শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহিলা

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নারী

প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

খালেদা বেগম

ঘরে ঢুকেই অনিলার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়- সবগুলো ঘরের বাতি জ্বালানো। এ যেন বিয়েবাড়ি। চিৎকার করে ডাকেন বুয়াকে- অকারণে এতগুলো বাতি জ্বালানোর কারণ জিজ্ঞেস করেন। জবাবে বুয়া জানায় যে সে শুধু রান্নাঘর আর ডাইনিংয়ের বাতি জ্বালিয়েছে। বাকি ঘরের বাতি জ্বালিয়েছে সাদিফ। অনিলার ৭ বছরের ছেলে সাদিফ। কাপড় বদল করে হাতমুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে ছেলেকে কাছে ডাকেন অনিলা। “বাবা তুমি কি জান যে বিদ্যুতের অভাবে কত ভাইয়া, আপু সন্ধ্যার পর ঠিকমতো পড়াশুনা করতে পারে না, কত মানুষ গরমে কষ্ট পায়, কত কলকারখানা চলতে পারে না, কত কৃষক জমিতে পানি দিতে পারে না। আর তুমি কোন কারণ ছাড়া এতগুলো বাতি ও ফ্যান চালিয়ে বিদ্যুৎ নষ্ট করছ- এটা কি ঠিক?” কি বলবে বুঝতে পারে না সাদিফ। ছেলেকে বিদ্যুৎ সমস্যার কথা বুঝিয়ে অনিলা বলে, তোমার মত সবাই যদি একটু একটু করেও বিদ্যুৎ নষ্ট করে, তবে সবারটা মিলে বিশাল পরিমাণ বিদ্যুতের ক্ষতি হবে। আর যদি আমরা বিনা কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে পারি তবে সবাই এর উপকার পাবে। অনিলা চাকরিজীবী। সারাদিন বাসায় থাকেন না। তাই সংসারের ভালমন্দের ব্যাপারে কাজের লোকের উপর নির্ভর করতে হয়। শুধু ছেলেমেয়েকে নয়, বাসার কাজের লোককেও মিসেস অনিলা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। ঘরের সবাইকে এ শিক্ষা দিয়েছেন যে কাজ শেষে কক্ষ ত্যাগের পূর্বে অবশ্যই ফ্যান-লাইটের সুইচ বন্ধ করতে হবে। নিজেও বাসা এবং অফিস উভয়স্থলেই এ ব্যাপারে অতি সাবধান থাকেন। ফ্যান-লাইট ছাড়াও অন্যান্য বিদ্যুতিক সামগ্রীর ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি অনিলার। আসলে বাসাবাড়িতে বৈদ্যুতিক সামগ্রী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষরা ক্রয় করে থাকলেও এদের পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে নারীদের উপর। তাই মা-বোনদের সতর্কতার উপরে নির্ভর করে কতটুকু বিদ্যুৎ অপচয় হবে অথবা সাশ্রয় হবে।
আজকাল অর্থনৈতিকভাবে সামান্য সচ্ছল এমন পরিবারেও ফ্রিজ থাকে। আর ধনী পরিবারে তো দু’তিনটি ফ্রিজ রাখা কোন ব্যাপারই না। মোট বিদ্যুৎ খরচের বড় একটা অংশ যায় ফ্রিজ ব্যবহারে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য ফ্রিজটি ঘরের এমন স্থানে রাখতে হবে যেখানে সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে। এর ফলে ফ্রিজটি যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে তা বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। তবে সরাসরি সূর্যের আলো বা রোদ যাতে না পরে অথবা চুলার বা ওভেনের কাছাকাছি যাতে ফ্রিজ না রাখা হয় তা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। ফ্রিজের চারপাশে কয়েক ইঞ্চি করে জায়গা খালি রাখতে হবে। বরফ বোঝাই ফ্রিজ চলতে শক্তি খরচ হয় বেশি। তাই ফ্রিজে বেশি বরফ জমে গেলে সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। ফ্রিজের তাপমাত্রাও প্রয়োজন অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনের বেশি খরচের অর্থই হলো বেশি বিদ্যুৎ খরচ। অনেকে ফ্রিজ থেকে জিনিসপত্র বের করার জন্য কয়েক মিনিট পর্যন্ত ফ্রিজের দরজা খুলে রাখে। এতে ফ্রিজের ভেতরের ঠা-া বাতাস বেরিয়ে সহজেই গরম হয়ে উঠে ভেতরের তাপমাত্রা। এ গরমকে ঠা-া করতে খরচ হয় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ। কখনোই কোন গরম খাবারকে ফ্রিজে ঢোকাবেন না। কারণ গরম খাবারকে ঠা-া করতে এবং একে ঠা-া রাখতে ফ্রিজ বেচারাকে করতে হয় অধিক পরিশ্রম এবং অধিক শ্রম যে অধিক শক্তি দাবী করে তাতো বলাই বাহুল্য। সুতরাং খাবার রান্নার পর সম্পূর্ণরূপে ঠা-া করে তা ফ্রিজে ঢোকানো উচিত। বরফকৃত মাছ-মাংস সাধারণত বাইরে রেখে বা পানিতে ভিজিয়ে বরফ ছাড়ানো হয়। এ ক্ষেত্রে মাছ-মাংস রান্নার আগের দিনই যদি ফ্রিজের স্বাভাবিক অংশে রেখে বরফ ছড়ানো হয় তবে এতে করে ফ্রিজের বিদ্যুৎ খরচ যেমন কম হবে তেমনি খাদ্যদ্রব্যের মান ও স্বাদ বজায় থাকবে।
কাজের লোকের অভাবে অনেক বাসায় ওয়াশিং মেশিনে কাপড় ধোয়া হয়। যদিও এর জন্য বিদ্যুৎ ব্যয় খুবই বেশি। তবে এ যন্ত্রটি ব্যবহারের কিছু কৌশল বিদ্যুৎ ভোগের পরিমাণ কমাতে পারে। কাপড় ধোয়ার যন্ত্র চালনার জন্য ব্যবহৃত মোট বিদ্যুতের শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ ব্যয় হয় এর ভেতরকার পানি গরম করতে। কম তাপমাত্রার পানিতে কাপড় ধুয়ে মোট খরচের প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যায়। আমাদের দেশে রোদ প্রচুর তাই মেশিনে কাপড় না শুকিয়ে রোদে বা বাইরের বাতাসে কাপড় শুকানো হলে বাড়তি বিদ্যুৎ খরচের হাত থেকে রেহাই পাবেন। রিমোর্ট কন্টোলারের যুগে আমরা রিমোর্ট কন্টোলের বোতাম টিপে টেলিভিশন, রেডিও বা সিডি প্লেয়ার বন্ধ করলেও মূল বোতামটি চেপে যন্ত্রটি বন্ধ করি না। এমনকি বৈদ্যুতিক সংযোগকারী সুইচটিও বন্ধ করি না। এতে করে যন্ত্রটির সাথে বৈদ্যুতির সংযোগ থাকায় যন্ত্রটি চালু অবস্থায় যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করে স্ট্যান্ডবাই অবস্থায় থাকায় এর শতকরা ৮৫ ভাগ বিদ্যুৎ খরচ হয়। সুতরাং যখন আমরা টিভি দেখা বা রেডিও, সিডি প্লেয়ার শোনা মেশ করব তখই যেন সংযোগকারী বৈদ্যুতিক সুইচটিও বন্ধ করি। একই কথা কম্পিউটার, বৈদ্যুতিক ওভেন ইত্যাদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গৃহস্থালীর মোট বিদ্যুৎ খরচের শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ হল বাতি খরচ। এ ক্ষেত্রে এনার্জি সেভিং বাল্ব ব্যবহার উপকারী। এ ধরনের বাল্বের মূল্য বেশি হলেও প্রচলিত বৈদ্যুতিক বাতির চেয়ে এ বাল্ব ১০ গুণ বেশি সময় টিকে এবং ৪ ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ খরচ করে। স্বাভাবিক বাতির ক্ষেত্রে আপনার যদি ১০০ ওয়াট প্রয়োজন হয় এনার্জি সেভিং বাল্বের ক্ষেত্রে মাত্র ২০-২৫ ওয়াটই যথেষ্ট হবে। তবে মূল কথা হল যে ধরনের বাতিই আপনি ব্যবহার করেন না কেন। কোন কক্ষ ত্যাগের পূর্বে ঐ কক্ষের বাতি এবং সেই সাথে ফ্যানের সুইচও বন্ধ করবেন এবং বিনা কারণে বারান্দার বাতিও জ্বালিয়ে রাখবেন না। আর ঘরের বাইরের রাস্তা বা বাগানে যত কম বাতি জ্বালানো যায় ততোই আপনার বিদ্যুৎ ব্যয় কমবে। আর আজকালতো বাগানে ব্যবহারের জন্য সোলার গার্ডেন লাইট পাওয়া যায়। এ ধরনের বাতির জন্য আলাদা কোন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রয়োজন হয় না। এর মধ্যস্থিত বৈদ্যুতিক কোষের সাহায্যে দিনের বেলা সৌরশক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং রাতে আলো দেয়।
বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এয়ার কন্ডিশনার ও বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বলা যায় পাখা দিয়ে যদি কাজ হয় তবে এয়ার কন্ডিশনার ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ উদহারণস্বরূপ একটি বৈদ্যুতিক পাখায় যদি ঘণ্টায় ৩০ পয়সার বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয় সেখানে একটি এয়ার কন্ডিশনার চালাতে লাগবে ঘণ্টায় ১০ টাকা। একান্তই যদি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটি চালাতে হয় তবে মনে রাখবেন ২২ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা রাখলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয় শতকরা ৩ থেকে ৫ ভাগ। সেজন্য বিশেষজ্ঞদের মতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিণ যন্ত্রের থার্মোস্ট্যাট ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা যেমন আরামদায়ক তেমনি খরচ বাঁচায়। আর বৈদ্যুতিক পাখার ক্ষেত্রে ধাতব ব্লেডের পরিবর্তে ফাইবার ব্লেড ব্যবহার করলে শতরা ২০ ভাগ বিদ্যুৎ খরচ কমে।
ঘরের জানালার কাচে বিভিন্ন রং বিশেষ করে পশ্চিম দিকের জানার কাচে সবুজ রংয়ের নেট বা জাল লাগালে ইহা সূর্য রশ্মির সরাসরি প্রবেশে বাধা দেয়। অন্যদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের দরজা, জানালার ফাঁকফোকর বন্ধ এবং জানালার কাচে বিভিন্ন রংয়ের প্রলেপের সাহায্যে ঘরের ঠা-া হাওয়া বাইরে যেতে বাধা দেয়া হলে এয়ার কন্ডিশনারের উপর চাপ পড়ে কম এবং এ খাতে বিদ্যুৎ খরচ হয় শতকরা ৪০ ভাগ। বিদ্যুৎ ব্যবহারে গৃহকর্ত্রী হিসাবে আপনার নিজের সতর্কতাই যথেষ্ট নয় বরং এ ক্ষেত্রে পরিবারের সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন। তাই সচেতন করুন আপনার কর্তা, সন্তান, কাজের লোক, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে। একজন নারী হিসেবে আপনার একটু সচেতনতা ও সতর্কতা একদিকে আপনার বিদ্যুৎ বিল কমাতে সহায়তা করবে। অন্যদিকে সকল নারীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে বড় আকারে অবদান রাখতে সহায়তা করবে। মনে রাখবেন, বিদ্যুতের এ সংকটময় মুহূর্তে আপনার সামান্য একটু উদ্যোগ আপনার সন্তানকে দেবে বৈদ্যুতিক আলোতে সারা সন্ধ্যা পড়ার সুযোগ, সারারাত বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে ঘুমানোর নিশ্চয়তা, আপনার দেশের কৃষিক্ষেত্র ও কলকারখানায় দেবে অবিরাম বিদ্যুৎ সরবরাহ। সুতরাং আর নয় বিদ্যুৎ অপচয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন