শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

খেলাপি ঋণ কমিয়ে রাখা ব্যাংকের কাঠামোকে দুর্বল করে

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

দেশের প্রতিটি অর্জনের পিছনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবদান রয়েছে। এর পরও বলতে হয়, এ খাতটির অবকাঠামোর ক্ষেত্রে এখনও অনেক সংস্কার জরুরি। করোনার দোহাই দিয়ে আমাদের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে নানা সুবিধা গ্রহণ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতিকে চলমান-গতিশীল রাখার জন্য ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করছে। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধে ও কিস্তি পরিশোধের ক্ষেত্রেও নানা সুযোগ-সময় প্রদান করেছে। এসকল সুবিধা গ্রহণ করা সত্ত্বেও অনেক বড় বড় ঋণ গ্রহীতা সময়মত ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। এতে ব্যাংকের ওভারডিউ ও খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। নন-পারফরমিং অ্যাসেটের পরিমাণ বাড়ছে। ঋণ অবলোপণও বাড়ছে। সম্পদের গুণগত মান হ্রাস পাচ্ছে। প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও তা যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা ঋণ পেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা সবাই কাক্সিক্ষত ঋণ পায়নি।
আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নানা সূচকে জোর দিয়েছি। আমাদের রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতিসহ সামষ্টিক অর্থনীতিকে যেভাবে সাজানো হয়েছে সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে তেমন মনোযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের আয় ও সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। ধনী আরও ধনী হচ্ছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। কৃষি উন্নয়নে কাক্সিক্ষত মনোযোগ না দিয়ে কৃষিবহির্ভূত খাতে বেশি বিনিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বড় বড় শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়নে বেশি নীতিসহায়তা দেয়া হয়। ব্যাংকসমূহও এই শিল্পে অর্থায়নে স্বস্তি অনুভব করেছে। ছোট ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বরাবরই অবহেলা প্রদর্শন করছে। ফলে ব্যাংকের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে গুটি কয়েক বড় বড় প্রতিষ্ঠান আর কিছু অঞ্চলের মধ্যে। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি ব্যাংকগুলোর বড় দুর্বলতা। একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যখন খেলাপি হয়, তখন সে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণ প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করে।
সাধারণত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ গ্রহীতারা যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করে। তাদের এই ঋণ পরিশোধের হার প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি। তাদের মধ্যে খেলাপি কম হয়। তবে ইদানিং বড় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধের গাফলতি করার ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ফলে ভালো ঋণ গ্রহীতারাও ঋণ পরিশোধে অনিহা প্রকাশ করছে। এটা ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত। বিনিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম, কানুন না মানলে, কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপে ঋণ দিলে কিংবা যে খাতের জন্য ঋণ অনুমোদন করা হয় সে খাতে অর্থ না খাটিয়ে ফান্ড ডাইভার্ট করলে এবং ঋণ দেওয়ার পর সঠিকভাবে তদারিক না করলে, জামানতে দুর্বলতা থাকলে সে বিনিয়োগ-ঋণ যে কোনো সময়ে ব্যাংকের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে, খেলাপি হয়। সম্পদের গুণগতমান হ্রাস পায়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা আরোপের কারণে ঋণ খেলাপি হলেও খেলাপি দেখানো যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত সেপ্টেম্বর ২০২০ ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ছিল ১০ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। যদিও জুন ২০২০ এ খেলাপি ছিল ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ দেশে ব্যাংকখাতে মোট ঋণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৮ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭.৬৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৪২ হাজার ২৯২ কোটি টাকা রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ৪০ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা ছিল। বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৩৮ কোটি ও বিদেশি ব্যাংকের ছিল ৪ হাজার ৬১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, জুন ২০২১ শেষে ৯৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ। হিসাব মতে খেলাপি ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ মন্দ ঋণ। মন্দ ঋণের কারণে ব্যাংক আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যে পরিমাণ মুনাফা করেছিল তার উপর প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, জুন-২১ পর্যন্ত ১১টি ব্যাংক তাদের আয় থেকে প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ করতে পারেনি। ফলে প্রভিশনের ঘাটতি প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শিথিলতা আরোপ করে। ফলে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ঋণখেলাপি দেখানো যাবে না এ মর্মে সময়সীমা বর্ধিত করা হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এ শিথিলতা বর্ধিত করে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত। আবারও ব্যবসায়ীদের দাবি বিবেচনা করে ৩১ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এর পর আবারও ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পরবর্তীতে আরও ৪ মাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত শিথিল করা হয় ন্যূনতম ২৫ শতাংশ ঋণের কিস্তি পরিশোধের সুযোগ দিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকিং খাতে এ পরিস্থিতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে ভালো গ্রাহকও ঋণ পরিশোধে গাফলতি করছে। ব্যাংকের ঋণ আদায়ের গতি অনেক কমে যাচ্ছে। এটা এ খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত। দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে রাখা ব্যাংক কাঠামোকে দুর্বল করে। খেলাপি ঋণের বিস্তার বেড়ে গেলে মূলধনের উপর প্রভাব পড়ে। ব্যাংকগুলো প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় যে ১ লাখ কোটি টাকা টাকার ঋণ বিতরণ করেছে তারও বড় একটি অংশ আদায় হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত তিনমাসে (এপ্রিল-জুন ২০২১) প্রায় ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বিপরীতে আদায়ের হার মাত্র ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এদিকে করোনার কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধের নীতিমালা সময়সীমা বাড়ার কারণে আগামী ডিসেম্বর-২১ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপি হওয়া থেকে মুক্ত থাকতে পারবে ঋণ গ্রহীতারা। টানা ২ বছর ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করার সুযোগ পেলেন ব্যবসায়ীরা। ঋণ আদায়ের শিথিলতার কারণে ঋণ খেলাপি হলেও তা দেখানো যাচ্ছে না। এতে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমানো হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের কৃত্রিম মুনাফা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋণ নিয়মিত থাকলে ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে নিতে বাধা থাকে না। এভাবে ঋণ আদায় না করেও ঋণের উপর অর্জিত সুদ আয় খাতে নেয়া হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে কৃত্রিম মুনাফা। কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে কৃত্রিম মুনাফা নেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকের মূলধন কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ছে। খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি প্রবণতা শুধুমাত্র ব্যাংক খাতের নয় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরি করেছে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপির প্রভাব পড়ছে ঋণ ব্যাবস্থাপনায়ও।
আমাদের অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যতই বৃদ্ধি পাক মানুষের যদি জীবনমান উন্নয়ন না হয় তবে কোনও লাভ নেই। সামষ্টিক অর্থনীতির সুফল যদি ব্যক্তি পর্যায়ে না পৌঁছে তাহলে উন্নয়ন কোনও কাজে আসবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিটিআরসি, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বেপজা, বিডা, প্রশাসন ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্পদ ও আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে না পৌঁছলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা সুফল ভোগ করবে, সমাজে বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বড় ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে। কর্পোরেট বিনিয়োগ কমিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগে জোর দেওয়া উচিত। তাতে ঋণ আদায়ে গতি আসতে পারে। অর্থ ঋণ আদালতকে ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। পাশাপাশি কৃষি ও কৃষিজাতপণ্য উৎপাদনে ও স্বাস্থ্য ও সেবামূলক খাতে বেশি বিনিয়োগ প্রদানে অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোর দেয়া উচিত।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন