থ্যালাসেমিয়ার মত ঘাতক ব্যাধি সম্পর্কে সচেতণতা গড়ে তুলতেই প্রতিবছর ৮ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া এক ধরনের বংশগত রক্ত স্বল্পতার রোগ। এ রোগে আমাদের রক্তে যে লোহিত কনিকা আছে তা তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যায়। রক্তে লোহিত কনিকার ভিতরে থাকে হিমগ্লােবিন। এই হিমোগ্লােবিন আয়রন এবং গ্লােবিন প্রোটিন দ্বারা গঠিত। এই গ্লােবিন আবার দুই জোড়া চেইন দিয়ে তৈরী হয়-আলফা এবং বিটা। থ্যালাসেমিয়ায় যে সমস্যাটা হয় তা হলো এই দুই জোড়া গ্লােবিনের যে কোন এক জোড়ার তৈরী হওয়া কমে যায়। যাকে আমরা আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া বলি। উভয়েরই কারন জেনেটিক মিউটেশন। মিউটেশন মানে হলো পরিবর্তণ, জিনের ভিতরে স্বাভাবিকের বাইরে কোন প্রোটিন তৈরি হওয়া। এটা বিভিন্ন কারনে হয়। আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের সৃস্টির পরে কোটি কোটি বছর ধরে এই মিউটেশন হয়ে আসছে। অনেক বড় বড় প্রানী প্রজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনও শোনা যায় ভূমিকম্পের কারনেও মিউটেশন ঘটে। কারন যাই হোক মিউটেশনের ফলে গ্লােবিন চেইনের তৈরী হওয়া কমে যায়। ব্যাপার হলো একজোড়া চেইনের তৈরী হওয়া যখন কমে যায় তখন সাথের অন্য জোড়ার পরিমান বেড়ে যায়। বেড়ে যাওয়া গ্লােবিন জমে প্রেসিপিটেট করে, ফলে লোহিত কনিকাটি ভেঙে যায়। আবার তার মধ্যে হিমোগ্লােবিনের পরিমানও কমে যায়। যার ফলে হিমোগ্লােবিনের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা কমে যায়।
আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের থ্যালাসেমিয়া দেখা যায়। এদের ক্ষেত্রে সাধারণত: রক্ত পরিসঞ্চালন দরকার হয় (ট্রান্সফিউশন ডিপেন্ডেন্ট)। এর বাইরেও হরেক রকম থ্যালাসেমিয়া আছে। যাদের অধিকাংশেরই নিয়মিত রক্ত লাগে না। আমাদের দেশে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর এবং হিমোগ্লােবিন ই বিটা থ্যালাসেমিয়ার রোগী বেশী। যাদের নিজের লোহিত রক্ত কনিকা শরীরে খুব বেশীদিন বাঁচে না। অন্যের দেওয়া রক্তে তাদের বেঁচে থাকতে হয়।
বংশানুক্রমের ব্যাপার হলো বাবা, মা দুই জনেই যদি বাহক হয় তা হলে কিছু সন্তান সুস্থ হবে আবার কিছু সন্তান রোগী অথবা বাহক হবে। বাবা, মা দুই জনেই যদি রোগী হয় তা হলে সুস্থ বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার যদি মা বাবার একজন রোগী হয় অন্য জন সুস্থ হয় তা হলে কিছু সন্তান বাহক হবে, কিন্তু সুস্থ্য হবে। তার মানে হলো রোগটি মা বাবার কাছ থেকেই বংশানুক্রমিক বাচ্চার মধ্যে সঞ্চালিত হয়। তাই যদি বিবাহ করার পূর্বে রক্তের পরীক্ষা করে নেওয়া যায় যে, পাত্র বা পাত্রী কেউই বাহক বা রোগী নয় তা হলে রোগটি সঞ্চালিত হতে পারবে না। এটা বাচ্চা মায়ের পেটে আসার পরেও নির্ণয় করা যায় যা ব্যয় সাপেক্ষ। যদি দেখা যায় মায়ের পেটের বাচ্চা আক্রান্ত হয়েছে তা হলে বাচ্চাটি না নিয়ে টার্মিনেট করে ফেলতে হয় ও করা যায়। তবে যদি সমাজের সমস্ত লোকের এক/একাধিক স্ক্রিনিং টেষ্ট করা যায় তা হলেও বাহক বা রোগী সনাক্ত করা যায়। এক্ষেত্রে সামাজিক বা সরকারী উদ্যোগ দরকার। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে একই বংশের ভাই বোনের মধ্যে বিভিন্ন কারনে বিবাহের প্রচলন আছে। এটা থ্যালাসেমিয়া বিস্তারের কারন। সেক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে সামজিক সচেতনতা তৈরী করতে পারলে বিস্তারের ব্যপকতা কমানো সম্ভব। প্রতিনিয়ত আমাদের সমাজে রোগী অথবা বাহকের সংখ্যা বাড়ছে। যার চিত্র খুব ভয়াবহ। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা হলো রোগীদের চিকিৎসা, পরামর্শ ইত্যাদি। আর বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির ভূমিকা হওয়া উচিত মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করা যাতে রোগটির বিস্তার রোধ করা যায়। রক্ত সংগ্রহের ব্যাপারেও তাদের ভূমিকা থাকতে পারে-যেমন মানুষকে রক্তদানে উৎসাহিত করা। রক্ত সংগ্রহের কাজটি তাদের না করাই ভালো। কারন রক্ত দানের কতকগুলো নিয়ম কানুন আছে, পরীক্ষা নিরিক্ষা আছে যা স্পেশালিষ্টদের কাজ। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রক্ত দেওয়া ছাড়াও জমে যাওয়া আয়রন শরীরের ভিতর থেকে বের করতে হয়। না হলে থ্যালাসেমিয়ায় রোগীরা ৩০/৪০ বছরের বেশী বাচেঁ না। এ ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি উদ্যোগ নিতে পারে। সরকারকে পরামর্শ দিতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের শরীরের রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্লােবিন ঠিকমতো তৈরী হয় না। ফলে শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারী কিছু অঙ্গ যেমন- প্লীহা, যকৃত বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমন্ডলের হাড়ের অস্থিমজ্জা বিকৃত হওয়ার কারনে শিশুর চেহারা বিশেষ রুপ ধারণ করে।
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। বার বার রক্ত নেবার একটি বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। এর ফলে হৃদপিন্ড, যকৃত বিকল হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। এ ধরনের জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপী দেওয়া হয়, অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেবার জন্য। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী চিকিৎসা যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে এর চিকিৎসা সবসময় সফল নাও হতে পারে। এছাড়া জিন থেরাপী এবং স্টেম সেল থেরাপিও থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী চিকিৎসা।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার হলো প্রতিরোধ। এ ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। না হলে হয়তো ভবিষ্যতে কোন একদিন দেখা যাবে বাংলাদেশের অনেক অনেক মানুষ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বা রোগী। তখন চিত্রটি কেমন হবে? সেই পরিস্থিতির যাতে আমাদের সম্মুখীন হতে না হয় তাই আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে।
থ্যালাসেমিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এ রোগের দুজন বাহকের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত এবং প্রতিহত করার মাধ্যমে সমাজে নতুন থ্যালাসেমিয়া শিশুর জন্ম হ্রাস করা যায়। সুতরাং আর দেরী না করে আজই থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় এবং এর জন্য হিমোগ্লােবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষাটি করান এবং আপনার শিশুকে এর অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখুন।
এছাড়া ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থাৎ যেসব পরিবারে স্বামী বা স্ত্রী দুজনই এ রোগের বাহক তারা গর্ভস্থ ভ্রুণ পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য থ্যালাসেমিয়া শিশু নির্ণয় এবং তা পরিহার করতে পারেন। গর্ভাবস্থার ১০ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়। গর্ভফুল থেকে টিস্যু নিয়ে এই পরীক্ষাটি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে করা যায়।
প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরীর সময় সবার রক্তের হিমোগ্লােবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করা যায়। স্কুলে ভর্তির সময় বাচ্চাদের এবং বাবা মায়ের পরীক্ষা করা যায় এবং রেকর্ড নথীভূক্ত করা যায়। অনেক রকম স্ক্রিনিং টেষ্ট আছে। প্রাথমিক কর্তব্য হলো একটি স্ক্রিনিং টেষ্ট নির্ধারণ করা এবং সে পথে আগানো। বসে থেকে কালক্ষেপন হবে ভয়াবহ আত্মহনন। প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান- যেমন মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা যেখানে মানুষ স্বাভাবিক ভাবে সমবেত হয় সে গুলোকেও কাজে লাগানো যায়। যেমন আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিবাহ বন্ধ করা। এই সব ব্যবস্থা যদি আমরা নিতে পারি তাহলে হয়তো থ্যালাসেমিয়ার বিস্তার থেকে আমরা রেহাই পাব।
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
উপাচাযর্,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন