বিশ্বের সব মানুষের মাথাব্যথার বড় কারণ এখন অদৃশ্য করোনাভাইরাস। প্রতিদিনই সে রূপ বদলে আরো শক্তিশালী ও ক্ষতিকর হয়ে উঠছে। আমাদের দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। নিত্যদিন শত শত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে বজ্রপাতেও অনেক প্রাণ ঝরছে। দেশে এক দশকে অন্য যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। মাত্র কয়েক বছরে দেশে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যমতে, গত দেড় মাসে দেশে বজ্রপাতে ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে এপ্রিলে ১১০ জন ও মে- মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত ৫৭ জন মারা গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ক্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৯ , এই এক দশকে দেশে বজ্রপাতে মোট মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ৮১। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাণহানি ঘটে ২০১৮ সালে। ওই বছর বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৫৯। এর আগের বছর মারা যায় ৩০১ জন, যা গত এক দশকে দ্বিতীয় সর্ব্বোচ্চ। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ২০৫। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ১৬০, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১২ সালে ২০১, ২০১১ সালে ১৭৯ ও ২০১০ সালে ১২৩ জনের মৃত্যু ঘটে। বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে হাওরাঞ্চলের তিন জেলা কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বেশি ঘটে কালবৈশাখীর সময় এপ্রিল-জুন মাসে। আন্তর্জাতিক গবেষণা মতে, বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০ টি বজ্রপাত হয়ে থাকে। বিশ্বে বজ্রপাতপ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ। তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি, প্রচুর মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর রেডিয়েশন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উচুঁ গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, জলাধার ভরাটসহ নানা কারণে বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে।
বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার সাথে বিশ্বময় তাপমাত্রা পরিবর্তনেরও সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ডিজাস্টার ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে গত দেড় মাসে বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা গেছে সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা , কিশোরগঞ্জ এবং গাইবান্ধায়। বজ্রপাতে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই মাঠে কাজ করছিলেন বা মাছ ধরছিলেন। মৃতদের মধ্যে পুরুষ প্রায় ৯০ শতাংশ বলেও সংস্থাটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, বজ্রপাতের কারণে একজন মানুষের মৃত্যুর সাথে আশপাশের অন্তত ১০ জন আহত হচ্ছে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হিসাব। আহতদের প্রায় সবাই স্থায়ীভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে। হাওর ও বিস্তীর্ণ বিল এলাকার জেলাগুলোতে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টির সময় মাঠে যারা কাজ করেন, নৌকায় বা পথঘাটে চলাচল করেন, তারাই বজ্রপাতের শিকার হন বেশি। দুর্যোগ-বিষয়ক বিজ্ঞান নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের মতে, প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা ও বজ্রপাত নিরোধক বা অ্যারেস্টার স্থাপনের মাধ্যমে বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ কমিয়ে আনা সম্ভব। কাজটি সরকারকে করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে আরো বেশি সচেতন ও সাবধান হতে হবে।
কালবৈশাখীর সময় আকাশে কালো মেঘ দেখা দিলে, খোলা মাঠে-ঘাটে কাজ করা যাবে না। বাসাবাড়িতে আর্থিংয়ের ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাছাড়া মাঠে-ঘাটে প্রচুর পরিমাণে উচুঁ গাছ লাগাতে হবে। এত কিছুর পরও কৃষককে শস্য কাটতে মাঠে যেতে হবে। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। বজ্রপাতের প্রকোপ কমাতে হাওর ও বিল অঞ্চলে মোবাইল ফোনের টাওয়ারে লাইটিং অ্যারেস্টার লাগিয়ে নতুন এই দুর্যোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনার উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। এই প্রযুক্তি ব্যয়বহুল হলেও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থেই এই অর্থ খরচ করতে হবে।
বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে নিজে জানুন, অন্যকে জানান-
* এপ্রিল-জুন মাসে বজ্রবৃষ্টি বেশি হয়; বজ্রপাতের সময়সীমা সাধারণত ৩০-৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করুন।
* ঘন কালো মেঘ দেখা দিলে ঘরের বাহির হবেন না; অতি জরুরি প্রয়োজনে রবারের জুতা পড়ে বাইরে বের হতে পারেন।
* বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ অথবা উচুঁ স্থানে থাকবেন না।
* বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভার দিয়ে এবং কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকুন।
* যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংইক্রটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন। টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।
* উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি থেকে দুরে থাকুন।
* কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর , ডোবা বা জলাশয় থেকে দুরে থাকুন।
* বজ্রপাতের সময় গাড়ীর ভেতর অবস্থান করলে, গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ ঘটাবেন না; সম্ভব হলে গাড়ীটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিন।
* বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি ও বারান্দায় থাকবেন না। জানালা বন্ধ রাখুন এবং ঘরের ভিতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকুন।
* বজ্রপাতের সময় মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সকল বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন এবং এগুলো বন্ধ রাখুন।
* বজ্রপাতের সময় ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করবেন না। জরুরি প্রয়োজনে প্লাস্টিক বা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করতে পারবেন।
* বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখুন এবং নিজেরাও বিরত থাকুন।
* বজ্রপাতের সময় ছাউনি বিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাবেন না, তবে এ সময় সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করুন।
* বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির ধাতব রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করবেন না।
* প্রতিটি বিল্ডিং-এ বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন নিশ্চিত করুন। * খোলা স্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যান।
* কোন বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে যান।
* বজ্রপাতে কেউ আহত হলে বৈদ্যুতিক শকে আহতদের মত করেই চিকিৎসা করতে হবে। প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসককে ডাকতে হবে বা হাসপাতালে নিতে হবে। বজ্র আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ও হ্রদ স্পন্দন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তাই বজ্রপাতের হাত থেকে বাচাঁর ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে শিক্ষক-শিক্ষিকা, ইমাম-খতিব, জনপ্রতিনিধি, মোড়ল-মাতব্বর, কবি, লেখকসহ পরিবারের কর্তা সবারই দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
ডা: মাও: লোকমান হেকিম
শিক্ষক-কলামিস্ট, মোবাইল : ০১৭১৬২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন