শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

তবুও বাড়ছে খেলাপি ঋণ

তিন মাসের ব্যবধানে বাড়ল ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা : ব্যাংকগুলোকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০২১, ১২:০০ এএম

নানারকম সুবিধা আর ছাড় দিয়েও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। ডিসেম্বর মাসে খেলাপি ঋণ কিছুটা কম হলেও ৩ মাসের ব্যবধানে আবার বেড়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনা মহামারির ক্ষতি বিবেচনায় কিস্তি পরিশোধ না করলেও ব্যাংকের ঋণমান পরিবর্তনের নিষেধাজ্ঞা ছিল অন্যতম সুবিধা। এছাড়া ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনে বিভিন্ন নীতিমালার শর্তে শিথিলতা এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার পরেও গত তিনমাসে ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতি তিন মাস পর পর এই তথ্য প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ আদায়ে শিথিলতা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে সে সময় শেষে মোট খেলাপি কমেছিল। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এ বিষয়ে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ তাদের।
বিশেষ সুবিধা এবং ছাড় দেয়া হলেও ব্যাংক খাতের ‘প্রধান সমস্যা’ খেলাপি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমছে না। একবার কমে আসছে তো আবার বেড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে দেশের ৫৯ টি ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণ ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে শ্রেণীকৃত খেলাপি ঋণ রয়েছে ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। যা বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। ওই অঙ্ক ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর আগে ২০২০ সালের মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ১২২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
সরকারি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে দুই লাখ সাত হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৪৩ হাজার ৪৫০ টাকা। বেসরকারি ব্যাংক আট লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত ব্যাংক ৩০ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা বিতরণ করেছে, এর মধ্যে খেলাপি চার হাজার ৮৬ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংক ৫৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। তাদের খেলাপি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
তিন মাস আগে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৫৯৭ কোটি ২৬ হাজার টাকা কমে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি ছয় লাখ টাকা ছিল, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
২০২০ শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি ৫৩ লাখ। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি ৬ লাখ টাকা। যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু তিন মাস আগেও খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ঋণগ্রহীতা ঋণের কিস্তি শোধ না করলেও তাকে খেলাপির তালিকায় দেখানো যাবে না, ২০২০ সালজুড়ে এমন সুবিধা পেয়েছেন গ্রাহক। এছাড়া খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল, পুনঃগঠনে বিভিন্ন নীতিমালার শর্তে শিথিলতা আনা হয়। এতে করে গত বছরে ঋণের কিস্তি না দিয়েও নতুন করে কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি। যার কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে আসে। কিন্তু চলতি বছর এ সুবিধা রাখা হয়নি। যার ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি বেড়ে যাওয়ার কয়েকটা কারণ হতে পারে। তার মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউ। এর মধ্যে ট্রান্সপোর্ট বন্ধ ছিল, ব্যবসায়ীদের ভালো ব্যবসা হয়নি। আবার প্যাকেজ আসতে পারে বা বাজেট বাস্তবায়ন ইত্যাদি
তিনি বলেন, এর আগে খেলাপিদের অনেকেই ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নতুন করে প্রণোদনার ঋণ নিতে চাওয়ার ফলে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে কিছু টাকা আদায় হয়েছিল। তাছাড়া বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ঋণ আদায়ে শিথিলতা জারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সে সময়ে খেলাপি কিছুটা কমেছিল।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এবার খেলাপি বেড়েছে। এখন ব্যাংকগুলোকে আবার কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি কমাতে হলে অবশ্যই গ্রাহককে একটা মেসেজ দিতে হবে। সেটি হলোÑনতুন ঋণ পেতে আগের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এটা করা না হলে খেলাপি কমানো যাবে।
ব্যাংক খাত বিশেষজ্ঞ মো. নুরুল আমিন বলেন, যখনই যে খাতে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়, তারা সেগুলোর শেষ দেখা পর্যন্ত এর সঠিক প্রয়োগ করেন বলে মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয়, ঋণখেলাপিরা অপেক্ষা করছে- আর কতো ছাড় পাওয়া যায়। আর করোনাকালীন সময়ে এ মানসিকতা আরো বেশি কাজ করছে বলে আমার মনে হয়। এত সুবিধার পরেও কিভাবে খেলাপি ঋণ বাড়লো এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো: সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি সবসময় ঋণের কিস্তির উপরে নির্ভর করেনা। বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে পেমেন্টের উপর নির্ভর করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে ২ লাখ ৭ হাজার ৭৭১ দশমিক ৭৫ জহাজার কোটি টাকা। খেলাপি হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৫০ দশমিক ৬১ হাজার কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংক ৭৯ হাজার ৭৩৮ দশমিক ৬১। খেলাপি ৪৫ হাজার ০বিদেশি ৯০দশমিক ০৩ বা ৫দশমিক ১৩ শতাংশ। ৫৯ হাজার ৫৫৫ খেলাপি ২০৪৫৮ দশমিক ৪৩। ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ । বিশেষায়িত ৩০ হাজার ৫৯২ দশমিক ৭৯ , খেলাপি ৪০৮৬ দশমিক ০২ বা ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিচ্ছে, আসল অঙ্ক এর আড়াই গুণ বেশি। এ ধরনের মিনিংলেস তথ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করছে। এতে আমাদের ব্যাংকিং খাতের ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে। ঋণ আদায় না করে, ঋণ খেলাপিদের নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী মজা পাচ্ছে, তা আমার মাথায় ঢোকে না। ঋণ খেলাপিদের বার বার ছাড় দিয়ে ‘ভালো’ ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে মন্তব্য করে আহসান মনসুর বলেন, এই ভুল সিদ্ধান্ত গোটা ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে বলে আমি মনে করি।
এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব মোকাবেলায় খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে আরও এক দফা ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এবার মেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধ ও বাণিজ্যিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ঋণের মেয়াদ। ফলে ঋণ পরিশোধের সীমা বেড়েছে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি করা হয়েছে ঋণ খেলাপি না করার মেয়াদ। এর মধ্যে তলবি ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২১ মাস বেড়েছে। চলমান ঋণের মেয়াদ বেড়েছে ১৫ মাস। চলমান, তলবি ও মেয়াদি ঋণের মার্চ পর্যন্ত বকেয়া পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে তিন মাস। গত মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠিয়েছে। এর আগে গত বছরে ঋণ খেলাপি না করার মেয়াদ তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে। ১ জানুয়ারি থেকে ওই সুবিধা প্রত্যাহার করে শুধু মেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। তবে বাণিজ্যিক ঋণ নিয়মিতভাবে পরিশোধ করার কথা ছিল। নতুন সার্কুলারে সব ধরনের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধের মেয়াদ বিভিন্ন হারে বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করতে ঋণ পরিশোধের সীমা আরও বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছিল। একই সঙ্গে তারা যেসব প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়িত হয়নি সেগুলোর মেয়াদও বাড়ানোর দাবি করে। ইতোমধ্যে এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।##

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন