শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কাম্য পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিতে হবে

ইছমত হানিফা চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৫ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

মানুষ পরিবেশের অংশ। তাই তো পরিবেশ বিজ্ঞানী ডি, এইচ, লরেন্স বলেছেন ‘কার সন্তান তাতে কিছু যায় আসে না। কী আবহাওয়ায় মানুষ, তাই নিয়ে কথা।’ অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের বেড়ে উঠায় পরিবেশের প্রভাব পড়ে। এক কথায় বলা যায়, পরিবেশের প্রভাবকে তুচ্ছ জ্ঞান করা যায় না। বরং, পরিবেশই মানুষকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবেও বলা যায়, মানুষ মাত্রই প্রকৃতির দাস। কিন্তু তার চাইতেও বড় সত্য, পরিবেশ প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক। পরিবেশ মানবসভ্যতার এক গুরুত্বর্পূণ উপদান। সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে পরিবেশ। মানুষের রচিত পরিবেশ তারই সভ্যতা-বিবর্তনের ফসল। পরিবেশই প্রাণের ধারক, জীবনীশক্তির যোগানদার। যুগে যুগে পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে প্রাণীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপরেই তার অস্তিত্ব নির্ভরশীল। পরিবেশ প্রতিকূল হলে জীবের ধ্বংস ও সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী। পরিবেশের বিরুদ্ধতা বেঁচে থাকার পথকে অবলীলাক্রমে রুদ্ধ করে। পরিবেশের ওপর সম্পৃক্ত হয়ে মানুষ অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র। কিন্তু নানা কারণে পরিবেশ দূষণ প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে চলছে নানা গবেষণা। এ ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ৫ জুনকে ঘোষণা করেছে, ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে।

নিজের চিন্তা, রাষ্ট্রের চিন্তা এবং পরিবেশ নিয়ে বিশ্ব চিন্তা এক করলে, পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন কারণ মূলত একই রকম। সব মিেিল ১৫টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যথা: ১) জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ২) অপরিকল্পিত নগারয়ন, ৩) বনভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার, ৪) প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, ৫) দ্রুত শিল্পায়ন, ৬) সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, ৭) বনভূমি উজাড়, ৮) কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, ৯) গাড়ির বিষাক্ত ধোয়া, ১০) ওজন স্তরের ক্রমাবনতি, ১১) এসিড বৃষ্টি, ১২) অপরিকল্পিত গৃহ নির্মাণ, ১৩) দারিদ্র্য, ১৪) প্রসাধন সামগ্রী, ১৫) প্লাস্টিক ইত্যাদি

দূষণের ভয়াবহতা: মানুষ একদিন প্রকৃতিকে জয় করার নেশায় মেতেছিল। প্রকৃতিকে জয় করেও মানুষের সেই নেশার অবসান হলো না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ জলে-স্থলে মহাশূণ্যে আধিপত্য বিস্তার করল। কিন্তু মানুষের এই বিজয় মানুষকে এক পরাজয়ের মধ্যে ফেলে দিল। দূষণের কবলে পড়ে আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শঙ্কায় ধুঁকছে। আজ পানিতে বিষ, বাতাসে আতঙ্ক, মাটিতে মহাত্রাস। আজ কত শত গাছ আর প্রাণী বিলুপ্ত। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশে মৃত্যুর সংখ্যা অগনিত, যখন সৎকারের নির্দিষ্ট ব্যবস্থাও অপ্রতুল, তখন অনেক লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে গঙ্গায়, যা কোনভাবেই উচিত নয়, কোনভাবে কাম্য নয়, অথচ বাস্তবে তাই ঘটছে।

পরিবেশ বাঁচাতে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সবার আগে নদী বাঁচাতে হবে। নদীর পানি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, গাছ গাছালি রক্ষা করে। গাছ বেষ্টিত বনাঞ্চলে গড়ে প্রাণীর আবাস নিশ্চিত করতে হবে। মানুষও প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির সার্কেলে। একে অপরকে জড়িয়ে তবেই পরিবেশ। এ পরিবেশ থেকে একটা কিছু বিলুপ্ত হওয়া মানে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়া। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যে মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু বাস্তবে এখন বেশিরভাগ দেশেই গাছের বা বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে গেছে, যার প্রভাবে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হচ্ছে পৃথিবী। আজকের এই করোনা মহামারির পিছনে রয়েছে চীনের উহান প্রদেশ পরিবেশের দূষণের গল্প। প্রতি বছর বাতাসে বিপুল পরিমাণ অক্সিজেন কমছে। বিজ্ঞানের অপব্যবহারে ভূপ্রকৃতির ওপর অত্যাচার বাড়ছেই। অধিক ফলন এবং শস্য রক্ষার জন্য নানা ধরনের কীটনাশক ঔষধ তৈরি ও প্রয়োগ হচ্ছে। এর ফলে সশ্যদানার সঙ্গে বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যের অনুপ্রবেশ ঘটছে মানুষের শরীরে। পরিবেশ দূষণের জন্য পৃথিবীতে ৮০ শতাংশ নতুন নতুন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তরের আয়তন ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে, ফলে আগামীতে সূর্যের মারাত্মক অতিবেগুনি রশ্মি প্রাণীজগৎকে স্পর্শ করবে।

পানি, মাটি, বায়ু ছাড়া আরও এক ধরনের দূষণ আজ মানুষকে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। এর নাম শব্দদূষণ। শব্দদূষণের ক্ষতি ধীরে ধীরে, অপ্রত্যক্ষভাবে ঘটে। শব্দদূষণ শুধু শ্রবণশক্তিকেই দুর্বল করে না, মাথা ধরা, ক্লান্তি অনিদ্রা, ক্ষিধের অভাব, বমির উদ্রেক- এগুলোরও অন্যতম কারণ শব্দদূষণ। তাই অনাকাক্সিক্ষত সুরে চড়া শব্দে মাইক বাজানো, অপ্রয়োজনে উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন থেকে আমরা যেন বিরত থাকি।

আজ সবচেয়ে জরুরি, বিশ্ব পরিবেশ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা। ছোট বড় সবাইকে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান করা। যে কোনো দিবস আয়োজন করা হয়, মানুষকে সে বিষয়ে সচেতন করে তোলার জন্য। তাই ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আনন্দ অনুষ্ঠান নয়, বক্তৃতা বিবৃতি নয়, এদিনের প্রকৃত গুরুত্ব উপলদ্ধি করা উচিত। গাছ লাগানোর ব্যাপারে আমাদের দেশের অনেককে বলতে শোনা যায়, আমার ইচ্ছা আছে বৃক্ষ রোপণ করে বনাঞ্চল সৃষ্টি করার। কিন্তু আমার নিজের কোনো জায়গা নেই। এক্ষেত্রে সরকারি খাস জায়গা শর্ত সাপেক্ষে সাধারণ মানুষের মাঝে যারা বৃক্ষ রোপণে ইচ্ছুক, তাদের দেওয়া যেতে পারে। আবার অফিস, আদালত হসপিটালসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তার বাসগৃহের সামনে পিছনে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করলে বৃক্ষ রোপণে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি আসবে। আরেকটা ব্যাপার, প্লাস্টিক ব্যবহার ও বর্জনে আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন