শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

সত্যালোকের সন্ধানে - সালাত দর্শন : একটি তাত্ত্বিক সমীক্ষা

প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ, কে, এম ফজলুর রহমান মুন্্শী
ইসলামী ইবাদতের প্রথম রোকন যা আমীর, গরীব, বৃদ্ধ, যুবক, নারী, পুরুষ, সুস্থ, রোগী সকলের উপর সমভাবে ফরজ এবং এটা এমন ইবাদত যা কোন অবস্থাতেও সাকেত বা বিলোপ হয়ে যায় না, এমনকি এই ফরজকে কেউ দাঁড়িয়ে আদায় করতে না পারলে বসে হলেও আদায় করতে হয়, এতেও যদি সে অপারগ হয় তাহলে ইশারায় আদায় করতে হয়, আর যদি মুখে এই ইবাদতের শব্দাবলী উচ্চারণ করতে না পারে তা হলে ইশারায় আদায় করতে হয়, যদি দাঁড়িয়ে আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে চলমান অবস্থায়ই তা আদায় করতে হয়, আর যদি সে কোন যানবাহনের উপর সওয়ার হয়ে থাকে তাহলে যেদিকে তা গমন করে সেদিকেই মুখ করে আদায় করতে হবে। এই ইবাদতকেই সালাত বলা হয়। ফার্সী এবং বাংলা ভাষায় আরবি সালাত শব্দটির প্রতিশব্দ নামাজ। তবে সালাত শব্দের মূল ব্যঞ্জনা প্রতিশব্দের দ্বারা ষোলআনাভাবে লাভ করা যায় না, যদিও এর দ্বারা পরিচয়ের সেতুবন্ধন রচিত হয়ে থাকে। (নায়লুল আওতার : ২ খঃ ২৮ পৃঃ দারুকুতনী, আবু দাউদ, রাবে সালাতুত তালেব, সহীহ মুসলিম কিতাবুস সালাত)
আল-কুরআনে বারবার ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আকিমুস সালাত’ অর্থাৎ সালাত কায়েম কর। কায়েম করা বা প্রতিষ্ঠা করা শুধু কেবল নিজের জন্যই নির্ধারিত নয়। বরং সমভাবে সকলের জন্যই সালাতের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। সুতরাং সালাত প্রতিষ্ঠার অন্তর্নিহিত মর্ম অনুধাবন করার জন্য যতœবান হওয়া দরকার।
আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ অর্থাৎ অবশ্যই আমার সালাত আমার কুরবানী আমার জীবন এবং আমার মরণ কেবল মাত্র আল্লাহর জন্যই নিবেদিত। মোট কথা সালাত সত্যিকারভাবে আল্লাহর জন্যই হতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনের কোণে এই জিজ্ঞাসার বুদবুদ ভেসে উঠা অস্বাভাবিক নয় যে, সালাত কেমন করে আল্লাহর জন্য হবে? সালাত কিভাবে আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের সহায়ক হতে পারে? তবে হ্যাঁ, এই শ্রেণীর জিজ্ঞাসার স্বাভাবিক ও সহজ উত্তর লাভ করার একটি উপায় আছে। আসুন, এই সহজ উপায়টির দ্বারা সালাতের সাথে আল্লাহ পাকের নিগুঢ় সম্পর্কের পরিচিত লাভ করা যাক।
সম্পর্কের পরিচিতি :
ক) আরবি ভাষায় আল্লাহ শব্দটি লিখলে চারটি বর্ণ ব্যবহার করতে হয়। যথা- আলিফ, লাম, লাম এবং হা। অর্থাৎ আল্লাহ শব্দটি ঐ বর্ণ চতুষ্টয়ের দ্বারা গঠিত। অনুরূপভাবে আরবি সালাত শব্দটিতেও মূলত চারটি বর্ণ রয়েছে। যেমনÑ সোয়াদ, লাম, ওয়াও এবং তা। কখনো কখনো লেখতে গিয়ে সালাত শব্দটির তৃতীয় বর্ণটি ওয়াও এর স্থলে আলিফ লেখা হয়। এতে করে সালুত পাঠ না করে সালাত পাঠ করা হয়। লিখিত আকারে ওয়াও বর্ণটি ব্যবহৃত হলেও উচ্চারণে আলিফের প্রাধান্যই বহাল থাকে। সে যাই হোক, সালাত শব্দের তৃতীয় বর্ণটি আলিফ অথবা ওয়াও যা-ই হোক না কেন আক্ষরিক দিক হতে আল্লাহ শব্দের সাথে বর্ণ সমষ্টির ভিত্তিতে সালাত শব্দটির গভীর মিল রয়েছে। আল্লাহ শব্দে যেমন চারটি বর্ণ পাওয়া যায় তেমনি সালাত শব্দেও চারটি বর্ণই দেখা যায়। অতএব একথা বলা খুবই সঙ্গত যে, চার-এর সাথে চার-এর মিল ও বন্ধন একসূত্রে গাঁথা এবং চির অম্লান।
খ) যিনি সালাত কায়েম করেন তাকে আরবি ভাষায় মুসল্লী বলা হয়। উচ্চারণের দিক হতে দেখা যায়, এই মুসল্লী শব্দেও চারটি বর্ণই রয়েছে। শুধু তাই নয়, দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করাকে ‘কিয়াম’ বলা হয় এবং বসে আদায় করাকে ‘কুয়ুদ’ বলা হয়। হিসেব করলে দেখা যাবে এই কিয়াম ও কুয়ুদ শব্দদ্বয়েও চারটি বর্ণই স্থান লাভ করেছে। অর্থাৎ মুসল্লী কিয়াম এবং কুয়ুদের হালতেও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। কেননা বান্দাহর জন্য আল্লাহর দীদার এমনি তরো সত্য প্রতিষ্ঠার দ্বারাই সম্ভব।
গ) সালাতের প্রতিটি কর্মকা-ই চার বর্ণে গঠিত বাক্যের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন সূরা, কেরায়াত, কাওমা, জলসা, সালাম, রুকু এবং সেজদাহ। এই শব্দগুলোর প্রতি গভীরভাবে তাকালে যে চিত্রটি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাহলো চার বর্ণ সম্বলিত সালাতের অবস্থা ও কাঠামো নির্দেশক কতিপয় শব্দ বা সংখ্যার দিক হতে একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ এবং একইভাবে মুসল্লী দেহ-মন উজার করে দিয়ে আল্লাহর দীদারের প্রত্যাশার প্রহর গুণেই চলে। চলার এই গতি যখন কুরআনের নির্দেশ মোতাকের হয় তখন আল্লাহর সান্নিধ্য, নৈকট্য ও কুরবতের পথে কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর পারে না বলেই মুসল্লীর দেহ-মন সম্পর্ণরূপে বিকলাঙ্গ, রুগ্ন, রোগাক্রান্ত অবস্থা হতে চিরমুক্ত ও নির্মল পরিবেশে বিরাজ করতে থাকে। এই মধুময় অবস্থার কথা তুলে ধরে আল-কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘ইন্নাস সালাতা তানহা আনিল ফাহশায়ি ওয়াল মুনকার।’
অর্থাৎ অবশ্যই সালাত বিরত রাখে নির্লজ্জতা ও অপবিত্রতার হাত হতে। কেননা যা পবিত্র ও নিষ্কলুষ, যা নিদাগ ও নির্মল। আল্লাহপাক তাকেই পছন্দ করেন এবং যা কদর্য লজ্জাকর ও অমঙ্গলের ধারক ও বাহক তাকে কখনো পছন্দ করেন না। আর এটাও সত্য যে, যা পছন্দনীয় ও সৌন্দর্যম-িত তার সাথে আল্লাহপাকের রহমতের গভীর যোগাযোগ রয়েছে। এই যোগাযোগই মূলত আল্লাহর জন্য নিবেদিত চিত্তে সালাত কায়েমের প্রতি অনুপ্রাণিত করে।
(ঘ) সালাত কায়েমের লক্ষ্যে মুসল্লি কিবলা ও কাবার দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আরবি কিবলা ও কা’বা শব্দদ্বয়ে চারটি করে বর্ণই রয়েছে। মোটকথা সালাতের সকল অবস্থা চার সংখ্যার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে। এই চার-এর মাধ্যমেই সালাত মূলত আল্লাহর জন্যই হতে হবে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
(ঙ) সালাত কায়েমের লক্ষ্যে বান্দাহ জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে আত্মবিস্তৃতির অতল তলে হারিয়ে যেতে থাকে। দুনিয়ার সাথে তার কোনো সম্পর্কই থাকে না। এমনি করে সে আল্লাহর মহব্বতের সাগরে অবগাহন করার সুযোগ লাভ করে এবং একান্তভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে ধন্য হয়। এ অবস্থা চতুষ্টয়ের ক্রমবিকাশই সালাত কায়েমে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম এবং বান্দাহর সাথে আল্লাহপাকের মহামিলনের পথ রচনা করে দেয়। এতে করেই সালাত তার জন্য মে’রাজরূপে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। আর এই অর্থেই সালাত মুমিন বান্দাহর মে’রাজরূপে সুপরিচিত।
(চ) সালাত কায়েমের জন্য তাহুর অর্থাৎ শারীরিক পবিত্রতা একান্ত অপরিহার্য। এই পবিত্রতা অজু এবং গোসলের দ্বারা অর্জিত হয় অথবা তায়াম্মুম-এর দ্বারাও হাসিল হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আরবি ‘ওয়াজু’ ‘তায়াম্মুম’ এবং ‘ইগসিল’ শব্দত্রয়েও চারটি বর্ণই আছে। মোটের ওপর সালাত কায়েমের প্রস্তুতি কার্য সম্পাদন এবং সালাম প্রদানের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান হতে মুক্তিলাভ করা সবকিছুই চার সংখ্যার সাথে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা রয়েছে।
(ছ) সালাত কায়েমে মানব দেহ, মন, মুখ, চোখ, হাত, কান ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এক নিবিষ্টতার সবক দান করে। এই এক নিবিষ্টতার ব্যবহারিক দিক চারটি পর্যায়েই বিন্যস্ত। যেমনÑ কিয়াম (দাঁড়ানো), কুয়ুদ (বসা), রুকু (অবনত মস্তকে ঝুঁকে পড়া) এবং সিজদাহ (জমিনের উপর কপাল স্থাপন) ইত্যাদি। সুতরাং সালাত যেমন চার বর্ণের সমাহার, অনুরূপভাবে ‘কায়েম’ শব্দটিও চার-এরই প্রকাশ। যা কেবলমাত্র আল্লাহকেই নির্দেশ করে।
সালাতের রূহানী উদ্দেশ্য
মহান ¯্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বীয় বান্দাহদের অসংখ্য নেয়ামত ও অগণিত বরকত অহরহ প্রদান করেছেন। এসব নেয়ামত ও বরকতের শোকর আদায় করতে হলে দেহ ও মনের নিবিড় সংযোগ একান্ত অপরিহার্য।
মানব দেহ রূহের বাহন বা প্রজা। রূহ দেহের রাজা এবং আরোহী। রূহ যতক্ষণ পর্যন্ত দেহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত রূহের ইঙ্গিতক্রমেই দেহ পরিচালিত হয়ে থাকে। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-হাত, পা, চোখ, নাক, কান স্বেচ্ছায় কোনো কিছু করতে পারে না। কারণ এগুলোর মাঝে যে শক্তি ও সামর্থ্যরে বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়, তা রূহ কর্তৃক বিচ্ছুরিত শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তাই সালাত সম্পাদনে দেহকে যথার্থভাবে পরিচালন করতে হলে দেহকে রূহের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে রাখা ছাড়া বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেছেনÑ “হে লোক সকল। সালাত আদায় করার সময় আদায়কারী আল্লাহপাকের সাথে গোপনে কথাবার্তা বলে। এমতাবস্থায় সালাত আদায়কারীর উচিত কিসব কথাবার্তা সে বলছে তৎপ্রতি খেয়াল রাখা।” (মুসনাদে আহমাদ)
সালাত আদায়কারীর এই সতর্কতার বিশ্লেষণ করে আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ “আর সালাত কায়েম কর অবশ্যই সালাত লজ্জাহীনতা ও গর্হিত কাজ হতে বিরত রাখে এবং আল্লাহর স্মরণই সর্বোত্তম বস্তু।” (সূরা আনকাবুত) এই আয়াতে সালাতের তিনটি হিকমত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত, সালাত লজ্জাহীনতা ও গর্হিত কার্যকলাপ হতে বিরত রাখে। দ্বিতীয়ত, সালাত হচ্ছে আল্লাহর স্মরণ। তৃতীয়ত, আল্লাহর স্মরণ হতে উত্তম বস্তু আর কিছুই নেই। বস্তুত লজ্জাহীনতা ও গর্হিত কার্যকলাপ হতে বেঁচে থাকার নাম পবিত্রতা বা সাফাই। সালাত আদায়কালে যে কোনো রকম আবিলতা মনের মাঝে ভিড় জমালে প্রকৃতপক্ষে মঞ্জিলে মাকসুদে উপনীত হওয়া যায় না। এই মঞ্জিলে মাকসুদে উপনীত হওয়ার প্রধান অবলম্বন হলো আল্লাহর স্মরণ বা সালাত। সালাতে বান্দাহর দেহ এবং রূহ একাত্ত হয়ে যখন অগ্রসর হয় তখন আল্লাহর স্মরণ ছাড়া আর কিছুই তার নিকট উত্তম বলে বিবেচিত হয় না। এ অবস্থার বিশ্লেষণ করে আল-কোরআনে আরও ইরশাদ হচ্ছে, “সে অবশ্যই কামিয়াবী হাসেল করেছে যে পবিত্রতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে এবং স্বীয় প্রতিপালকের নাম স্মরণ করেছে এবং সালাত আদায় করেছে।” (সূরা আ’লা) লজ্জাহীনতা ও গর্হিত কার্যকলাপ পরিহারের মাধ্যমেই সত্যিকার পবিত্রতা অর্জিত হয় এবং আল্লাহর স্মরণের দুয়ার পবিত্রতা ছাড়া কিছুতেই উন্মুক্ত করা যায় না। এমনকি আল্লাহর স্মরণের দুয়ার উন্মুক্ত না হলে সালাতও যথার্থভাবে আদায় হয় না।
দেহের সাথে জাগতিক বস্তুনিচয়ের যোগাযোগ অবিচ্ছেদ্য। দেহ যেমন আগুন, বাতাস, পানি ও মাটির সমন্বয়ে গঠিত তেমনি এ সকল উপাদানের প্রতিক্রিয়া দেহের সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়। পানির অভাব দেখা দিলে পিপসা পায়, প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে। বাতাসের অভাব হলে শ্বাসকষ্ট উপস্থিত হয়। চলৎশক্তি রহিত হয়ে আসে। আগুনের অভাব হলে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে আসে। কর্মশক্তি লোপ পেতে থাকে। মাটি বা মাটি জাতীয় পদার্থের অভাব হলে দেহের ওজন কমে যায়, খর্বাকার ধারণ করে এবং দেহ কর্মক্ষম থাকে না। সুতরাং এ সকল উপাদানের জটিলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পূর্ণ আন্তরিকতাসহ সালাত আদায় করাকেই কামিয়াবীর মানদ- হিসেবে আল-কোরআনে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “আপনি অবশ্যই তাদের সতর্ক করতে পারেন যারা না দেখেই স্বীয় পরওয়ারদিগারকে ভয় করে এবং সালাত কায়েম করে, আর যে আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে সে নিজের জন্যই তা করে থাকে এবং পরিশেষে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” (সূরা ফাতের) এতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়, সালাত চারিত্রিক দুর্বলতা থেকে বিরত রাখে এবং মানসিক আবিলতা হতেও মুক্ত রাখে এবং রূহানী পবিত্রতার পথকে সহজ ও সুগম করে তোলে।
দেহ এবং দেহস্থ উপাদানরাজির দ্বারা মুখ্য যে তিনটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা হলো অধৈর্য হওয়া, বিপদে অধীর হওয়া এবং প্রাচুর্যের সময় কৃপণতা প্রকাশ করা। কিন্তু যারা যথার্থভাবে সালাত আদায় করে এবং দৃঢ়তার সাথে তা অবিরত পালন করে যায়, তাদের মাঝে উপরোক্ত তিন প্রকার প্রতিক্রিয়ার প্রভাব পড়তে পারে না। যেমন আল-কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “অবশ্যই মানুষকে ধৈর্যহীন করে পয়দা করা হয়েছে, যখন সে মসিবতে নিপতিত হয়, তখন সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং যখন সে প্রাচুর্যের অধিকারী হয়, তখন বখিল বা কৃপণ সেজে বসে; কিন্তু সালাত আদায়কারী (এ সকল আবিলতা হতে) পবিত্র ও মুক্ত থাকে যখন সে সর্বদা সালাত আদায়ে অভ্যস্ত হয়।” (সূরা মা’আরিজ)
এই পবিত্রতা ও নির্মলতার স্বরূপ উদঘাটন করে রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেছেনÑ “যদি কারো গৃহের সম্মুখ দিয়ে নির্মল ও ¯্রােতস্বিনী নদী প্রবাহিত থাকে, সেখানে সে যদি দৈনিক পাঁচবার গোসল করে তবে কি তার দেহে কোনো রকম ময়লা-আবর্জনা লেগে থাকবে? সাহাবিগণ আরজ করলেন, না, থাকবে না। আল্লাহর হাবীব (সা.) বললেন, সালাত অনুরূপভাবেই গোনাহকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেয়। যেমন পানি ময়লাকে দূরীভূত করে।” (হাকেম, আহমাদ)
একবার একজন গ্রাম্য মুসলমান রাসূলে পাক (সা.)-এর খেদমতে গোনাহ মাফের উপায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। এর উত্তরে আল্লাহপাক এই আয়াত নাজিল করলেন। ইরশাদ হচ্ছে, “দিনের উভয় প্রান্তে এবং রাতের কিয়দংশে সালাত কায়েম কর, অবশ্যই সৎকর্মসমূহ পাপরাশি দূর করে দেয়, এই নসিহত শুধুমাত্র স্মরণকারীদের জন্যই।” (সূরা হুদা) আল্লাহ পাকের সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভের প্রধান অবলম্বন বা পাথেয় বলতে শুধু কেবল দেহকেই বুঝায় না। বরং দেহের রাজা বা নিয়ন্ত্রক রূহের কার্যক্রমই এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। দেহ অনুগত ভৃত্যের মতো রূহের নির্দেশ পালন করতে বাধ্য। তাই রূহানী শক্তির মায়াডোরে দেহকে বশীভূত ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে বান্দাহ যখন সালাত আদায়ে প্রবৃত্ত হয় তখনই শুরু হয় মহান আল্লাহর সাথে বান্দাহর কথোপকথনের পালা। এই তত্ত্বকে তুলে ধরে রাসূলে পাক (সা.) ইরশাদ করেছেনÑ “সালাত আদায়কালে কেউ যেন সামনের দিকে থু থু নিক্ষেপ না করে, কারণ বান্দাহ তখন স্বীয় প্রতিপালকের সাথে মনের গোপন কথা ব্যক্ত করতে ব্যস্ত থাকে।” (বুখারি, মুসলিম)
সালাত আদায়কারী রূহানী শক্তি যদি দেহের গতি-প্রকৃতিকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ না হয় কিংবা দেহের চাহিদা রূহানী প্রত্যাশার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে, তাহলে বান্দাহর কোনো পথ অবলম্বন করতে হবে এবং কেমন করে রূহানী অবস্থার উন্নয়ন সাধনে তৎপর হতে হবে, এই তথ্যকে তুলে ধরে আল্লাহর হাবীব ইরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে নিষ্পন্ন কর যেন তোমরা আল্লাহ পাককে দেখতে পাচ্ছ, যদি তোমরা দেখতে সক্ষম না-ও হও তবে তিনি অবশ্যই তোমাদের দেখছেন।” (সহিহ মুসলিম) সুতরাং সালাতের রূহানী উদ্দেশ্য ও এর সুষ্ঠু পরিণাম হচ্ছে এই যে, কুল মাখলুকাতের ¯্রষ্টা সার্বভৌম মালিকানার অধিকারী রাব্বুল আলামিনের প্রদেয় সীমাহীন নেয়ামত ও বখশীশের শোকর গুজারী দিলে এবং মুখে একাত্ম হয়ে আদায় করা এবং মনে-প্রাণে, চিন্তা-চেতনায় তার শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের সামনে নিজের দৈন্যতা ও দুর্বলতার কথা তুলে ধরে সর্বদা অবনত থাকা; আল্লাহর মহব্বতে নিজের মন-প্রাণ দেহকে উজাড় করে বিলিয়ে দেয়া এবং মনের আবেগ তার সন্নিধানে তুলে ধরা এবং কাজে ও কথায় এর যথার্থ প্রতিফলন সাধনে তৎপর হওয়া।
যেন মহান রাব্বুল আলামিনের দয়া ও করুণার দুয়ার খুুলে যায় এবং বান্দাহ আল্লাহর নৈকট্যের অসীম সাগরে নিবেদিত প্রাণে বিলীন হয়ে যায়। এই নিঃসীম আত্মবিলুপ্তির রূপরেখাকে তুলে ধরে জনৈক পার্সিয়ান কবি কত সুন্দরই না গেয়েছেন, “এত্তেছালি বে তাকাইয়্যুফ বে কিয়াস, হাস্ত রাব্বুন্নাসি রা’বা জানি নাস।” রাব্বুন নাস অর্থাৎ মানুষের প্রতিপালক আল্লাহতায়ালা জানি নাস অর্থাৎ মানুষের রূহ বা প্রাণের সাথে কেমন করে মিশে যান, তার স্বরূপ ও ধারণা বস্তুলব্ধ উপাদান বা উপকরণের দ্বারা অনুধাবন করা মোটেই সম্ভব নয়। যেহেতু মিলন হয় রূহের সাথে, সেহেতু রূহানী শক্তিই এর মূর্ত বিকাশ অনুধাবনে সক্ষম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন