শেষ পর্যন্ত বারো নম্বর কেবিনটাও পেরিয়ে এলো বাদল। এসে দাঁড়ালো বারান্দার শেষ প্রান্তে। ক্লান্ত বিকেলের নরম রোদ এসে পড়েছে বারন্দার রেলিং এ শ্রান্ত সূর্যটা মাঠের শেষ গ্রামের মাথায় ঢল ঢল করছে একথাল কাঁচা সোনার মতো। রংটা যেন একটু বেশী লালচে।
লাল রংকে বড় ভয় বাদলের।
ভয়-রক্তের সাথে এর মিল রয়েছে বলে। অথচ আগে.....?
লাল পুই-এর বীচি হাতে কি অদ্ভূত আনন্দ না পেতো বাদল। কিন্তু আজকাল লালকে সে এড়িয়ে যেতে চায়।
বারো নম্বরের দরজায় ভারী পর্দা ঝুলছে। একটু সরে গেছে পর্দাটা। সামান্য উঁকি দিলেই ভেতরটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু না দেখেও বলতে পারে বাদল। বলতে পারে, ভেতরে দাঁড়িয়ে ডাক্তার-নার্সদের সাথে হেসে হেসে কথা কইছেন তমাল চৌধুরী।
দরজার বাইরে ডাক্তার ও সীস্টারদের খুশীর ভীড়।
বিদায়ের আগে ওদেরকে মোটা বখশিস দিয়েছেন ১২ নম্বরের তমাল চৌধুরী। প্রাণ ভরে দোয়া করছে ওরা।
কেবিন থেকে বেরিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে আসছেন সবাই। তমাল চৌধুরীও।
মুখ ঘুরিয়ে নিল বাদল। তাকিয়ে রইলো টেলিগ্রামের তারের ওপর দোল খাওয়া ফিঙ্গেটার দিকে। দু’চোখ ঝাপসা।
হঠাৎ প্রচন্ড কাশির বেগ সামলাতে গিয়ে রেলিং এ ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়লো বাদল। পাঁজরের হাড়গুলো বেজে উঠলো ঝন ঝন করে।
অনেকগুলো পদশব্দ বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।
আর সে মুহূর্তে হাত কামড়ে নিজেকে সামলাতে চাইলো বাদল।
একটা মেইলট্রেন চলে গেল হুস হুস করে। বাদলের ইচ্ছে হলো ওই ট্রেনের শব্দের সাথে মিলিয়ে একবার চিৎকার করে কাঁদে। কিন্তু পারলো না। কান্নাটা যেন প্রতিজ্ঞা করে কণ্ঠদ্বারে এসে থেমে গেল। ওর মনে হলো, একটা কিছু বুকের মধ্যে আটকে আছে। চলে গেলেন তমাল ভাইয়া, বাদলের খোঁজ না করে। যে তমাল ভাইয়া একদিন ক্রন্দনরত বাদলের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিলেন-
: ভয় কি ? আমি তো আছি।
সেই তমাল ভাইয়া চলে যাবার সময় একটিবারও ডেকে বললো না। বাদল-যাচ্ছি। একটি বারও মনে পড়লো না-এই অসহায় ছেলেটির কথা ? তমাল ভাইয়ার সুন্দর মনটা কি এতোই নিষ্ঠুর ? ভাবতে ইচ্ছে করে না বাদলের।
ভাবতে ইচ্ছে করে না যে নীচে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তমাল ভাইয়ার বাড়ির মানুষরা নিতে এসেছেন ওকে। এই মৃত্যুপুরী থেকে রক্ষা করতে এসেছেন তাদের বাড়ির ছেলেটিকে।
সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে গাছ পালার আড়ালে। সামনের দিকটা অস্পষ্ট। অনেক দূরে ইঞ্জিনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ট্রেন আসছে হয়তো। শুকনো চোখে সেদিকে চেয়ে রইলো বাদল। চুলগুলো এলোমেলো ! বুকের বোতাম খোলা।
বর্তমানকে ভোলার জন্যই কিছু একটা ভাবতে চাইলো বাদল। এবং হারিয়ে যেতে চাইলো সে ভাবনার সাগরে। বার বার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। কিরে তুই এখানে আর আমি খুঁজে খুঁজে হয়রান। চমকে উঠলো বাদল। তাকে খুঁজতেই আবার ওপরে উঠে এসেছেন তমাল ভাইয়া।
বাদলের কথা তাহলে তিনি ভোলেন নি ?
ওর ইচ্ছে হলো তমাল ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে একবার আকুল হয়ে কাঁদে। কিন্তু পারলো না। কান্না লুকোবার জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিল বাদল। দেখলেন তমাল ভাইয়া, বুঝলেন।
তার চোখও ভরে এলো তপ্ত জলে।
তবুও হাসবার মতো মুখ করে বাদলের শীর্ণ চিবুক তুলে ধরে বললেন-
: কাঁদছিস কেনরে বোকা ? আর কদিন পরে তুইও সেরে উঠবি। আমি সব সময় তোর খোঁজ খবর নেব। কিচ্ছু ভাবিসনে।
মুখ তুলতে পারলো না বাদল।
দু’হাতে রেলিং ধরে শক্ত হয়ে রইলো।
একবার ওর ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলে, তুমি যেও না ভাইয়া। তুমি চলে গেলে আমি বাঁচব না। কিন্তু বলতে পারলো না। একবার শুধু হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিল।
চোখের কোণ ভেজা !
বুকের ভেতরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে অব্যক্ত যন্ত্রণায়। নীচে বার বার গাড়ির হর্ন বাজছে। ডাকছে সবাই
সময় মত না গেলে ট্রেন ধরতে পারবে না। সে জন্যেই তাড়া।
: বাদল-
বাদলের কাঁধে হাত রেখে মৃদ্যু স্বরে ডাকলেন তমাল ভাইয়া।
কিন্তু সে ডাক বাদলের কানে গেল না।
ওর মনটা তখন পালিয়ে বেড়াতে চাইছে এ যন্ত্রণাময় মুহূর্তের কবল থেকে।
বাদল টের পেল-আরো কতগুলো উপদেশ আর সান্তনার কথা বলে কখন চলে গেছেন তমাল ভাইয়া।
যখন সম্বিৎ ফিরে পেল-তখন গাড়িটা স্যানাটোরিয়ামের গেট পেরিয়ে অনেক খানি এগিয়ে গেছে।
সূর্যটা হারিয়ে গেছে গাছ পালার আড়ালে। দু’একটা প্রহরী তারা জেগেছে আকাশে। নীড়ে ফিরে গেছে তারে দোল খাওয়া ফিঙ্গেটা।
এরপর নিজের বিছানায় এসে পড়লো বাদল। এবং হু হু করে কেঁদে উঠলো ছোট শিশুর মতো।
ওর কান্নার কারণ কারো জানবার কথা নয়। আর সে জন্যেই কেউ জানলো নয়।
পরদিন সকালটা বাদলের কাছে অর্থহীন। ও যেন দু:স্বপ্ন দেখে এই মাত্র ঘুম থেকে জেগে উঠেছে।
রোদটা ঝক ঝকে।
যেন সূর্যটা এইমাত্র সাগরে ডুব দিয়ে এসেছে। জানালার পাশের গাছটার কচি আর উজ্জ্বল পাতায় সমাহার।
একটা রাতের ব্যবধানে-শুধু বাদলের কেন-পুরো স্যানাটোরিয়ামের জীবনের গতিটাই হারিয়ে গেছে।
যেন হঠাৎ করে ফুরিয়ে গেছে-এখানকার মানুষগুলোর জীবনের সব আশা।
অনেকদিন পর আজ আবার জানলার গরাদে মাথা এলিয়ে বসল বাদল।
তারপর দৃষ্টি মেলে দিল দূরের সবুজ গ্রামটার দিকে। সকাল বেলার অলস চোখ দু’টো ভরা দীঘির মতো টলমল করে উঠলো। এখানে-
এই টি, বি স্যানাটোরিয়ামে আসার প্রথম দিনটার কথাই মনে পড়লো বাদলের।
প্রথম দিন ঠিক এমনি করেই জানালার গরাদে হেলান দিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছিল বাদল। কাঁদছিল ওর দুরন্ত কৈশরের ছবিটার মৃত্যু দেখে।
সোহাগতলীর ডানপিটে ছেলেটার অসহায়ত্ব দেখে।
কিন্তু সেই মুহূর্তে ওর পাশে এসে দাঁড়ালেন ১২ নম্বরের তমাল চৌধুরী। বাদলের কাঁদে হাত রেখে বললেন-কাঁদছো কেন ভাই ?
সেদিন কিছু বলবার ছিল না বাদলের।
পৃথিবীর সব বিস্ময়ে আর জিজ্ঞাসা ভরা জল টল টল দু’চোখ মেলে শুধু চেয়েছিল এই অপরিচিত মানুষটির দিকে।
এরপর বাদল নিজেও জানে না-কখন তার কেমন করে এই তমাল ভাইয়ার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে সে।
‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ আর-‘বাদল থেকে বাদলা’ হয়ে কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল বাদল।
হাসতে বাধ্য করেছেন তমাল ভাইয়া। তিনি বলতেন-নতুন নতুন সবারই অমন খারাপ লাগে। কিন্তু শেষে আর অমনটি হয় না। সব ভুলে গেল বাদল।
স্যানাটোরিয়ামের ভেতর খেলাধূলা গান বাজনা এই সব বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করাতেন তমাল ভাইয়া। তিনি বলতেন, আমরা স্যানাটোরিয়ামের বাসিন্দে বলেই হাসি আর আনন্দ টনিকের মতো প্রয়োজন আমাদের জীবনে।
বাদল অবাক।
অবাক তমাল ভাইয়ার কথা কথা শুনে। নির্বাক বিস্ময়ে অভিভূত স্যানাটোরিয়ামের আধমরা মানুষগুলো।
কাঁদতে ভুলে যায় বাদল।
ভুলে যায় সব অসহায়ত্বের কথা।
১২ নম্বরের তমাল চৌধুরী স্যানাটোরিয়ামের প্রাণটাকে যেন জাগিয়ে দিয়েছে।
সবাই বলে-মানুষটা একেবারে অন্যরকম। হয়ত তাই-।
কত অলস দুপুর আর শারদীয় সন্ধ্যায় বারান্দায় ডেক চেয়ারে অথবা সবুজ লনে বসে বাড়ির কথা বলেছেন তমাল চৌধুরী। বাবা-মার কথা, ভাই-বোনদের কথা। তাদের তিন তলা বাড়ির কোন দিকের ঘরটাতে তমাল ভাইয়া থাকতেন, কোন ঘরটা লাইব্রেরী ছিল, কোন রং-এর গাড়িটা তার নিজের ছিল, সব বলতেন বাদলের কাছে।
বলতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিনগুলোর কথা। আর...আর...এখানে এই স্যানাটোরিয়ামে আসবার কথা।
বলতে বলতে কেমন যেন হয়ে যেতেন তমাল ভাইয়া।
অবাক দু’চোখ মেলে কথা শুনতো বাদল। ওর চোখের পাতা ভিজে উঠতো জলে।
তা দেখে চোখ ভিজে উঠতো তমাল ভাইয়েরও।
প্রায়ই কবি গুরুর মরণ থেকে আবৃত্তি করতেন তমাল ভাইয়া। তা শুনে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলতো বাদল।
বলতো-
: তুমি মরবে না ভাইয়া।
: কি করে জানলি ?
চোখ বুঝে বাদল বলেছিল-
: অত সুন্দর আবৃত্তি করতে পারো ! কত বিদ্যে তোমার ! ওর কথা শুনে ক্লান্ত হেসেছেন তমাল ভাইয়া। বলেছেন-
: মৃত্যু আবৃত্তি বোঝে না রে, ডিগ্রী বোঝে না-কি দাম ওর কাছ কাব্যময় জীবনের।
বাদলের কিশোর চোখে তমাল যেন রূপকথার রাজপুত্তুর।
আর.....
আর-সেই রূপকথার রাজপুত্তরই এই স্যানোটোরিয়ামের সব হাসি গান আর জীবনের মানে লুট করে নিয়ে উধাও হয়ে গেল পক্সক্ষীরাজ ঘোড়ায় চলে।
সুযোগ বুঝে বুকের ভেতরকার ক্ষুদে দানবগুলো আবার যেন এগুচ্ছে গুটি গুটি।
ডাক্তার লক্ষ্য করলেন-বাদলের শীররটা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
সবই বোঝে বাদল। কিন্তু বুঝেই বা কি আর হবে।
ডাক্তার বলেন, চিন্তা করলে অসুখটা বাড়বে।
কিন্তু জোর করে চিন্তার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায় ?
বরং শ্রাবনের মেঘের মত স্তরে স্তরে চিন্তার মেঘ এসে ওকে আচ্ছান্ন করে ফেলে।
এর কবল থেকে কি করে মুক্তি পাবে বাদল ?
তমালের দেয়া বই আর ম্যাগাজিন টেবিলে স্তুপিকৃত। একটাও পড়া হয়নি এখনো। ইচ্ছেও করে না আর অসহ্য মনে হয়।
তমালের চিঠি আসে প্রায়।
‘বিশ্রাম নিবি। চিন্তা করে মন খারাপ করবি না। বিকালে বাগানে ঘুরবি। বই পড়বি।’
আরো কত সান্তনার বাণীতে ভরা সে সব চিঠি। অনেক, অনেক বার করে পড়ে বাদল। পড়ে আর কান্নার ঢেউ যেন আছড়ে পড়তে চায়।
কাশির সাথে ছলকে ওঠে টকটকে রক্ত। বুকের কাছটা ভিজে যায়। তবুও চিঠি পড়ে বাদল। পড়ে আর কাঁদে। বুকের শুকিয়ে যাওয়া রক্ত নতুন করে ভিজে উঠে চোখের তপ্ত জলে।
এখানে রাতের স্যানাটোরিয়ামের রূপ সম্পূর্ণ আলাদা। আঁধারের বুকে আশ্চর্য ছবির মতো পাহাড়ের বুকে স্থির হয়ে থাকে বাতি-জ্বালা বিরাট দালানটা।
ট্রেনের রাতের প্যাসেঞ্জাররা মুখ বাড়িয়ে মাঝে মাঝে দেখে। আলো জ্বলে সারা রাত। কিন্তু কেউ জানে না-এই স্যানাটোরিয়ামের একটি ‘বেডে’ শুয়ে নির্জীবের মত বাদল নামের রোগীটি আবৃত্তি করছে; তমাল চৌধুরীর কাছে শোনা একটি লাইন ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান...।”
ডাক্তাররা বোঝেন না-কেন বাদল এমন করে...।
অনেক চেষ্টা করছেন জানতে। আজকাল আর বারান্দায় অথবা জানালার ধারে বসে না বাদল। ঠিক বসে না, নয়-বসতে পারে না। ভারী কষ্ট হয় ওর।
চোখ দুটো বড্ড ক্লান্ত আর অবসন্ন।
আজকাল হালকা মেঘের সারি দেখবার জন্যে জানালা গড়িয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে দেবার ক্ষমতাও যেন বাদলের হয় না।
আজ কদিন ধরে-জানালার পাশের গাছটায় একটা কোকিল ডাকছে।
চোখ বুজে সেই ডাক শুনতে থাকে বাদল। সবাই বলে-কোকিল বসন্তের দূত।
কিন্তু আর কেউ না জানুক-বাদল জানে কত বড় মিথ্যে কাব্য এটা।
কোকিল বসন্তের দূত নয়-মৃত্যুর দূত।
নইলে বাদলের জানালার ধারে কেন সে অমন করে ডাকে ?
কই-আর কারো জানালার ধারে তো সে যায় না !
কোকিলটা তখনো আকুল হয়ে ডাকছে।
অনেক কষ্ঠে চোখ খুললো বাদল।
নতুন পাতার ফাঁকে দেখতে চাইলো সেই মৃত্যুর দূতকে।
গাছের ডালে নয়-ঠিক যেন ক্ষয়ে যাওয়া বুকের মাঝখানটিতে বসে ডাকছে মৃত্যুর দূত।
একটি-ছন্দে একই সুরে শুধুই ডেকে চলেছে। চোখ বুজে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছে বাদল।
এমনি সময়-
কপালে একটি পরিচিত হাতের স্পর্শ। চোখ মেললো বাদল বহু কষ্ঠে।
: ভাইয়া।
বাদলের ক্ষীণ কণ্ঠে বিস্ময়। আশ্চর্য দু’টো চোখে হাসছেন তমাল ভাইয়া। বললেন, এখানকার মায়া কাটতে পারলুম না, তাই আবার ফিরে এলুম। নিঃশব্দ ক্রন্দনে দু’চোখ ভেসে গেল বাদলের। ওর কাঁদবার কথা নয়। তবুও কাঁদলো।
এবার আর ২২ নম্বরে নয়-পঁচিশ নম্বরে আশ্রয় নিলেন তমাল চৌধুরী। আগের মতো হৈ চৈ করে স্যানোটোরিয়ামের প্রাণটাকে মাতিয়ে রাখবার ক্ষমতা যেন নেই তার। নিজের জায়ঘা ছেড়ে খুব একটা বাইরে আসতেও পারেন না তিনি। বড় একটা দেখা হয় না বাদলের সাথে। অনিয়মের চলায় শরীরটা খুব বেশী খারাপ হয়ে পড়েছে।
সেদিন বিকেলে টলতে টলতে বাদলা এলো তমাল ভাইয়ার কেবিনে।
গোধুলী আকাশ তখন রাঙ্গা মেঘে ভরা। বাদল যেন এই মুহূর্তে রাঙগা মেঘের স্মৃতি। আকাশের রং এতো লাল হয় জানতো না বাদল !
মনে পড়লো সোহাগতলীর সুখের দিনগুলোর কথা। শেষ বিকেলে স্কুল থেকে নদীর কোল ঘেঁষে বাড়ি ফেরার পথে কতোবার রাঙ্গা আকাশ দেখেছে বাদল।
কিন্তু এমনটি তো কোনদিনই চোখে পড়েনি ওর।
নাকি আকাশটাই কোনদিন রাঙ্গেনি এমন করে ? কে জানে ?
অনেকদিন আগের হারিয়ে যাওয়া গ্রামটাকে ভাবতে চাইলো বাদল, চাইলো সেই গ্রামের লাবণী আর মাধুরী মাখা মায়ের মুখের ছবিটাকে।
আবার কাশি উঠলো ভীষণ।
না !
মাকে ওর একটুও মনে পড়ে না।
সেই ছেলেবেলার একটা সুখ স্বপ্নের মতন...
না না। কিছুতেই না। কিছুতেই মায়ের মুখটাকে বাদল মনে করতে পারছে না। কিছুতেই না।
বাবা-মা কেমন বাদল জানে না। ভাবতে ইচ্ছে করে অথচ কিছুতেই ভাবতে পারে না।
রাঙ্গা মেঘও মিলিয়ে গেল এক সময়। সূর্যটা তেজ হারিয়ে গ্রামের মাথায় কেমন ঢল ঢল করছে।
নার্স এসে তাড়া দিল-
: তুমি আবার উঠে এসেছো? বারন করেছি না ? চল তোমার বেডে চল। কাশির বেগ সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো বাদল।
হাতের রুমালটা রক্তে ভেজা।
: বাদল।
একটি মাত্র ডাক।
দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো বাদল। তারপর-
হঠাৎ উপুড় হয়ে পড়লো তমালের কোলের কাছে।
ওর পিঠে হাত বুলালেন তমাল ভাইয়া। টেনে টেনে বললেন-
: মৃত্যুর রূপ বড় ভয়ঙ্কর রে। একে জয় করতে হলে কাশির সাথে সাথে থেমে গেল কথা। মুখ তুললো বাদল।
বলল-
: আমি মরলে-তুমি কেঁদো ভাইয়া-
: কেনরে ?
দু’হাতে বুক চেপে ধরলো বাদল। বলল-
তোমার জন্য কাঁদবার অনেক মানুষ আছে, কিন্তু আমার ? কেউ না -বল কাঁদবে...?
এই হতভাগ্য আর নি:স্ব ছেলেচির দিকে জলভরা চোখে চাইলেন তমাল ভাইয়া।
তারপর দীর্ঘশ্বাস চাপতে চাপতে বললেন- কাঁদব-।
কিন্তু দুর্ভাগ্য বাদলের।
একদিন সকালে বাদলকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন তমাল চৌধুরী। অবসন্ন বাদল তখন বিছানায় শুয়ে...।
স্যানাটোরিয়ামের জীবনে এ দৃশ্য নতুন নয়। কিন্তু বাদলের পনেরো বছরের জীবনে এটাই সবচে’ নিষ্ঠুর সত্য।
আকাশে আবার নববর্ষের মেঘের আনাগোনা। বাতাসটা ভেজা।
ডাক্তার নার্সদের মুখ দেখেই বাদল বুঝতে পারে সব। বোঝে ওর দিন ফুরিয়েছে।
রাত প্রায় নটা। এরই মধ্যে শান্ত হয়ে পড়েছে চারদিক। বাদল অনুভব করে প্রাণটা কণ্ঠদ্বারে এসে ধুকছে। আজ এই মুহূর্তে হয়তো তার ডাক আসবে। কিন্তু তার মৃত্যুতে কতটা ক্ষতি হবে পৃথিবীর ?
প্রতিদিন কত বাদলই তো কত জায়গায় এমনি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
কে তার খোঁজ রাখে।
তারায় ভরা আকাশ।
বাদল শুনেছে-মানুষ মরলে নাকি আকাশের তারা হয়। তবে কোন তারাটা ওর...মা?
বিছানা ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠলো বাদল। দাঁড়ালো দেয়াল ধরে। এখানে, এই চার দেয়ালের মধ্যে মরলে জানবেন না ওই আকাশের ‘মা’ তারাটি। মাকে যে বাদলের ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করেছে। শুধু একবার মায়ের মুখটা...।
কিন্তু ভীষণ মনে পড়ছে কেন মাকে। ডাকতে ইচ্ছে করছে সমস্ত শক্তি দিয়ে। ওই যে স্যানাটোরিয়ামের শিশির ভেজা মাঠটা।
ওখান থেকে তারা ভরা আকাশটা স্পষ্ট দেখা যায়। আর কেউ না কাঁদলেও ওই আকাশ পারের মা... তিনি তো কাঁদবেন তার খোকার জন্যে।
তার সব দেহের ওপর দু’ফোটা আশীর্বাদের অশ্রু তো ঝরাবেন ওই আকাশ থেকে।
মা কি জানেন না যে, বাদলের জন্যে কাঁদবার মানুষ তমাল ভাইয়াও আর বেঁচে নেই।
কে জানে এতো দিন তমাল ভাইয়াও আকাশের নতুন কোন তারা হয়ে এই স্যানোটোরিয়ামের দিকে জলভরা চোখে চেয়ে আছেন কিনা !
টলতে টলতে বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালো বাদল। ওকে যেন আজ সর্বনাশা নেশায় পেয়েছে। পা দু’টো ভীষণ টলছে। আরো এক ঝলক তাজা রক্তে ভিজে গেল সিঁড়ির ধাপ।
না:
দাঁড়ালে চলবে না।
আর একটু পরেই বারান্দা পেরিয়ে সবুজ ঘাসের লন।
শেষের দিকে প্রায় ছুটতে ছুটতে লনে এসে পড়লো বাদল। দেহের সর্বশক্তি সঞ্চয় করে আকাশের দিকে মুখ তুললো একবার। ঠিক মাথার ওপরে দপ দপ করে জ্বলছে একটা উজ্জ্বল তারা।
: মা-আমার মা-একটা অস্ফুট শব্দ করে শ্বাস টানতে চাইলো বাদল-কিন্তু পারলো না।
মুখ থুবড়ে গেল সবুজ ঘাসের বুকে।
পরদিন সকালে সবাই দেখলো ঘাসের ওপরে পড়ে আছে স্যানোটোরিয়ামের সব চেয়ে কম বয়সী পেশেন্ট বাদল।
গায়ের জামা কাপড় ভিজে চুপসে আছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন