মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও প্রাসঙ্গিক কথা

মেহেদী হাসান পলাশ | প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০২১, ১২:০১ এএম

গত ১১ এপ্রিল হঠাৎ খবর পাওয়া যায় বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত। তিনি দুর্নীতি মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কারাবাস থেকে সরকারের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে নিজ বাসভবনে বসবাস করছিলেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এরপর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) ধারায় দন্ড স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়। শর্ত ছিলো, তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। তাকে দেশেই থাকতে হবে। পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে মুক্তির সময় আরও ছয় মাস বাড়ায় সরকার। এ বছরের মার্চে তৃতীয়বারের মতো ছয় মাস মেয়াদ বাড়ানো হয়। এমনিতেই নানাবিধ রোগে আক্রান্ত বেগম খালেদা জিয়ার করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর দেশবাসীকে সঙ্গতকারণে যারপরনাই উদ্বিগ্ন করে তোলে। তাঁর অসুস্থতার খবর ও রোগ মুক্তির কামনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে স্থান লাভ করে।

খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খবর তার পরিবার থেকে প্রথমে অস্বীকার করা হয়। পরে দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে স্বীকার করা হয়। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার মতো জটিল খবর পরিবারের পক্ষ থেকে অস্বীকার ও দলের পক্ষ থেকে স্বীকার কেন করা হলো, সে এক বিরাট ধাঁ ধাঁ হিসেবে রয়ে গেলো। একইভাবে প্রশ্ন রয়ে গেলো, খালেদা জিয়ার করোনা টেস্টের রিপোর্ট তার পরিবারের নিকট যাওয়ার আগে গণমাধ্যমের হাতে কীভাবে গেলো? আক্রান্ত হওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বেগম জিয়ার চিকিৎসকগণ তাকে আপাতত বাসায় থেকে চিকিৎসার পরামর্শ দিলেও পরবর্তীকালে তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ শনাক্ত হলে ২৭ এপ্রিল এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর তার শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে ডাক্তারগণ তাকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার পরামর্শ দিলে সরকার সাথে সাথে রেসপন্স করে। পরিবারের আবেদন করার আগেই সরকারের একাধিক মন্ত্রী গণমাধ্যমে ঘোষণা দেন, খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসার জন্য আবেদন করলে সরকার বিষয়টি ‘মানবিকভাবে’, ‘সহানুভূতির সাথে’ ‘ইতিবাচকভাবে’ দেখবে। এমতাবস্থায় খালেদা জিয়ার ছোটভাই ৫ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে দেখা করে তার বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেন। এ আবেদন গ্রহণ করেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার আবেদনটি তারা ‘পজিটিভলি’ দেখছেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এ সমস্ত বিষয়ে অত্যন্ত উদার এবং আমরা পজিটিভলি দেখার চেষ্টা করব অবশ্যই। পজিটিভলি দেখছি বলেই তাকে (খালেদা জিয়া) দন্ডাদেশ স্থগিত করে চিকিৎসার সুবিধা আমরা করে দিয়েছি, যাতে উন্নত চিকিৎসা পায়, তার পছন্দমতো।’ এতে দেশবাসীর মধ্যে একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে, এবারে হয়তো তিনি চিকিৎসার জন্য সত্যিকারভাবেই বিদেশে যেতে পারছেন। দেশবাসী দেশে একটি সুস্থ ও মানবিক রাজনৈতিক সৃষ্টির আভাস পেয়ে আশ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার আবেদন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর টানা চারদিন আইনী নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত ৯ মে জানান, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা ও দন্ডাদেশ স্থগিত করে যে শর্তে তাকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তা শিথিল করে এখন তাকে বিদেশে যেতে দেওয়ার ‘সুযোগ নেই’। আইনমন্ত্রীর এ মতামত পাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে তার ভাই শামীম এস্কান্দারের আবেদনটি গ্রহণ করতে পারলাম না।’ এ ব্যাপারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশে কারুর দন্ড স্থগিত, পুরো বা আংশিক মওকুফ করে দিয়ে মুক্তি দিতে পারে। শর্ত সাপেক্ষে দিতে পারে আবার শর্তহীনভাবেও দিতে পারে। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) যেহেতু দন্ডিত, তাই সরকার এই আইনেই তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে। তাকে দেশের বাইরে না যাওয়ার শর্ত তুলে শর্তহীন করার ক্ষমতা এই আইনেই সরকারকে দেয়া হয়েছে।’ খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদন গ্রহণ করে এই দুই মন্ত্রী বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা হবে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন। এমনকি তার পাসপোর্টের মেয়াদ পার হয়ে গেলে পাসপোর্ট নবায়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তার পথে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও আইরিস স্ক্যান করে ই-পাসপোর্ট নেওয়ার সুযোগ না থাকায় সরকার তার জন্য ম্যানুয়াল পাসপোর্ট তৈরি করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এমনকি এ লক্ষ্যে ছুটির মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় পাসপোর্ট অফিস খুলে খালেদা জিয়ার পাসপোর্ট নবায়ন করা হয় বলে জানা যায়। এহেন পরিস্থিতিতে কোন প্রেক্ষাপটে বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা আটকে গেলো, তা এখনো বিরাট রাজনৈতিক প্রশ্ন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য এর একটি ব্যাখ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য সরকার আজ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ মির্জা ফখরুলের এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন সরকার পক্ষ। কিন্তু একটি প্রশ্ন অত্যন্ত সঙ্গত যে, বেগম খালেদা জিয়ার পরিবাবের আবেদন রিসিভ করার পরও আইনমন্ত্রী যখন বারবার বলেছিলেন, বিষয়টি সরকার মানবিক/ ইতিবাচকভাবে দেখবে, তখন কি তার মতো ফৌজদারী আইনে বিখ্যাত আইনজীবী সাধারণ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার সীমা-পরিসীমা জানতেন না বলে ধরে নিতে হবে? এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, যারা এখন খালেদা জিয়ার বিষয় নিয়ে আদালতে যেতে বলছেন তারা আসলে ঠিক বলছেন না। কারণ এটা তো আদালতের সিদ্ধান্ত নয়। খালেদা জিয়াকে তো নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আর সেই আইনে শর্ত দেয়া বা না দেয়া সরকারের ইচ্ছা। এখন শর্ত তুলে নিলেই তো খালেদা জিয়া বিদেশ যেতে পারেন। তার মতে, ‘এটা রাজনৈতিক কারণে করা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী , স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি ৪০১ জানেন না! এখানে কোনো সিগন্যাল ছিলো তাই তারা প্রথমে সহানুভূতির সাথে বিবেচনার কথা বলেছেন। পরে হয়তো কোনো কারণে তারা উল্টে গেছেন?’
আইনজীবী মনজিল মোরসেদের ভাষায় কোন কারণে তারা উল্টে গেলেন তা সুনির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও কারণটি যে রাজনৈতিক তা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন বিএনপি নেতৃবৃন্দ। সরকার যে বলছে, ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০১ ধারা মতে, সাজাপ্রাপ্ত আসামীর বিদেশে প্রেরণের সুযোগ নেই, ইতিহাস কিন্তু তা সাক্ষ্য দেয় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর একাধিক নজির রয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাংবাদিক সম্মেলন করে সাজাপ্রাপ্তদের বিদেশে চিকিৎসার নজির তুলে ধরে বলেছেন, ‘আমাদের প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আবদুর রব জেলে ছিলেন। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেব তাকে এই আইনে মুক্তি দিয়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য তাকে জার্মানি পাঠানো হয়েছিল। এরপর আমাদের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ২০০৮ সালে সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন। বর্তমান সরকার তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিল। খালেদা জিয়ার বেলায় কেন এই সমস্ত খোঁড়া যুক্তি?’ সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে শুধু বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণই নয় মন্ত্রিসভায় মেয়াদ পূর্ণ করতেও এই সরকারের আমলেই দেশবাসী দেখেছে। বিভিন্ন দন্ডপ্রাপ্ত অনেক আসামীকেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেতে দেখেছে, যার মধ্যে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্তরাও রয়েছেন। অনেক কুখ্যাত দুর্নীতিবাজকে রাষ্ট্রীয় অনুকম্পা পেতে দেখেছে জাতি। সেখানে তিন তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, দুই বারের বিরোধী দলীয় নেত্রী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্স প্রধানের স্ত্রীকে, যিনি ‘প্রশ্নবোধক’ দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত, তার দন্ড স্থগিত করে তাকে মানবিক বিবেচনায় বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেফুয়া যেতো না- এটা দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা সম্পর্কে বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাবের সাবেক মহাসচিব ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) তো অস্টিও আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। গলার মেরুদন্ড শক্ত হয়ে যাচ্ছে। বাম পাশের মেরুদন্ডে সমস্যা আছে। তার বাম হাত ও ঘাড়ের দিক শক্ত হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘উনার দুই হাঁটু প্রতিস্থাপন করা আছে। হাঁটুর জয়েন্ট প্রতিস্থাপন করলে পরবর্তীতে জয়েন্টগুলোর মধ্যে সমস্যা হয়, সেই সমস্যায় তিনি ভুগছেন। এছাড়া উনার অল্প পরিমাণ ডায়াবেটিস আছে। তিনি ব্লাড প্রেসারের ওষুধও অল্প খান। উনার বাম চোখেও সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে লাল হয়।’ এছাড়াও গত বছরের শুরুর দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালে থাকাকালে তার সঙ্গে দেখা করে বোন সেলিমা ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘তিনি হাত সোজা করতে পারছেন না। তার হাত বাঁকা হয়ে গেছে, আঙুল বাঁকা হয়ে গেছে, খুবই খারাপ অবস্থা এবং দুই হাঁটু অপারেশন করা হয়েছে। হাঁটুতেও ব্যথা, হাঁটু ফুলে গেছে। তিনি পা ফেলতে পারছে না।’ কারামুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন ছবিতেও দেশবাসী তার হাত বাঁকা হওয়ার ছবি দেখতে পেয়েছে। এসব রোগে দেশে সুচিকিৎসা না পেয়ে তিনি দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদী আরবসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নিয়েছেন। তার হাঁটুতে সার্জারি করা হয়েছে তাও বিদেশের মাটিতে। আসলে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে সামর্থবান লোকেরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমন করে থাকেন। শুধু ভারত সরকার মেডিক্যাল ট্যুরিজমের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বছরে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে থাকে। এ ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশের হিসাব এর থেকে আলাদা। সরকারের একাধিক মন্ত্রী, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও একাধিকবার বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। তিনিও মইন-ফখরুদ্দিন সরকারের আটকাবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন ‘চিকিৎসার উদ্দেশ্যে’। তাই খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের বিষয়টি অভিনব বা অশ্রুতপূর্ব নয়।

শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার বিয়োগান্ত ঘটনার পর উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে আগমন ঘটেছে। তারপর তারা দুজনই দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা ও সংগ্রাম করেছেন। এই রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় তারা যে শুধু একে অন্যের প্রতিদ্ব›দ্বী, তাইই নন, সহযোদ্ধাও বটে। তাদের একসাথে বিভিন্ন সময় দুঃশাসন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখেছে দেশবাসী। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ৮ দলের মিছিলে নেতৃত্ব দিতেও দেখা গেছে খালেদা জিয়াকে। সময়টা ১৯৮৮ সাল, ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘিতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি চালায় এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী। মারা যায় ২৪ জন। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ২৬ জানুয়ারি ৮ দলীয় জোটের প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকা হলেও শেখ হাসিনা সেই সমাবেশে নানা কারণে আসতে পারেননি। কিন্তু ৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীর তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বেগম খালেদা জিয়ার কানে যখন এই বার্তা পৌঁছায়, তখন তিনি আওয়ামী লীগ তথা ৮ দলীয় জোটের নেতা কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য সেই সমাবেশে ছুটে যান। পরে তার নেতৃত্বে রাজপথে সেদিন মিছিল করেন আওয়ামী লীগের ও জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ। আবার ১/১১ এরপর মইন-ফখরুদ্দীনের সরকার খালেদা জিয়া ও হাসিনাকে আটক করে সংসদভবন এলাকার পাশাপাশি দুইটি বাড়িতে অন্তরীণ রাখে। সেখানে তাদের মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এক পর্যায়ে সরকার শেখ হাসিনাকে বিদেশে প্রেরণ করে ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ আখ্যা দিয়ে তার দেশে ফেরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর খালেদা জিয়াকে বিদেশে প্রেরণ করার চেষ্টা করলে তিনি বিদেশে যেতে অস্বীকার করেন। তার অনমনীয়তার কারণে মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীন গং খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে ব্যর্থ হলে শেখ হাসিনাকেও দেশে আসার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। সেদিন যদি খালেদা জিয়া সরকারি চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বিদেশে পাড়ি জমাতেন তাহলে বাংলাদেশের আজকের ইতিহাস ভিন্ন পথে পরিচালিত হতো। এমনকি এবারে যখন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানা যায়, তখন তৃণমূল থেকে শুরু করে আওয়ামী শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদেরও দেখা যায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে খালেদা জিয়ার আরোগ্য কামনা করতে, আল্লাহর কাছে দোয়া করে স্ট্যাটাস দিতে। এই সহানুভূতি প্রলম্বিত করলেই বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিলো।

মনে রাখা প্রয়োজন, অনিচ্ছা সত্তে¡ও বাংলাদেশ বৈশ্বিক রাজনীতির এক ভয়াবহ চক্রব্যুহে ঢুকে গেছে। মার্কিন-চীন স্নায়ুযুদ্ধ এবং যুদ্ধের অংশ হিসেবে ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগরে নিয়ন্ত্রণে মার্কিন, চীন, ভারতের কৌশলগত লড়াইয়ে বাংলাদেশের অবস্থানগত গুরুত্বই তাকে এই চক্রব্যুহে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই চক্রব্যুহের তপ্ত উনুনে ক্রমাগত ঘি ঢালছে রোহিঙ্গা ইস্যু। পাশের দেশ মিয়ানমার ইতোমধ্যেই এই স্নায়ুযুদ্ধের দাবানলে পুড়তে শুরু করেছে। এর সূত্রপাত হয়েছে অভিন্ন রোহিঙ্গা ইস্যু দিয়ে। কিন্তু দাবানল সৃষ্টি হয়েছে সেনাশাসনের মাধ্যমে। এখন মিয়ানমার পুড়ছে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ আগুনে। KIA, KNLA, KIO, KNU, WA ARMY, TNLA, MNDDA প্রভৃতির মতো ভয়ঙ্কর গেরিলা বিদ্রোহীরা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করেছে। ভারি আর্টিলারি, সামরিক হেলিকপ্টার, যুদ্ধ বিমান, নেভি সমর্থন নিয়েও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এসব বিদ্রোহীর সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠছে না। বরং প্রায় প্রতিদিনই সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্রোহীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অসংখ্য ক্যাম্প ও আউটপোস্ট দখল করে নিয়েছে। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করে নিয়েছে ও নিচ্ছে। অনেক সেনাসদস্য হতাহত হয়েছে, অনেকে পালিয়ে গিয়ে বিদ্রোহীদের সাথে যুক্ত হয়েছে। এতে সেনাবাহিনীর মানসিক ও নৈতিক শক্তির দুর্বলতা স্পষ্ট হচ্ছে।
এদিকে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম দিকে রাজপথ দখলে রেখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেও সুকির দল এনএলডি সাপোর্টারা বুঝতে পেরেছে, অস্ত্রের বিরুদ্ধে খালি হাতে লড়াই করে জয়লাভ সম্ভব নয়। বরং তাতে ক্ষয়ক্ষতিই বাড়ছে শুধু। তাই তাদের তরুণ ও যুবক শ্রেণি বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপের ঘাঁটিতে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে পুনরায় ফিরে আসতে শুরু করেছে পিডিএফ, জেনারেশন জেড প্রভৃতি নামে। কার্যত এনএলডি দলের একটি অংশ এখন বিপ্লবী দলে পরিণত হতে চলেছে। সেটা হলে বুঝতে হবে, মিয়ানমার ভয়াবহ গণযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এর আঁচ বাংলাদেশের গায়েও লাগবে না একথা হলফ করে বলা যায় না।

বিশেষ করে ইন্দো প্যাসিফিক জোট- কোয়াড এবং এ বিপরীত চাইনিজ মেরুকরণ, ওবিওআর, মেরিটাইম সিল্ক রুট- স্ট্রিং অব পার্লস এবং এর বিপরীতে বিআরআই, বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভস, চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর বিভিন্ন যোগাযোগ রুট, এখন বাংলাদেশকে বৈশ্বিক রাজনীতির ভয়াবহ চক্রব্যুহে নিপতিত করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যু, রামগড়-সাবরুম মৈত্রী সেতু ও চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যোগাযোগ, এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেল রুটের গুরুত্বপূর্ণ অংশে বাংলাদেশ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব অপরিসীম। এই গুরুত্বের যেমন সম্ভাবনাময় অনেক দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানাবিধ নতুন ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ন্যূনতম ভুল করলেই বাংলাদেশকে ভয়াবহ খেসারত দিতে হতে পারে। সেজন্য এখানে দরকার সৎ, দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং অতি অবশ্যই জনগণের যুথবদ্ধতা। একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই কেবল পারে উক্ত শর্তগুলো নিশ্চিত করতে। চলতি শতাব্দির প্রথমার্ধে যখন ইসলাম বিরোধী শক্তির উদ্ভাবিত জঙ্গীবাদের থাবা মুসলিম বিশ্বের হৃদয়কে বিদীর্ণ করতে শুরু করেছিল, বাংলাদেশকে হিরন্ময় কার্লেকাররা ‘নেক্সট আফগানিস্তান’, বার্টিল লিন্টনাররা ‘কোকুন অব টেরর’ আখ্যা দিয়ে গন্তব্য দেখিয়ে দিয়েছিল, তখনো দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গীবাদের আগুন বাংলাদেশের শরীরে উত্তাপ ছড়ালেও ঝলসে দিতে পারেনি। এর প্রধান কারণ নব্বই’র দশক থেকে বাংলাদেশে বিরাজিত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও চর্চা। সেকারণেই মার্কিন-চীন স্নায়ুযুদ্ধের এই চক্রবুহ্য থেকেও বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপস্থিতি ও জবাবদিহিমূলক সরকার পরিচালনা। তাই এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হেফাজতের মধ্যে রাজনৈতিক রেষারেষির সময় নয়। মার্কিন ক‚টনীতির টারকেল প্যাটার্সন এই শতাব্দির শুরুতে বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা ড্রয়িং রুমের দখল নিতে মরিয়া। কিন্তু তাদের বেড রুমে আগুন লেগে গিয়েছে সে ব্যাপারে খবর নেই। এখন এই আগুনের ধোঁয়া দৃশ্যমান। তাই এখন প্রবল দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দেশে গণতন্ত্র ও জবাবদিহিমূলক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সকলকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে এগিয়ে আসতে হবে। নচেৎ এই আগুনের লেলিহান থেকে কেউই নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (13)
MD Hossayin ১৮ মে, ২০২১, ১:৫৫ এএম says : 0
সবচেয়ে বড় কথা,শারীরিক এই জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য খালেদা জিয়ার এখন মানসিক শক্তি প্রয়োজন। এই বন্দিদশা উনার মানসিক শক্তিকে অনেকাংশেই ধ্বংস করে দিয়েছে। সরকারের কাছে আকুল আবেদন আল্লাহর দিকে তাকিয়ে, মানবিক দিক বিবেচনা করে উনাকে মুক্তি দিন।
Total Reply(0)
Tahmida Ishfaq ১৮ মে, ২০২১, ১:৫৫ এএম says : 0
প্রিয় নেত্রীকে আল্লাহ হেফাজত করুন। একজন যোগ্য ও প্রজ্ঞাবান নেত্রী।সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করি।
Total Reply(0)
Sadi Musleh ১৮ মে, ২০২১, ১:৫৬ এএম says : 0
সরকারের উচিত বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আন্তর্জাতিক সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, কোটি মানুষের নেত্রী দিন শেষে একজন মানুষ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আইন দেখিয়ে সময় ক্ষেপন হলে, বেগম জিয়ার উন্নত চিকিৎসা ব্যাহত হবে।।
Total Reply(0)
Zaman Norul ১৮ মে, ২০২১, ১:৫৬ এএম says : 0
জটিলতা কিছুই নয়,ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় অনুমতি দিকে পারে। কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির কারণেই বাংলাদেশের মানুষ হয়রানির শিকার হয় বেশী।
Total Reply(0)
ফাতেমা মুস্তাফিজ নদী ১৮ মে, ২০২১, ১:৫৬ এএম says : 0
সরকারের উচিত সাবেক প্রধাণমন্ত্রীকে কোন জটিলতা তৈরী না করে যেতে দেওয়া। কারন ক্ষমতা কখনও চিরকাল থাকেনা কারও ,,সেইম দশা তারও হতে পারে । সময় থাকতে বিষয়গুলি উপলদ্ধি করা দরকার বর্তমান সরকারের ,,বেগম জিয়াকে চিকিৎসার সুযোগ করে দিয়ে জনমনে শ্রদ্ধারপাত্র তৈরী করুক।
Total Reply(0)
MD Fhorid Hossain ১৮ মে, ২০২১, ১:৫৭ এএম says : 0
বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।তাঁর বিদেশ যাত্রা আদালতের বিষয় নয়।কারণ সরকার ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে তাঁর দন্ড স্থগিত করেছে।
Total Reply(0)
A R Hasan Khan ১৮ মে, ২০২১, ১:৫৮ এএম says : 0
আজ খালেদা জিয়ার অবস্থা যেমন,ঠিক তেমন অবস্থার সম্মুখীন শেখ হাসিনাও হতে পারে।কারণ দুজন এক ঘাটেরই নৌকা। তাই সরকারের উচিত তিনাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া ।
Total Reply(0)
Md Ãbübãkkōr Sîddîk ১৮ মে, ২০২১, ১:৫৮ এএম says : 0
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জনগণের ভোটে অবৈধভাবে নয় এই সরকারের উচিৎ ছিলো তার পরিবার যেদিন আবেদন করেছে বিদেশ নেওয়ার জন্য সেদিনেই অনুমতি দেওয়া কারন তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
Total Reply(0)
Zillur Rahaman ১৮ মে, ২০২১, ২:০০ এএম says : 0
সরকার চাইলে মাত্র কয়েক ঘন্টায় জটিলতা দূর করতে পারে, আর না চাইলে কতদিনে জটিলতা দূর হবে তা কেবল আল্লাহই ভাল জানে।
Total Reply(0)
Towhidur Rahman ১৮ মে, ২০২১, ১১:১৭ এএম says : 0
আমরা আশাবাদী, বেগম জিয়া খুব শিগ্রই উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন
Total Reply(0)
মিনহাজ ১৮ মে, ২০২১, ১১:১৮ এএম says : 0
সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক, এটা এখন আমাদের প্রত্যাশা
Total Reply(0)
নওরিন ১৮ মে, ২০২১, ১১:১৯ এএম says : 0
দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপস্থিতি ও জবাবদিহিমূলক সরকারের কোন বিকল্প পথ নেই
Total Reply(0)
মনিরুজ্জামান ১৮ মে, ২০২১, ১১:২১ এএম says : 0
তথ্যভিত্তিক ও দিক নির্দেশনামুলক লেখা। আশা করি সরকারের কর্তামহল বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন এবং সে অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দেশ পরিচালনা করবেন।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন