বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সোনালি আসর

ইনতানের দাদুর বাড়ি

প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শাহজাহান আবদালি

ইনতানের জন্ম ঢাকা শহরে। রাজধানীর দর্শনীয় স্থানগুলো এই পাঁচ বছর বয়সেই ওর চেনা হয়ে গেছে।
শিশুপার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জাতীয় জাদুঘর, তিন নেতার মাজার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, চিড়িয়াখানা, জাতীয় শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা- এসব আগেই দেখা হয়েছে। গত মাসের শুক্রবার দিন আব্বু-আম্মুর সাথে ইনতান ফ্যান্টাসী কিংডম ঘুরে এলো। শুধু ঘুরে আসা নয়, ঢাকা শহরের এসব দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনার ইতিহাস আব্বু তাকে শুনিয়েছেন।
ইনতান যেদিন ঢাকার বাহাদুরশাহ পার্ক দেখতে যায় সেদিন আব্বু তাকে ১৮৮৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক বাহাদুরশাহ সম্পর্কে অনেক কাহিনী শোনান। এভাবে ইনতান জেনেছে জাতীয় শহীদ মিনারের গোড়ার কথা, সাভার স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আগের নাম এবং এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি
তবে ইনতান দুটো জিনিস দেখেনি, একটি হলো নদী অন্যটি হলো ধানগাছ। অবশ্য সে আগে ভাবতো ঢাকা শহরে যে বন্যা হয়, ওই অবস্থাকে নদী বলে। কারণ সে শুনেছে নদীতে নৌকা চলে। বন্যার সময় ইনতানরা বাসাবোর মামার বাসা থেকে মুগদায় ছোট চাচার বাসায় নৌকা দিয়ে যাতায়াত করে।
ইনতান এখন ওয়ান থেকে টুয়ে উঠেছে। টুয়ের নতুন বাংলা বইয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীর নাম জেনেছে। আব্বুর কাছে শুনেছে এই তিনটি নদী বাংলাদেশের প্রধান নদী, আর এও জেনেছে যে, বাংলাদেশে একটা সাগর আছে। নাম তার বঙ্গোপসাগর। সাগর নদীর চেয়েও অনেক অনেক বড়ো। সাগরের ঢেউগুলো একেবারে পাহাড়ের মতো। গভীর রাতে সাগর শোঁ শোঁ করে ডাকে। আর ধানগাছ সম্পর্কে ইনতানের ধারণাই ছিল না। শুধু ভোটের সময় পোস্টারে ধানের শীষ দেখেছে। তবে নিজে কোনোদিন ধান দেখেনি। আর ধানগাছ তো তার কল্পনাতেও ছিল না এতোদিন।
একদিন আম্মু তাকে ভাত খাইয়ে দিতে গিয়ে ভাতের মধ্যে একটি আস্ত ধান পান। ধানটা তিনি ইনতানকে দেখিয়ে বলেন, এই দেখো ধান। এই ধান থেকে চাল হয়।
‘ধান থেকে কিভাবে চাল হয় আম্মু?’
ইনতানের কথা শুনে আম্মু প্রথমে হাসলেন। পরে ওকে ভালো করে বুঝিয়ে দেন।
গ্রামের চাষিরা জমি চাষ করে সেখানে ধান বোনে। সেই ধান থেকে ধানগাছ হয়। একদিন হলুদ ধানে ভরে ওঠে মাঠ। পাকাধান গাছসহ কেটে এগুলো থেকে ধান আলাদা করে। এরপর রোদে শুকিয়ে মেশিনে বা ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল বের করা হয়। সেই চাল দিয়ে আমরা ভাত রাঁধি।
আম্মু এখন ধানের ইতিহাস তাকে শোনাতে থাকেনÑ এর মধ্যে ইনতান নানা প্রশ্ন করে জেনে নেয় ধানগাছ দেখতে কেমন? কীভাবে ধানগাছ বাড়ে, ঢেঁকি কেমন? চাষিভাই কিভাবে চাষ করে, লাঙল দেখতে কেমন ইত্যাদি। এরপর থেকে ইনতানের খুব ইচ্ছে গ্রাম দেখতে যাবে। এ পর্যন্ত সে গ্রাম দেখেনি। নদী দেখেনি, ধানগাছ দেখেনি। তবে সে স্বপ্নে এসব প্রায়ই দেখে। সে ঘুম থেকে বলে ওঠে, বাহ কী সুন্দর নদী! আহা রঙিন পালতোলা নৌকা যাচ্ছে। কী সুন্দর সাদা বক উড়ে যাচ্ছে।
আহা কী সুন্দর!
আম্মু ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন- কি হলো ইনতান, তুমি ঘুমের ঘোরে কথা বলছো যে? স্বপ্ন দেখছো বুঝি?
ইনতানের ঘুম খুব পাতলা। আম্মুর হাতের স্পর্শ পেয়ে তার চোখ খুলে যায়। আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, হ্যাঁ আম্মু, আমি স্বপ্নে দাদুবাড়ি দেখেছি। একটি ছোট্ট রুপালি নদী। সেই নদীতে মাঝিভাই গান গেয়ে রঙিন পাল উড়িয়ে নৌকো বেয়ে যাচ্ছে। কত যে পাখি আম্মু। সাদা রঙের বক দেখেছি। আর নদীর পাড় ঘেঁষে বিশাল মাঠ। ধানে ধানে ভরা সে মাঠ। আম্মু আমি না চাষি ভাইকেও দেখেছি। মাথায় পাতার ক্যাপ পরে কাঁধে লাঙল নিয়ে গরুর সাথে মাঠের দিকে যাচ্ছে।
আম্মু হাসেন। আসলে তুমি এসব নিয়ে ইদানীং খুব ভাবো। তাই স্বপ্নে এগুলো দেখেছো। ইনতান বলল, হ্যাঁ আম্মু, আমার না খুব গ্রাম দেখতে ইচ্ছে করে। দাদুর বাড়িতে কোনোদিন যাইনি। আম্মু চলো না আমরা একবার গ্রাম দেখতে যাই। আম্মু ইনতানের কপালে একটা আলতো চুমু এঁকে বললেন, অবশ্যই আমরা গ্রাম দেখতে যাবো। সামনেই ঈদের ছুটি পড়বে- তখন যাবো।
সত্যি সত্যি একদিন ইনতানরা গ্রামে রওনা দেয়।
আব্বু আম্মু আর ইনতান।
এই প্রথম ইনতান নদী দেখলো। শুধু দেখা নয়, লঞ্চে চড়লো সদরঘাট থেকে। লঞ্চে চড়ে ওরা রওনা হলো বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় দাদুর বাড়ির উদ্দেশে।
নদীতে কত দৃশ্য দেখলো। স্টিমার, বড় জাহাজ, কত রকম নৌকা, কোনোটা পাল উড়িয়ে যাচ্ছে, কোনো নৌকায় জেলেরা মাছ ধরছে। নদীর দু’পারে কত বাড়িঘর, ধানের জমি, গাছপালা কত পাখির ওড়াউড়ি। একঝাঁক সাদা রঙের পাখি টিউটিউ করে নদীর ওপর চক্কর দিতে দেখে ইনতান।
‘ওগুলো কী পাখি আম্মু?’
‘ওগুলোর নাম গাঙচিল। ইংরেজিতে যাকে বলে সী-গাল। আম্মুর কাছ থেকে এই প্রথম গাঙচিল পাখির নামটা জানতে পারলো।
আম্মুও বেশ কিছু পাখি দেখিয়ে সেগুলোর নাম ইনতানকে জানালেন- মাছরাঙা, খঞ্জনা, পানকৌড়ি, বেলেহাঁস, কানিবকসহ বাহারি সব পাখির নাম। তারপর রিকশায় এক ঘণ্টার মধ্যে ওরা পৌঁছল দাদুর বাড়ি দরিকান্দি গ্রামে।
তখন সন্ধ্যা। রিকশার বেল বাজতেই একদল মানুষ বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। চার পাঁচজন বড় মানুষ, সঙ্গে ক’জন ছোট ছেলেমেয়েও।
ইনতানের দাদী বেঁচে নেই। দাদুর বয়স হয়েছে। চোখেও কম দেখেন। তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে বাড়ির বাইরে এসে হাঁকলেন-কারা আইলো রে?
‘বাবা আমি’।
ইনতানের আব্বু পা ছুঁয়ে দাঁড়ালো তার বাবার কাছে। আম্মু এবং ইনতানও সালাম করলো তাকে। এর মধ্যে সারাবাড়ি হই-হুল্লোড়ে মেতে ওঠে। কেউ বলছে, ভাইজান আইছে, কেউ বলছে ভাবিসাব আইছে। ছোট্টরা বলছে, ইনতান বাবু আইছে। ওদের পেয়ে সবাই যেন হাতে চাঁদ পেল। এতো আনন্দ, এতো আপনজন ইনতান আগে কোনোদিন দেখেনি। ভাবাই যায় না তার এতো সব আপনজন গ্রামে আছে।
ভোর হলো মোরগ ডাকার মধ্য দিয়ে। ইনতানের ঘুম ভাঙে মনীষা আপুর আদুরে স্পর্শে।
চোখ খুলে ইনতান একটু লজ্জা পেল। লজ্জা তো পাবেই। এমন আদর তো এতোদিন শুধু তার মা-ই করেছে।
আর মনীষা আপুকে সে কোনোদিন দেখেনি।
মনীষা আপু কোলে করে নিয়ে গেল তাকে কুয়োর পাড়ে। বালতি দিয়ে পানি তুলে ইনতানের মুখ ধুয়ে দেয়।
উঠোনের একপাশে একটা বড় শিউলি গাছ।
হেমন্তকাল। হলুদ বোঁটার সাদা সাদা তারার মতো শিউলি ফুলে উঠোন ঢেকে আছে। কী সুন্দর ঘ্রাণ! ইনতান প্রাণভরে সেই মিষ্টি ঘ্রাণ নিলো।
এর মধ্যে ভোরের রোদ নেচে ওঠে চালতা গাছের আঙিনায় আর পুঁই মাচায়।
মোরগ-মুরগী, হাঁস আর কবুতরে ভরা উঠোন। হঠাৎ একটা পাখি ডাকলো। ইনতান কান খাড়া করে শুনতে থাকে।
মনীষা আপু বললেন, ইনতান বাবু, তোমরা আসবে শুনেই কুটুম পাখি ডাক শুরু করলো।
বিকেলে চাচাতো ভাই ইমন, প্রভা আপু ও শাহনাজ আপু ইনতানকে নিয়ে গ্রাম দেখতে যায়।
ধুলোওড়া মেঠোপথের একপাশে ঘন ঝোপঝাড়। স্বর্ণলতার ঝোপ। আতা ফুলের গন্ধ। সোনালু ফুলে একাকার বড় গাছটা। যেতে যেতে দেখলো অবারিত ধানক্ষেতে ধান এখনো তেমন পাকেনি। বাতাস ঢেউ খেলে যায় ধান ক্ষেতে। লেজঝোলা সুইচোর পাখি ধানের শীষের ওপর কি আরামে দুলছে। ইনতান কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়। চোখ জুড়িয়ে যায় এই দৃশ্য দেখে।
‘আমাকে একটা ধানগাছ দেবে?’
শাহনাজ আপু এক দৌড়ে গিয়ে একটা ধানের ছড়া ছিঁড়ে এনে ইনতানের হাতে দেয়।
ইনতান ওটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলো। তারপর নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নেয়। আহ্ কি মিষ্টি ঘ্রাণ! এমন ঘ্রাণ সে জীবনে এই প্রথম পেলো।
ইনতানকে নিয়ে ওরা তিতাস নদীর পাড়ে গেলো। দেখলো নদীর রূপ। মেঘনার শাখা নদী ওটা। তিতাস নদী থেকে একটি খাল ভোরের বাজার ঘেঁষে চলে গেছে। কত নৌকা, ছোট ছোট তালের ডোঙা। খালি গায়ে গ্রামের ছেলেরা কাঁধে তেকোণা হাতজাল নিয়ে মাছ ধরে বাড়ি ফিরছে। এতো মধুর দৃশ্য ইনতানকে আবেগে আপ্লুত করে তোলে।
সূর্য ওঠার আগেই একটা বাজার বসে। এর নাম ভোরের বাজার। এই বাজারে গেলে ইনতানের দাদুর আত্মীয়-স্বজনরা কেউ চিপস কিনে দেয়, কেউ চকলেট কিনে দেয়, কেউ কেউ দাওয়াত খাওয়ার জন্য আবেদন জানায়। দারুণ মজা তাদের আন্তরিকতায়। এমনি করে গ্রাম দেখে, নদী দেখে, ধানক্ষেত দেখে, পানি দেখে, বুনোফুলের ঘ্রাণ নিয়ে, দাদু, আপুসহ স্বজনদের আদর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পইপই করে চারটি দিন কেটে গেল।
এবার ফেরার পালা।
গ্রামে আসার দিন যতোটা আনন্দের মধ্যে দিয়ে তাদের বরণ করেছিল দাদুবাড়ির লোকজনেরা। ফেরার দিন ততোটাই বেদনা-বিধূর দৃশ্যের অবতারণা হলো। মণীষা আপু, শাহনাজ আপু, ইমন ভাইয়া, প্রভা আপু, দাদুভাই সবার চোখে জল।
আব্বু আম্মুর চোখও ছলছল করে ওঠে।
জেঠিমা ইনতানকে কোল থেকে আম্মুর কোলে তুলে দেন। এ সময় মনীষা আপুর ডুকরে কেঁদে ওঠার কষ্টটা ইনতানও সইতে পারলো না। সেও হু হু করে কেঁদে উঠলো।
রিকশা ছুটতে থাকে। পেছনে দাদুভাই, জেঠিমা, মনীষা আপুসহ ক’জন মহিলা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ইনতানের বেদনাবোধ ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগলো। ওর স্কুল ব্যাগে পরম যতেœ রাখা সেই ধানের ছড়াটা বের করে ইনতান চোখ বুজে সে ঘ্রাণ নেয়। সেই ঘ্রাণের ভেতর সে খুঁজে পায় পেছনে ফেলে আসা দাদুর মুখ, প্রিয় গ্রাম, রূপালী নদী, পাখির গান আর মনীষা আপুর আদর।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন