সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

উপকূল রক্ষা এবং নদীভাঙন রোধে মেগা প্রকল্প নিতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০২১, ১২:০৮ এএম

সম্প্রতি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশে আঘাত না করে পাশ কাটিয়ে গেছে। তবে এর প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল জোয়ারে উপকূলের ব্যাপক এলাকা তলিয়ে গেছে। বাঁধ ভেঙ্গে বসত-বাড়ি, ফসলি জমি, মাছের ঘের ভেসে যওয়ায় কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ইয়াসের জোয়ারের পানিতেই যে ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি হয়েছে, যদি আঘাত হানত, তাহলে কি পরিস্থিতি হতো তা কল্পনাও করা যায় না। সাধারণত ঝড়ের আঘাতের পর সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়। তবে এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। উপকূলবাসী এখন আর ত্রাণ চায় না। তারা চায়, ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা পেতে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার। কোমর সমান পানিতে নেমে সেখানের লোকজন বুকে ‘ত্রাণ চাই না, বাঁধের সংস্কার চাই’ লিখে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর অর্থ হচ্ছে, উপকূলের বাঁধগুলো যদি জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় সক্ষম হয়, তবে সেখানের বাড়ি-ঘর, জমি-জিরাত, মাছের ঘের ও সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। সম্পদ রক্ষা হলে তাদের ত্রাণের প্রয়োজন নেই। তাদের দাবী, শুধু বাঁধগুলো সংস্কার করে যুগোপযোগী ও টেকসই করে দেয়া হোক। এ কাজ না করায় তারা বিক্ষুদ্ধ। ইয়াসের প্রভাবে খুলনার কয়রা-পাইকগাছার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হলে স্থানীয় সংসদ সদস্য ট্রলারে করে তা দেখতে যান। সেখানে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকার মানুষ বাঁধ নির্মাণ করছিল। সংসদ সদস্যকে দেখেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে তার দিকে বৃষ্টির মতো কাঁদা ছোঁড়া শুরু করে। বাধ্য হয়ে সংসদ সদস্য সেখান থেকে কিছু সময়ের জন্য চলে যান। স্থানীয় মানুষের এই ক্ষুদ্ধতার কারণ থেকে বোঝা যায়, সেখানের বাঁধ সংস্কার ও নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ষাটের দশকে নির্মিত এসব বাঁধ এখন জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলায় সক্ষম নয়। তৈরি করার সময় এসব বাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু এবং ১৪ ফুট প্রশস্ত। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় অর্ধেকেরও বেশি বাঁধ হারিয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় এখন আর জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে পারছে না।
দুই.
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার অর্থ হচ্ছে, ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ। অতীতে উন্নত বিশ্ব থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণসামগ্রী ও সহায়তা আসত। এখন এ অবস্থা নেই। ঝড়-ঝঞ্ঝার পূর্বাভাস অনুযায়ী, উপকূলবর্তী এলাকা থেকে মানুষকে আগেভাগে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। ঝড়ে ফসল ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হলেও প্রাণহানির সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণসহায়তা বাংলাদেশ নিজেই দিতে পারছে। এটা বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন। তবে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ভূখন্ডে যে আঘাত হানে, তাতে সমগ্র উপকূল এবং বঙ্গোপসাগরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চর ও দ্বীপাঞ্চলগুলো ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ঝড় পরবর্তী সময়ে যথাযথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় এগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হতে শুরু করেছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এক্ষেত্রে যথেষ্ট উদাসীনতা রয়েছে। এ উদাসীনতার অন্তরালে একটা আত্মতৃপ্তিও যেন তাদের মধ্যে কাজ করে। তাদের আচরণে মনে হয়, ঝড়ের কবল থেকে মানুষের জীবন বাঁচানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারলেই হলো, ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি-জমি রক্ষার প্রয়োজন নেই। তারা উপলব্ধি করছে না, বেঁচে যাওয়া মানুষের পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি রক্ষা করা খুবই প্রয়োজন। তা নাহলে, এসব মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। কাজের সন্ধানে শহরমুখী হবে এবং বেকার হয়ে পড়বে। দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এসব বিষয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় খুব একটা আমলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। শুধু উপকূলীয় অঞ্চলেই নয়, বর্ষা পুরোপুরি শুরু না হতেই দেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেরায় নদীভাঙন যে তীব্র আকার ধারণ করেছে, তাতে শত শত বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, হাসপাতাল নিমিষে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পুরোপুরি বর্ষা শুরু হলে কি অবস্থা দাঁড়াবে তা কল্পনাও করা যায় না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর দেশের ১৩টি জেলার ২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে পড়তে পারে। গত বছর সিইজিআইএস আশঙ্কা করেছিল, ১৩টি জেলায় ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের মুখে পড়বে। বাস্তবে দেখা গেছে, ভেঙেছে ৩৮ বর্গকিলোমিটার। এতে ভাঙন কবলিত জেলার মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত চার দশকে প্রায় এক লাখ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ এক ভয়াবহ চিত্র। নদীভাঙনের ক্ষয়-ক্ষতি কি পরিমাণ আজ পর্যন্ত তা নিরুপণ করা হয়নি। শুধু জানা যায়, সকালে যে পরিবার সমৃদ্ধ ছিল, নদীভাঙনে সব হারিয়ে বিকেলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। সহায়সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বাঁধ কিংবা অন্যের জায়গায়। অথচ নদীভাঙন ঠেকানো অসম্ভব কোনো কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ। এই উদ্যোগ প্রতিষ্ঠানটির নেই। বরং অভিযোগ রয়েছে, বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার, নদী শাসনের ক্ষেত্রে সরকার বছরে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও তার সিংহভাগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও ঠিকাদার লুটপাট করে নিচ্ছে। বাঁধ ও প্রকল্পগুলো হয়ে পড়েছে তাদের স্থায়ী ব্যবসার উৎস। দেখা যাচ্ছে, বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে একদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতি ও অকার্যকর ব্যবস্থা, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরভাগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ হবে এবং এ থেকে উত্তরণ কত কঠিন হবে, তার আলামত এখন পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়ে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে। সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে এবং বিশাল এলাকার জমি উর্বরতা হারাবে। সারাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে, কৃষিখাতে বিপর্যয়, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিজড়, জলোচ্ছ্বাস অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্রাফট বিশ্বের ১৭০টি দেশের উপর জরিপ চালিয়ে যেসব দেশকে সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঝড়-ঝঞ্ঝার দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তন নতুন এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনজনিত কারণে ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গোপসাগরীয় তটরেখার কিনারজুড়ে প্রতিনিয়ত পানি ফুলে-ফেঁপে স্ফীত হচ্ছে। এর ফলে দেশের ১৯টি জেলা তথা মোট আয়তনের শতকরা ৩২ ভাগ এলাকা ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। এ এলাকার ৪ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়ত ভূমির পরিবর্তন ঘটছে। উপকূল, চর, দ্বীপাঞ্চলের ভূমি তলিয়ে বা হারিয়ে যাচ্ছে। বাস্তুভিটা হারিয়ে উপকূলের মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। কাজের সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া সামাজিক ভারসাম্য ও শৃঙ্খলার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

তিন.
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতই দিন যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের তুলনায় বেশিমাত্রায় ঝড়-জলোচ্ছ¡াস আঘাত হানছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এসব অঞ্চলের অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাগর অশান্ত হয়ে উঠছে। সাগরে অবস্থিত বিভিন্ন চর ও দ্বীপাঞ্চলে ভাঙ্গনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সাগরের করালগ্রাসে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ার ২৫০ বর্গ কিলোমিটার, ভোলা জেলার ২২৭ বর্গ কিলোমিটর এবং চট্টগ্রামের স›দ্বীপের ১৮০ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা শহররক্ষা বাঁধে ফাটল, পতেঙ্গা থেকে শুরু করে কক্সবাজার, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। এ অঞ্চলের জীববৈচিত্রে দেখা দিয়েছে অস্বাভাবিকতা। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে লম্বালম্বি আকৃতির গুপ্তখালের সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে চোরাবালির ঘূর্ণিফাঁদ সৃষ্টি হয়েছে। ঘূর্ণিফাঁদে পড়ে ইতোমধ্যে অনেকেরই প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া ভূমিধস ও ফাটল অব্যাহত রয়েছে। জলবায়ু ও ভূবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ২১০০ সাল নাগদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮.৩ শতাংশ সাগরে তলিয়ে যাবে। সেন্টমার্টিনসহ প্রায় অর্ধশত দ্বীপ ও চরাঞ্চলসহ দেশের উপকূলভাগ ও বাসিন্দারা অস্তিত্ব ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এর প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া এখনই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সেখানে আবাদি জমির পরিমান ও গড় উৎপাদন কমছে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে প্রত্যন্ত উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলের কমপক্ষে ২ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিবছর দেশে ২০ লাখ মানুষের জীবিকা ধ্বংস এবং আড়াই থেকে তিন লাখ লোক বাস্তুহারা হচ্ছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ুর এই বিরূপ পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন বিচলন বা সচেতনতা যে নেই, তা উল্লেখিত প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার পদক্ষেপ না নেয়া থেকেই বোঝা যায়। জলবায়ু ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ ও করণীয় সম্পর্কে বলে গেলেও সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কোন উদ্যোগী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যতক্ষণ না পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বাইরে যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত টনক নড়বে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের ধ্বংসযজ্ঞের পর কিভাবে প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় থেকে মানুষের জানমাল রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কমিটি গঠিত হয়েছিল। এ কমিটির প্রধান ছিলেন তৎকালীন সচিব এম মোকাম্মেল। এটি মোকাম্মেল কমিটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এ কমিটি দুর্যোগ প্রবণ সমুদ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল সুরক্ষায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ করেছিল। এতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন সাইক্লোন সেন্টার স্থাপন, সহজ ও বোধগম্য আবহাওয়া সতর্ক সংকেত প্রচলন, দুর্যোগ সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, উপকূলভাগে এনজিও কার্যক্রমে সুষ্ঠু সমন্বয়, দুর্যোগকালীন খাদ্যশস্য ও গবাদিপশু রক্ষার ব্যবস্থা সম্পর্কিত খাতওয়ারি সমস্যা চিহ্নিত করে টেকসই উন্নয়নের দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, তিন দশকেও এই দিক নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে তার বাস্তবায়ন হবে কিনা, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। এই সুপারিশমালা যদি বাস্তবায়ন হতো, তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেভাবে সমগ্র উপকূল গ্রাস করে চলেছে, তা অনেকটাই সমাল দেয়া যেত। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা অনেকাংশে সম্ভব হতো। সরকার অহরহ দেশের উন্নয়নের কথা বলে চলেছে। বিভিন্ন সূচকের উলম্ফ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। উন্নতির নিদর্শন দেখাতে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, কর্ণফুলি টানেল ইত্যাদি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দ্রুতগতিতে এসব প্রকল্প সমাপ্ত করে দেখাতে চাচ্ছে, বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হচ্ছে। দেশের সমগ্র উপকূল এবং নদীভাঙনে কবলিত এলাকার কোটি কোটি বাসিন্দাকে অরক্ষিত, ভঙ্গুর ও নাজুক অবস্থায় রেখে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন কতটা কাজে লাগবে, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করার জন্য যে পদ্মাসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই অঞ্চলই যদি বিপন্ন ও অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়, তখন তা কি অর্থহীন হয়ে পড়বে না? এই সেতু দিয়ে যখন কোটি কোটি জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষ রাজধানীমুখী হবে, তখন সরকার এসব মানুষের সংস্থান কিভাবে করবে? পদ্মাসেতুসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্প করতে কারো দ্বিমত নেই। তবে দেশের উপকূলভাগ অরক্ষিত থেকে গেলে, নদীভাঙনে জমিজমা, বাড়ি-ঘর স্থাপনা হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেলে এসব মেগা প্রকল্প প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। সরকারের উচিৎ উপকূলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার বৃহৎ মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করা। অন্তত বাঁধগুলো আধুনিক ও টেকসই করে গড়ে তোলা উচিৎ।

চার.
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সমগ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চল যেভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে, এখন থেকে তার কার্যকর উদ্যোগ না নিলে যে ক্ষতি হবে, তা কোনভাবেই পোষাণো যাবে না। যত বিলম্ব হবে ততই বিস্তীর্ণ উপকূল ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করে যেকোনো উপায়ে তা রক্ষা করতে হবে। দেশি-বিদেশি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে উপকূলভাগ রক্ষা প্রকল্প নামে আলাদা প্রকল্প গঠন করে মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ নিতে হবে। পদ্মাসেতুর মতো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এর কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সরকারের এমন অনেক অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোতে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্প বন্ধ করে সেসব অর্থের সমন্বয়ে সমগ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চল রক্ষা প্রকল্প গড়ে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বজলবায়ু তহবিল থেকে যে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়, তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। এ অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে হবে। দুর্যোগ প্রবণ উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল সুরক্ষায় কার্যকর অবকাঠামো সুবিধা গড়ে তুলতে হবে। উপকূলে ও নদীভাঙনপ্রবণ এলাকায় বসবাসরত কোটি কোটি জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করে প্রতিরোধক ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে বছরব্যাপী বিভিন্ন প্রচারণামূলক কার্যক্রম শুরু করতে হবে। ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ভূমিক্ষয় ঠেকাতে উপকূল, দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি গ্রহণ এবং প্যারাবন বা সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন