ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে একটি হলো যাকাত। এ যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদের উপর দরিদ্রদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ধনীদের সম্পদে রয়েছে প্রয়োজনশীল প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার (সুরা আযযারিয়াত: ১৯)। বাংলাদেশের বিত্তশালী মানুষ যদি সঠিকভাবে হিসাব করে যাকাত আদায় করতেন তাহলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে স্বাবলম্বী করে তোলা সম্ভব হতো। কিন্তু অনেক ধনী মানুষই যাকাত আদায় করেন না। আবার যারাও করেন তাদের মধ্যে অনেকেই সম্পদের হিসাব না করে রমজান মাস এলে যাকাতের নাম করে কিছু দান করেন। কিন্তু এর দ্বারা ফরজ যাকাত আদায় হবে না, দারিদ্র্য বিমোচনেও সত্যিকারের সহায়ক হবে না। মহানবী কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, কারো কোনো প্রতিবেশী অভুক্ত থাকলে এবং সে পেট পুরে খেতে থাকলে তার সারা জীবনের ভালো কাজ আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না।
ধন-মালের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তা’আলা। মানুষ এতে তার প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করছে মাত্র। তাই প্রকৃত মালিকের হুকুম তামিল করাই প্রতিনিধির দায়িত্ব। সমাজের গরীব, মিসকীন, অসহায়, অনাথ মানুষের প্রতিপালক যেহেতু তিনি তাই এসব মালের প্রতি তাদের হক রয়েছে। কাজেই সর্বপ্রকার ধন-মাল এ হুকুমের অন্তর্ভুক্ত এবং সব ধনী ব্যক্তিই যাকাত দিতে বাধ্য। একে অস্বীকার করা মূলত ইসলামকে অস্বীকার করারই শামিল। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার নির্দেশ রয়েছে। তাই আল্লাহর হুকুম পালন করার লক্ষ্যে নামাযের সাথে সাথে সম্পদের যাকাত নিয়মিত আদায় করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যেসব লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাদেরকে কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে নিমজ্জিত করে দেবেন। যাকাত না দেওয়ার ভয়াবহ শাস্তির কথা কোরআন ও হাদিসে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যাকাত আদায় না করে কেউ আল্লাহর রহমত, বরকত ও মাগফিরাত পাওয়ার অধিকারী হতে পারে না।
সূরা তাকাসূরে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অপর থেকে বেশি পাওয়ার চিন্তায় ব্যস্ত আছ, এমনকি এ অবস্থায় তোমরা কবরের বাসিন্দা হবে।’ তাহলে বুঝা যায়, প্রত্যেক মানুষের সুপ্ত আশা যে, সে সম্পদশালী হোক অথবা কমপক্ষে দুনিয়াতে খেয়ে পরে চলার মতো একটা অবস্থা থাক। এ জন্যই তার এত পরিশ্রম। দুনিয়ার জীবনে কেউ যদি উন্নতির দিকে পা বাড়ায় তাহলে তার মনে আনন্দ জাগে। কাজ-কর্মে আরো প্রেরণা পায়। সমাজে মর্যাদা বাড়ে। দায়-দায়িত্বের ভার বেড়ে যায়। আর্থিক উন্নতির সাথে সামাজিক উন্নতিও তার বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা মানুষের সহজাত কাম্য। পক্ষান্তরে কেউ যদি দিন দিন অবনতির দিকে যায়, আর্থিক অনটনে পড়ে, পারিবারিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, আয় উপার্জনের পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়, তখন তার এ অবস্থা কারো কাম্য নয়। সবাই চায় মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে। তাই সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতায় কেউ টিকে, কেউ টিকে না। এ সম্পদের মালিক স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা। যাকে ইচ্ছা তাকে দেন বেশুমার। এখানেই তার পরীক্ষা। আপনি যতটুকু সম্পদ পেয়েছেন বা যার মালিক বলে দাবি করেন তার কতটুকু হক আদায় করতে পেরেছেন তা ভেবে দেখা দরকার।
যাকাত ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম উপাদান। পবিত্র কোরআনের ৩০টি আয়াতে যাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি আয়াতে নামাজের সঙ্গে সঙ্গে এবং দুটি আয়াতে আলাদাভাবে। যাকাত শব্দটির অর্থ পবিত্রকরণ, পরিশুদ্ধকরণ, ক্রমবৃদ্ধি ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় ধনীদের ধনমালে আল্লাহর নির্ধারিত অবশ্য দেয় অংশকে যাকাত বলে। যাকাত একদিকে যাকাতদাতার ধনসম্পদ পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে। অন্যদিকে, দরিদ্রদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। যাকাত ফরজ হওয়ার পরও যদি কেউ তা প্রদান না করে তার ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, যারা সোনা বা রূপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের কপালের পার্শ্বদেশ এবং পিঠে দাগ দেয়া হবে সেদিন বলা হবে এটাই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর। (সুরা তওবা: ৩৪-৩৫)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ যাকে ধনসম্পদ দান করেছেন সে যদি তার যাকাত আদায় না করে তাহলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিষধর অজগরের রূপ ধারণ করবে, যার দু’চোখের উপরে দুটি কালো চিহ্ন থাকবে। কিয়ামতের দিন তা তার গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পাশে কামড়াতে থাকবে এবং বলবে আমিই তোমার সম্পদ, আমিই পুঞ্জীভূত ধন (বুখারি শরীফ)।
কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দিতে হবে: যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দিতে হবে, বা যাকাত ফরজ হয়, শরীয়াতের ভাষায় তাকে ‘নিসাব’ বলা হয়। যাদের সারা বছরের খরচাদি বাদে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (প্রায় ৬১৩ গ্রাম) বা সাড়ে সাত তোলা সোনার (প্রায় ৮৬ গ্রাম) মূল্যে সমপরিমাণ সম্পদ থাকে তাকে শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে হিসাব করে যত টাকা হয় তা যাকাত দিতে হবে। এটা তার উপর ফরজ।
সম্পদের হিসাব করার সময় অত্যাবশ্যকীয় ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বাদে হিসাব করতে হবে। যেমন: ১. বসত বাড়ি। ২. পরিধেয় বস্ত্র। ৩. বাড়ির আসবাবপত্র। ৪. যাতায়াতের যানবাহন (সাইকেল, মটর সাইকেল, কার ও মাইক্রো যা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার্য)। ৫. ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি (বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল ইত্যাদি যা শত্রুর মোকাবেলায় বা আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন)। ৬. খাদ্যদ্রব্য। ৭. সোনা, রূপার গহনা ছাড়া অন্যান্য সাজসজ্জা। ৮. ব্যক্তিগত খরচের জন্য রাখা অর্থ। ৯. বই পত্র। ১০. উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত মেশিন ও যন্ত্রপাতি। ১১. কৃষি কাজের জন্য ব্যবহৃত পশু।
এগুলো ছাড়া যদি হিসাবমূল্যে সম্পদ সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার বা সাড়ে সাত তোলা সোনার মূল্য পরিমাণ হয় তাহলে যাকাত দিতে হবে।
নবী করিম (সা.) যাকাতকে ইসলামের সেতু হিসেবে অভিহিত করেছেন। রসুল (সা.) বলেছেন, প্রতিটি বস্তুরই যাকাত রয়েছে আর মানুষের দেহের যাকাত হলো রোজা (ইবনে মাজা)। যাকাত আদায় করলে যেমন মানুষের উপার্জিত ধন সম্পদ পবিত্র হয়, ঠিক তেমনি রমজান মাসে সিয়াম সাধনার ফলে সারা শরীর ও মন পবিত্র হয়ে যায়।
যাকাতের ব্যয়ক্ষেত্র: দরিদ্র বা ফকির ২. মিসকীন ৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী ৪. মনজয় করার প্রয়োজনে ৫. ক্রীতদাসের মুক্তিপণ ৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি এবং ৭. মুসাফির।
যাকাত সুপরিকল্পিতভাবে ব্যয়ের মাধ্যমে বঞ্চিত ও দুঃস্থ মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন করতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার, কলামিস্ট ও গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন