বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ঈদুল আজহা সংখ্যা

নজরুল কাব্যে কোরবানির মহিমা

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০২১, ১২:০৮ এএম

মানুষের বিচিত্র জিজ্ঞাসার মধ্যে হযরত ইবরাাহিম (আ.) প্রথম পুরুষ, যিনি অস্তিত্বের সত্যকে আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁরই হাত ধরে যুক্তির সাহায্যে ইসলামী বিশ্বাস বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁরই হাত ধরে বিশ্ব নর-নারীর মধ্যে সত্যের যথার্থ উন্মেষ ঘটেছে। হযরত ইবরাহিমের আগেও যে সত্যের অনুসন্ধান ছিল না, তা নয়। অবশ্যই ছিল। তবে তাঁর সময়কার সত্যতা আবিষ্কার যথার্থই ছিল অভিন্ন। কেননা, সে-সময়ে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে জিজ্ঞাসা ছিল সর্বত্র। আর এর মধ্যে মহাচ্যালেঞ্জস্বরূপ ত্যাগের যে সত্যতা ‘কোরবানি’ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা যুগ যুগ ধরে অব্যাহত আছে বিশ্ব মুসলমানদের দুয়ারে ঈদ-উল-আযহার দিনে।
কোরবানি আল্লাহর বড়ই পছন্দ। হাদিসে আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে কোরবানি দেয়া হয়, সে কোরবানি জন্তুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা মহান আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। তার প্রতিদান সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ মঞ্জুর করে দেন। প্রকৃত-ই ত্যাগের মহিমা অপার। যে মহিমার বর্ণনা দিতে বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর বিদ্রোহী সুরে বলেছিলেন:

‘যে আপন পুত্রে আল্লারে দেয়
শহীদ হওয়ার তরে
কা’বাতে সে যায় নারে ভাই
নিজেই কাবা গড়ে।’

প্রকৃত-ই নজরুলের এ ভাষ্য জানান দেয়, প্রকৃত কোরবানি কী। নজরুল অবশ্যই তার কাব্যিক এ রচনাকে ধার করেছেন মহান সৃষ্টিকর্তার বাণী থেকে। পবিত্র কুরআন বারবার বলেছে যে, ‘এ পৃথিবীতে তোমার জীবন লাভের কারণে তুমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হও এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে উৎসর্গ কর।’ এ উৎসর্গের মাধ্যমেই মানুষ সফলকাম হয়। কিন্তু মানুষের উৎসর্গ করার কী আছে? প্রত্যেক মানুষেরই তো একটি মাত্র প্রাণ, যার দানকর্তাও আল্লাহ। তাই যে জীবন কিংবা প্রাণ মানুষ পেয়েছে তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। এ কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে বিশ্বাসী মুসলমানরা পেয়েছে ইবরাহিমের ‘কোরবানি’ প্রদান। পবিত্র কুরআনে ‘কোরবানি’ প্রসঙ্গে অন্য এক ভাষ্যে বলা হয়েছে, কোরবানির পশুর মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছয় না। এর মধ্যে যে উদ্দেশ্য কিংবা ত্যাগ রয়েছে সেটাই শুধু আল্লাহর দরবারে পৌঁছায়। কবি নজরুল অতি সুন্দরভাবে এ ত্যাগের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন-

‘আজ শোর ওঠে জোর
খুন দে জান শির, বৎস শোন।
ওরে হত্যা নয় সত্যাগ্রহ
শক্তির উদ্বোধন।
দুধারি ধার শেরে খোদায়
রক্তে-পুত-বদন
খুনে আজ রুদবো মন
ওরে শক্তি হস্তে মুক্তি
শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন।’

হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছিলেন ‘কোরবানি’ করো তোমার প্রিয়তম বস্তুকে। এ নিয়ে অনেক অনুসন্ধানের পর ১০ জিলহজ্ব পুত্র হযরত ইসমাইলকে কোরবানি দিয়েছিলেন ইবরাহিম (আ.)। তার ধারাবাহিকতায় আজকের এ ত্যাগের উৎসব। কিন্তু এখনকার ত্যাগ! অনেকটাই লোকদেখানো মায়াকান্না! অনেকক্ষেত্রে অর্থবল, বাহুবল গ্রাস করে নিয়েছে মানুষের খাঁটি মনকে। ফলে ত্যাগ-তিতিক্ষা সাধারণের কাছে এক মহাকঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানব সভ্যতার এ অগ্রগতির দিনে প্রকৃতই ঈদ-উল-আযহার শাশ্বত বাণী অতি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিকতার এ আলোচনাক্রমে কাজী নজরুলের কাব্যিক রচনায় আরো একবার দৃষ্টি দেয়া যাক। নজরুল তাঁর তথাকথিত মায়াকান্নাধারীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন:

‘ওরে ফাঁকিবাজ ফেরেববাজ
আপনারে আজ দিসনে লাজ
গরু ঘুষ দিয়ে চাস সওয়ার?
যদিইরে তুই গরুর সাথ
পার হয়ে যাস পুলসিরাত
কি মহাম্মদে জওয়াব?’
নজরুল তাঁর আরেক রচনায় মানুষের স্বভাবসুলভ আচরণকে শ্লেষ দিয়ে লিখেছেন-
‘নামাজ রোজার শুধু ভড়ং
ইয়া উয়া পরে সেজেসে সং
ত্যাগ নেই তোর এক জড়
ত্যাগের নামেতে জড়সড়
তোর-নামাজের কি আছে দাম?’

প্রকৃতই যাদের ত্যাগ নেই, মুখোশের আড়ালে থাকায় স্বভাবটা আয়ত্ব করে নিয়েছেন তাদের কাছে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক বার্তা দুই-ই নিরর্থক। তাই প্রার্থনা করি অন্তত ঈদ-উল-আযহার দিনে এর যথার্থ উন্মেষ হোক। অবশ্যই এমনও উন্মেষ প্রতিবার ঘটছে বলে মানুষ মানুষের জন্য কাঁদতে পারে, রক্ত দেখলে আঁতকে উঠে, দুর্যোগ মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, অনাহারী বুভুক্ষদের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করে, কোলে তুলে নেয় এবং সর্বোপরি অনাথ, নিরাশ্রয়ীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন