‘আত্মঘাতী বাঙালি’ নামের একটি প্রবন্ধ লিখে তুমুল আলোচিত হয়েছিলেন কোলকাতার বাংলা সাহিত্যের অন্যতম লেখক নিরোধ সি চৌধুরী। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় নিবন্ধটি ছাড়া হওয়ায় পত্রিকার ওই সংখ্যা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিরোধ সি চৌধুরী ৩২ থেকে ৩৫ বছর আগে হয়তো বাংলাদেশের কিছু মানুষের আত্মঘাতী মানসিকতা বুঝতে পেরেই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে লকডাউনে সবকিছু বন্ধের পরও রাস্তায় মানুষের চলাফেরা এবং ঈদ উপলক্ষে ঢাকা থেকে ঘরে ফেরার দৃশ্য দেখলেই বোঝা যায়।
লকডাউনের কারণে দূরপাল্লার গণপরিবহণ বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে লোকজনকে চলাফেরা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে মানুষ যাতে কর্মস্থল ত্যাগ করে যানবাহনে গাদাগাদি করে ভ্রমণ করতে না পারেন সে লক্ষ্যে মাত্র তিন দিনের বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও গ্রামে ছুটছেন মানুষ। শিমুলিয়া, পাটুরিয়া, মাওয়া, বাংলাবাজার ফেরি ঘাট লোকারণ্য। দিনে ফেরি বন্ধ রাখার ঘোষণার পরও দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে ছোট যানবাহনে ফেরি ঘাটে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন। কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না; সামাজিক দূরত্ব দূরের কথা ১০ সিটের এক মাইক্রো বাসে ২০ যাত্রী ভ্রমণ করেন। যমুনা সেতুতে গতকাল রেকর্ড সংখ্যক যানবাহন পারাপার হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, সায়দাবাদ ও যাত্রাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে গণপরিবহন না থাকলেও ঘরে ফেরা মানুষ গন্তব্যে যাচ্ছেন পাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলে। প্রতিটা এলাকায় যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হচ্ছে তিনগুণ বেশি। কুমিল্লা যেতে সাধারণ সময়ের ২০০ টাকার ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৬০০ টাকা। ফেনী যেতে ৩০০ টাকার ভাড়া দিতে হচ্ছে ১২০০ টাকা। নোয়াখালী যেতে ৭০০ টাকার ভাড়া আজ ২ হাজার টাকা। একই সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাড়াও গুনতে হচ্ছে তিনগুণ বেশি।
মহাখালীর যাত্রীরা আবদুল্লাহপুর গিয়ে ছোট ছোট বিভিন্ন যানবাহনে গাদাগাদি করে গ্রামে যাচ্ছেন। গাবতলীর যাত্রীরা পায়ে হেটে ব্রীজ পার হয়ে আমিন বাজার যাচ্ছেন। সেখান থেকে দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি ভাড়ায় গ্রামে যাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকা থেকে বের হওয়ার প্রতিটি পথে গতকাল দেখা গেছে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে করোনার মধ্যেই যে যার মতো করে গ্রামের দিকে ছুটছেন। অনেকেই ঘর থেকে বের হয়েছেন গ্রামের পথে কিভাবে যাবেন নিজেও জানেন না। অনিশ্চয়তার মধ্যেই ছুটেছেন ছেলেমেয়ে নিয়ে। শিশু বৃদ্ধরা রাস্তায় নিদারুণ ভোগান্তিতে পড়েন। তারপরও করোনার মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে যেন গ্রামে ফেরা চাই-ই।
চলামান লকডাউনের (বিধি-নিষেধ) মধ্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য গত শুক্রবারে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরিঘাটে ছিল যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। এর প্রেক্ষিতে শুক্রবার মধ্য রাতে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে দিনে ফেরি চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয় বিআইডব্লিউটিএ। তবে শুধুমাত্র রাতে পণ্যবাহী পরিবহন পারাপারের কথা বলেছিল সংস্থাটি। এরপরেও গতকাল সকাল থেকে ঘরমুখো যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটে। এ নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে প্রতিবেদন
মুন্সীগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট থেকে ১১ হাজার যাত্রী নিয়ে তিনটি ফেরি মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গতকাল সকাল ৯টা ৫ মিনিটের দিকে ফেরি কুঞ্জলতা ছেড়ে যায় শিমুলিয়া ঘাট থেকে। এরপর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রো-রো ফেরি এনায়েতপুরী ও পৌনে একটার দিকে শিমুলিয়া ঘাট ছেড়ে বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে রওনা দেয় রো-রো ফেরি শাহপরান।
বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম শফিকুল ইসলাম দাবি করেন, অ্যাম্বুলেন্স বহন করে ফেরিগুলো শিমুলিয়া ঘাট ছেড়ে গেছে। তবে অ্যাম্বুলেন্সের রোগী ও লাশ বহনকারী কিছু যাত্রী তো রয়েছে। তিনি বলেন, এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
ঘাট সূত্রে জানা গেছে, দুপুর ১২টা ৪৩ মিনিটের দিকে প্রায় ৩ হাজার যাত্রী ও সাতটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছেড়ে গেছে ফেরি শাহপরান। এর আগে ফেরি এনায়েতপুরী শিমুলিয়া ঘাট থেকে প্রায় ৪ হাজার যাত্রী নিয়ে দুপুর ১২টা ২৩ মিনিটের সময় ছেড়ে যায়। সকাল ৯টা ৫ মিনিটের দিকে ফেরি কুঞ্জলতা প্রায় ৪ হাজার যাত্রী নিয়ে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
জানা যায়, ঘাটে অপেক্ষমান যাত্রীরা ফেরি এনায়েতপুরী ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরিতে উঠার জন্য শিমুলিয়া ৩নং ঘাটে ধাক্কাধাক্কি করে ভিড় জমাতে থাকে। ফেরির গেট খোলার আগেই গেটের পাশ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে যাত্রীরা। এছাড়া গেট দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে না উঠতে পেরে অনেকে পানি দিয়ে হেঁটে একে অন্যের সহযোগিতায় ফেরিতে ওঠে। ফেরিটিতে প্রায় ৫ হাজার যাত্রী পার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে দুপুর ১২.৪৩ মিনিটের দিকে ছেড়ে যায় ফেরি শাহপরান। এ ফেরিতে ৭টি অ্যাম্বুলেন্স পারাপার হয়। তবে ওই সময় যাত্রীর চাপ অনেকটা কম থাকায় যাত্রীদের স্বাভাবিকভাবে হেঁটে ফেরিতে উঠতে দেখা গেছে।
এদিকে, শিমুলিয়া ঘাটে ঘরমুখী যাত্রীর চাপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। ভোর থেকেই দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীরা শিমুলিয়া ঘাটে ভিড় করতে থাকেন। ভোর থেকেই ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েন তারা। এদের মধ্যে অনেকেই ফেরির অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে অবস্থান করতে থাকেন। আবার কেউ কেউ ঢাকায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। তবে সকাল ৯টার দিকে ফেরি কুঞ্জলতা অ্যাম্বুলেন্স বোঝাই করে বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশে রওনা দিলে তাতে শত শত যাত্রীকে পদ্মা পাড়ি দিতে দেখা গেছে।
বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়েত আহমেদ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফেরি ছেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, বেশ কিছু লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ছিল। তাছাড়া জরুরি কয়েকটি যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় ঘাটে অবস্থান করছিল। সেগুলো পারাপারের জন্যই ফেরি ছাড়া হয়েছে। এর মধ্যে ঘরমুখো যাত্রীদের চাপ ছিল ঘাটে। সড়কে তো কেউ যাত্রীদের আটকাচ্ছে না। কাজেই ঘরমুখো মানুষ শিমুলিয়া ঘাটে আসছেই। অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে যাত্রীরা ফেরিতে উঠলে তো আটকে রাখা যায় না। কাজেই লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে ফেরিতে অসংখ্য যাত্রী উঠে পদ্মা পাড়ি দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা হয়েছে। এরপর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুধুমাত্র লাশ ও রোগী ভর্তি অ্যাম্বুলেন্স পারাপারের জন্য ফেরি চলবে।
মাওয়া ট্রাফিক পুলিশের টিআই হিলাল উদ্দিন জানান, শিমুলিয়া ঘাটে ৪-৫শ’ পণ্যবাহী ট্রাক ও ক্যাভার্ড ভ্যান রয়েছে। তিনটি ফেরি ছেড়ে যাওয়ায় যাত্রীর চাপ অনেকটাই কমেছে।
মানিকগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে গতকাল সকাল থেকে উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। পাটুরিয়া ঘাটে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে হাজার হাজার যাত্রী। হঠাৎ ফেরি বন্ধের সিদ্ধান্ত না জেনে হাজার হাজার মানুষ ঘাটে গিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। যাত্রীদের শামাল দিতে হিমশিমে পড়ে প্রশাসন। পাটুরিয়া ঘাটে আসা যশোরগামী আব্দুল হান্নান বলেন, রাতে ঘাটে এসেছি। আসার পর শুনতে পারলাম ফেরি বন্ধ। এখন তো ফেরি চলতেছে না। অপেক্ষায় আছি কখন ফেরি চলবে। খুব ভোগান্তিতে আছি।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম জিল্লুর রহমান জানান, গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে সাধারণ যাত্রী ও ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বেশি দেখা দেয়। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় বেড়ে গেছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও। সেই সঙ্গে ফেরিতে গাদাগাদি করে যাত্রী পার হচ্ছিল। এসব কারণে গতকাল সকাল ৬টা থেকে সাময়িকভাবে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তিনি আরো জানান, সাধারণ যাত্রীদের জন্য বন্ধ থাকলেও এই সময় অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী গাড়ি ও জরুরি কাজে ব্যবহৃত যানবাহন পার হতে পারবে। আর সন্ধ্যার পর থেকে জরুরি পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার করা হবে। শিবালয় থানার ওসি ফিরোজ কবির জানান, ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফেরিতে কোনোভাবেই যেন যাত্রী পার না হতে পারে, এ ব্যাপার পুলিশ কাজ করছে।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, আর মাত্র কয়েক দিন পরেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। তাই দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে বেড়েছে ঢাকাগামী ও ঢাকা ফেরত যাত্রীদের চাপ। দৌলতদিয়া প্রান্তে রয়েছে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। বিআইডব্লিউটিসির হঠাৎ ফেরি চলাচল বন্ধের ঘোষণায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা।
নদী পারের অপেক্ষায় দৌলতদিয়া প্রান্তে আটকা পড়েছে অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসসহ কয়েকশ’ যানবাহন। এছাড়া আটকা পড়েছে জরুরি ঢাকামুখী শত শত যাত্রী। গতকাল সকালে দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটের পল্টন ও ঘাটের এপ্রোচ সড়কে অপেক্ষারত যাত্রী ও যানবাহনের এমন চিত্রই দেখা যায়। অবশেষে বেলা ১১টার দিকে ঘাট কর্তৃপক্ষের অনুমতি অনুযায়ী জরুরি অ্যাম্বুলেন্স ও ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি নিয়ে চলাচল করেছে ছোট ফেরি রজনীগন্ধা।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক ফিরোজ খান জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সকাল ৬টা থেকে ফেরি চলাচল সস্পূর্ণ বন্ধ রেখেছেন। দিনে কোনো যানবাহন বা যাত্রী পারাপার করবেন না। তবে অ্যাম্বুলেন্স এক সঙ্গে ৮-১০টি হলে ছোট ফেরি দিয়ে সেটি পার করবেন। এছাড়া রাতে পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার করা হবে। তিনি জানান, ফেরি বন্ধ থাকায় দৌলতদিয়া প্রান্তে যাত্রী ও ছোট যানবাহনের কিছুটা চাপ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন