরিবহনগুলোর সিরিয়াল নির্ধারণের জন্য কেরানি পদবীধারী চাঁদাবাজও রয়েছে! এ প্রসঙ্গে মাইক্রোবাস চালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৮ জন যাত্রী নিয়ে রওয়ানা হয়েছি, চান্দিনা স্টেশনে এসে আরো ৫ জন তুলি। স্টেশনে কেরানিদের যাত্রীপ্রতি ২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ সেখানে আপনি কেন এতো যাত্রী নিয়ে ছুটছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কি করবো, এখন আর বিয়া-সাদিও নাই, বিদেশ থেকে যাত্রীও আইয়ে না। অবসর আছি, আর মহাসড়কে প্রচুর যাত্রী এই সুযোগে গাড়ি চালাইতাছি। হাইওয়ে পুলিশ ইলিয়টগঞ্জ ফাঁড়ির ইন-চার্জ (ইন্সপেক্টর) সালেহ আহমেদ বলেন, স্টেশন এলাকাগুলোতে যখনই আমাদের টহলটিম যাচ্ছে মুহূর্তেই খালি হয়ে যাচ্ছে। আমরা যখন চলে আসি আবার একই অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। আর যেগুলো সামনে পাচ্ছি আটক করে মামলাও দিচ্ছি। হাইওয়ে পুলিশ ময়নামতি ক্রসিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনিছুর রহমান বলেন, প্রতিদিন ওইসব যান আটক করে মামলা দিচ্ছি। বিভিন্ন অযুহাতে মানুষ ওইসব যানে যাতায়াত করছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন