সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও শিশুদের ক্যানসার রোগের প্রকোপ বাড়ছে দিনে দিনে। শিশুদেরও ক্যানসার হতে পারে, এই ধারণাটাই অনেক অভিভাবকের জন্য নির্মম সত্য হিসেবে প্রকাশ পায়। জনসচেতনতার অংশ হিসেবে প্রথমেই জেনে নেয়ে যাক, শিশুদের জন্য কোন ক্যানসারগুলো বেশি দেখা যায়।
জন্ম থেকে প্রথম পাঁচ বছরঃ নিউরোব্লাস্টোমা, উইল্মস টিউমার, রেটিনেব্লাস্টোমা, লিউকেমিয়া, নন-হজকিন্স লিম্ফোমা, গ্লায়োমা এবং অন্যান্য মস্তিষ্কর টিউমার।
পাঁচ থেকে দশ বছরঃ লিউকেমিয়া, নন-হজকিন্স লিম্ফোমা, গ্লায়োমা, সারকোমা (হাড়, মাংসের), জনন কোষের ক্যানসার।
দশ বছরের ঊর্ধ্বেঃ লিউকেমিয়া, নন-হজকিন্স লিম্ফোমা, হজকিন্স ডিজিজ, অষ্টিওসারকোমা, ইউইং সারকোমা, অন্যান্য টিসু সারকোমা, জনন কোষের ক্যানসার।
এখন কয়েকটি অধিক গুত্বপরুর্ণ ক্যানসারের লক্ষণ আলোচনা করা যাক। এখানে বলে রাখা ভালো, খুব জটিল আলচনায় না গিয়ে সাধারণের বোধগম্য করে উল্লেখযোগ্য লক্ষণসমূহ পরিচিত করাই লেখার মূল উদ্দেশ্য।
১। নিউরব্লাস্টোমাঃ নিউরব্লাস্ট হচ্ছে স্নায়ুতন্ত্রের আদিকোষ, যা থেকে পরিণত কোষ বা টিসু তৈরি হয়। শরীরে এর প্রাথমিক অবস্থান অনুযায়ী এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রায়ই এটি মেরুদন্ড, শিরা, খাদ্যনালীতে চাপ দেয়। ফলে চাকা, ব্যথা, অবশতা, রক্তচাপের তারতম্য, কোষ্ঠকাঠিন্য, চলাফেরা, দৃষ্টিতে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া জ্বর, মাথব্যথা, ঠিকমতো বেড়ে না ওঠা, হাড়ে ব্যথা, চামড়ার নিচে গুঁটি, চোখের চারদিকে নীলচে হয়ে যেতে পারে।
২। উইল্মস টিউমারঃ এটি কিডনির একধরণের টিউমার। অনেক সময় পিঠের নিচের দিকে (সাধারণত যেকোনো একদিকে) নিরীহ চাকা হিসেবে এটি প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে ব্যথা, পেশাবে রক্ত যাওয়া, উচ্চরক্তচাপ, জ্বর, রক্তশূন্যতা হতে পারে।
৩। রেটিনেব্লাস্টোমাঃ এটি চোখের রেটিনার ক্যানসার। অনেকসময় শিশুর চোখের মাঝখানে তাকালে বা ফ্ল্যাশ আলোতে ছবি তুললে সাদা বিন্দু দেখা যেতে পারে। এছাড়া ট্যারা হওয়া, দেখতে সমস্যা হওয়া, চোখ বের হয়ে আসা, চোখে সঙ্ক্রমণ হতে পারে। চোখের রক্তচাপ বেড়ে (গ্লুকোমা) তীব্র ব্যথাও হতে পারে।
৪। লিউকেমিয়াঃ এটি খুব প্রচলিত ‘রক্তের ক্যানসার’। বেশ কয়েকটি ধরণের মধ্যে একিউট লিউকেমিক লিউকেমিয়া (এ এল এল) বাচ্চাদের খুব বেশি হতে দেখা যায়। জ্বর, শুকিয়ে যাওয়া, রক্তাল্পতা হতে থাকা, শরীরে বা হাড়ে ব্যথা, চামড়ায় ছোট দানা বা ছোপ নিয়ে রোগী আসতে পারে। অনেকেরই লসিকা গ্রন্থি (গলায়, বগলে, কুঁচকিতে গুঁটি), যকৃত আর প্লীহা বড় হয়ে যেতে দেখা যায়।
৫। লিম্ফোমাঃ আমাদের শরীরে অনেক লসিকা গ্রন্থি বা লিম্ফ নোড থাকে যাদের অন্যতম প্রধান কাজ রক্ত পরিস্কার রাখা। এদের অবস্থান গলায়, ঘাড়ে, বুকের ভিতরে, পেটে, বগলে, কুঁচকিতে থাকে। এদের ক্যানসারকে লিম্ফোমা বলা হয়। কম বয়সের বাচ্চাদের নন-হজকিন্স লিম্ফোমা আর একটু বেশি বয়সে হজকিন্স ডিজিজ হতে পারে। জ্বর (রাতের দিকে, সাথে প্রচন্ড ঘাম দিয়ে ছাড়া), শুকিয়ে যাওয়া, রক্তাল্পতা হওয়া আর লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এই রোগের প্রধান লক্ষণ। যকৃত আর প্লীহাও বড় হতে পারে।
৬। অষ্টিওসারকোমা, ইউইং সারকোমাঃ এই দুইটি হাড়ের ক্যানসারের নাম। হাড়ে বা গিরায় ব্যথা, খোঁড়ানো, ফুলে যাওয়া নিয়ে এটি প্রকাশ পায়। অনেকেরই খেলতে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার ইতিহাস থাকে। এক্সরে দেখে এই দুই ক্যানসার আলাদা করা যায়।
৭। মস্তিষ্কের টিউমারঃ মস্তিষ্কের কোন অংশে প্রাথমিক টিউমার সে অনুযায়ী লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকেরই দীর্ঘদিনের মাথাব্যথা, বমি, হাঁটতে গেলে ভারসাম্য রাখতে না পারা, দেখতে সমস্যা হওয়া, মুখের অঙ্গভঙ্গি বা চিবুতে সমস্যা হওয়া, জ্বর, ওজন কমতে থাকা এসব দেখা যায়। ক্ষেত্র বিশেষে খিঁচুনি, অজ্ঞান হওয়া, স্ট্রোকও হতে পারে।
এসব ক্যানসার ছাড়াও আরও বেশকিছু ক্যানসার শিশুদের হতে দেখা যায়। এর চিকিৎসা শুরু করতে কয়েকটি সমস্যা দেখা যায়। রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব হওয়া, অভিভাবকের শিশুদের ক্যানসার নিয়ে ভুল ধারণা আর প্রচলিত কুসংস্কার জটিলতা আর মৃত্যুহার বাড়িয়ে দেয়। আশা করি দীর্ঘমেয়াদি জনসচেতনতা শিশুদের ক্যানসার প্রতিরোধ, নির্ণয় এবং চিকিৎসায় অবদান রাখবে।
ডা. আহাদ আদনান
শিশু মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, মাতুয়াইল, ঢাকা।
মোবাইল: ০১৯১২২৪২১৬৮।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন