মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ব্রহ্মপুত্র নদে বালুখেকোরা

চিলমারী নৌ-বন্দর ৫ বছরেও চালু হয়নি ৩০ পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাটে বিক্রি হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশের নদ-নদীর পাড়ের মানুষ ভাঙনের কারণে দুঃখে থাকলেও কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ের মানুষ সুখী। কয়েক বছর ধরে নদের পাড় সংরক্ষণ করায় নদ এখন আর ভাঙছে না। এছাড়াও নদের চিলমারী পয়েন্টে ঐতিহ্যবাহী নদীবন্দর পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতেকরে নদ পাড়ের মানুষ খুবই খুশি। কিন্তু নদ পাড়ের কয়েক লাখ মানুষের এই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হচ্ছে না। কারণ প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ গ্রহণের ৫ বছরেও নৌবন্দর নির্মাণের নির্দেশনা কার্যকর হয়নি।
এ সুযোগে জমি খেকো, বালু খেকো সিন্ডিকেট ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় দখল করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আশপাশের জেলায় বিক্রি করছে। গত মার্চ মাসে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে নদের কমপক্ষ্যে ৩০টি পয়েন্টে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব বালু কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট জেলা শহরের বিল্ডিং নির্মাণ ও ব্রিজ, কালভার্ট, সড়কের কাজে ব্যবহার হচ্ছে।
এতেকরে ব্রহ্মপুত্র নদ আবারো ভাঙনের কবলে পড়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। নদের পাড়ের গ্রাম তেলিপাড়া, হাসের ভিটা, বাইচর, মনতলা গ্রামের সাধারণ কৃষকরা জানান, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালীরা নদের বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছেন। এতে নদে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ে চিলমারী বন্দর একটি ঐতিহাসিক নদীবন্দর। মরমী কবি আব্বাস উদ্দিন এই বন্দরকে ঘিরেই ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে যাই’ গান গেয়েছিলেন। দীর্ঘ অব্যবস্থাপনা ও নৌপথের উন্নয়ন না হওয়ায় এই নদীবন্দরটি কার্যকর ছিল না। ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রাম সফর করে চিলমারীকে নৌবন্দর হিসেবে ঘোষণা করে পুনরায় বন্দর চালুর করার নির্দেশনা দেন। ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর চিলমারীর রমনা শ্যালোঘাটে পন্টুন স্থাপন করে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
এ সময় প্রায় তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরটি উন্নয়নে মহাপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কিন্তু জেলা পরিষদ বন্দরটির ঘাটগুলো পরিচালনার দায়িত্ব ছাড়তে রাজি নয়। বিআইডব্লিউটিএকে না জানিয়ে বন্দরটির ইজারা দেয়া হয়েছে। ফলে বিআইডব্লিউটিএ আর জেলা পরিষদের মধ্যে চলছে বিরোধ। বিষয়টি মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে। তবে ২০১৮ সালের জুন মাসে ওই সময়ের নৌমন্ত্রী চিলমারী সফর করে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত নদীবন্দরের কার্যক্রম চালু হয়নি।
প্রশাসনের মধ্যেকার এই বিরোধের সুযোগ নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালীরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বালু উত্তোলন ও বিক্রিতে জড়িত প্রত্যেকেই প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
গত মার্চ মাসে সরেজমিনে দেখা গেছে, চিলমারী উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের ২৫ থেকে ৩০টি পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বিশাল বিশাল বালুর স্তূপ। ট্রাকে ভরে সে বালু রংপুর, লালমনিরহাট নেয়া হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ছে।
অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে গত বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা ও ভাঙনের কবলে পড়ে চিলমারী উপজেলা ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা চর মনতলা। পুরো চরটি ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। চর জেগে ওঠার পরে একে একে ৪৫০টি পরিবার সেখানে বাস করতে শুরু করে। বন্যা ও ভাঙনে তারা প্রত্যেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
চিলমারী উপজেলার রমনা ঘাট এলাকার বাসিন্দা মো. হযরত আলী বলেন, সারা দিনরাত ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে নদের পাড়ে স্তূপ করে রাখা হয়। প্রকাশ্যে বিক্রি করছে একটি সিন্ডিকেট। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন কোনোদিনই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। হাসের ভিটা গ্রামের মো. ইউনূস আলী বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ের মানুষ সুখী। কারণ কয়েক বছর থেকে ভাঙে না। কিন্তু বালু উত্তোলনের কারণে নদ আবার ভাঙতে শুরু করেছে। চিলমারীর বন্দর যদি চালু হতো তাহলে প্রশাসনের নজরদারি থাকত। নদের বালু অবৈধভাবে উত্তোলন করার সাহস পেত না বালু খেকোরা। নদও নতুন করে ভাঙনের কবলে পড়ত না।
কয়েক মাস আগে যখন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ঘুরেছি; তখন বিভিন্ন মানুষ জানান, চিলমারীর বালুর চাহিদা ব্যাপক এবং দামও বেশি পাওয়া যায়। যে কারণে এ নদের বালু কুড়িগ্রাম জেলা ছাড়াও লালমনির হাট, রংপুর জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়।
চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র থেকে বালু উত্তোলন ও বিক্রিতে জড়িত হারুনুর রশিদ। তিনি দাবি করেছেন, ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সেই জন্য প্রশাসনিক কোনো ঝামেলা হয় না। এতে প্রশাসনের বিনা খরচে খননের কাজও হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা বালু উত্তোলন ও বিক্রি করছি। এ কাজে স্থানীয় অনেক শ্রমিক জড়িত। তারা আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন। আয়ের টাকায় তাদের সংসার চালছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিলমারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাহবুবুর রহমান বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়টি শুনেছি, পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ের চিলমারী এক সময় একটি ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা কেন্দ্র ছিল। এ স্থানটি অনেক আগে থেকেই ‘চিলমারী বন্দর’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ বন্দর দিয়ে হাজার হাজার মণ পাট, ধান, চাল প্রভৃতি পণ্য নিয়ে বড় বড় জাহাজ চলাচল করত। ব্রিটিশ আমল থেকে কলকাতা হতে গৌহাটি এবং আসামের ধুবড়ি পর্যন্ত নৌ-যাতায়াত ছিল। চিলমারী নদীবন্দরটি পায়রা সমুদ্র বন্দর হতে নৌপথে ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগের একমাত্র নৌরুট।
বন্দরটিকে ঘিরে চিলমারীতে গড়ে উঠেছিল বড় বড় পাটের, সরিষার, ধানের, গমের, বাদামের, তিসির ও ভুট্টার গোডাউন। দেশের নামিদামি পাট কোম্পানিগুলো চিলমারীতে এসে অফিস খুলে পাট ক্রয় করতেন। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে বিভিন্ন ধরনের মালামাল ক্রয় করার জন্য দিনের পর দিন অবস্থান করতেন। ১৯৭২ সালে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে নৌপথে মালামাল পরিবহনের জন্য একটি নৌ-প্রটোকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা থেকে গৌহাটি এবং আসামের ধুবড়ি পর্যন্ত নৌ যাতায়াত ছিল। কিন্তু নদের ভাঙন এবং নদের নাব্যতা সঙ্কটের কারণে চিলমারী কেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
রাজধানী ঢাকায় এবং মহানগরীর আশপাশেই শুধু নয়, ভূমি দস্যু, নদী খেকো, মাটি-বালু খেকোরা এখন দেশের সর্বোত্রই ছড়িয়ে পড়েছে। চিলমারির ব্রহ্মপুত্র নদের বালুও এখন যাচ্ছে বালু খেকোদের পেটে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন