শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঈদুল আজহা সংখ্যা

অন্যরকম ঈদ

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০২১, ১২:০৮ এএম

করোনা অতিমারি ঈদের চালচিত্র, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি- সব কিছুই ওলট-পালট করে দিয়েছে। করোনাকালে তিনটি ঈদ গত হয়েছে। কোনো ঈদই সুষ্ঠুভাবে, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ-উল্লাস উদযাপিত হয়নি। চতুর্থ ঈদ সামনে। এই ঈদ উদযাপনেও ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশ্বমুসলিম বছরে দুটি ঈদ উদযাপন করে। এর একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা। মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতর। আর মাহে জিলহজে আসে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এবারের ঈদুল আজহা উদযাপিত হতে যাচ্ছে ২১ জুলাই। বহুল আকাঙ্খিত, ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এই ঈদ এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন করোনা অতিমারি ভয়ংকররূপে বিস্তার লাভ করেছে। বিশ্বে অধিকাংশ দেশে চলছে এই মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ। কোনো কোনো দেশে তৃতীয় ঢেউও শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশে চলছে দ্বিতীয় ঢেউ। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ডেল্টা সবচেয়ে ভয়ানক ও দ্রুত সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। এই ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশে আতংকরূপে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে করোনার মৃত্যু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে প্রতিদিন গড়ে দু’শতে উপনীত হয়েছে। আক্রান্ত গড়ে প্রায় ১০ হাজার। আগে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক। এখন শহর ও গ্রামের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। করোনা মোকাবিলায় দীর্ঘ লকডাউন দেয়া হয়েছে। কখনো তা সাময়িকভাবে শিথিল, কখনো কঠোর করা হয়েছে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, গণপরিবহন, ট্রেন-লঞ্চ চালু করা হয়েছে। কোরবানির পশুর হাট থেকে শুরু করে সব ধরনের চলাচল, কাজকর্ম নির্বাধ করা হয়েছে। শর্ত আছে যে, সকল ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে, যদিও স্বাস্থ্যবিধি ব্যাপকভাবে লংঘিত হচ্ছে। এর ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে। তাদের মতে, স্বাস্থ্যবিধি এভাবে অমান্য করা হলে করোনার সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে এবং মৃত্যুর সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে।

সরকার ঈদুল আজহা উদযাপন, জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে লকডাউন শিথিল এবং সব কিছু উন্মুক্ত ও সচল করতে বাধ্য হয়েছে। ঈদে ঘরে ফেরা এবং আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করা আমাদের দেশের অনেক দিনের ঐতিহ্য। দেখা গেছে, লকডাউনের মধ্যেও অনেকে ঘরে ফিরতে উদ্যোগী হয়েছে। গণপরিবহন, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধ থাকলেও যে যেমনভাবে পেরেছে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেছে। এভাবে শহর থেকে গ্রামে এবং ফের গ্রাম থেকে শহরে জনস্থানান্তরে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে, এমন আশংকার তারা তোয়াক্কা করেনি। গত ঈদুল ফিতরে যেমন তেমনি এবারের ঈদুল আজহাও ঘরমুখো মানুষের সুবিধায় গণপরিবহন, ট্রেন, লঞ্চ চালু করতে বাধ্য হতে হয়েছে।

অন্যান্য ধর্মের লোকদের আনন্দ উৎসব এবং মুসলমানদের ঈদের মধ্যে বিলক্ষণ পার্থক্য রয়েছে। তাদের উৎসব মূলত দৈহিক, বস্তুকেন্দ্রিক ও স্থূল প্রকৃতির আর মুসলমানদের ঈদ এসবের ঊর্ধ্বে এক আধ্যাত্মিক চেতনা ও মহিমায় ভাস্বর। ঈদের শুরু হয়, নামাজ দিয়ে। আল্লাহর ওপর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং তার অপার অনুগ্রহের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের করার মধ্যে যে আনন্দ, অন্য কিছুতে তা পাওয়া যায় না। আনন্দ ও উৎসবের নামে নশ্বরতা, ইন্দ্রিয়পরায়নতা এবং বেপরোয়া উদ্দামতার মধ্যে প্রকৃত সুখ ও প্রশান্তি নেই, যা কিনা আনন্দেরই নামান্তর।

ঈদের নামাজ মাঠে, ঈদগাহে বা মসজিদে পড়ার নিয়ম। নতুন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরে শিশু-কিশোর থেকে বয়ঃবৃদ্ধ সকল বয়সী মানুষ ঈদের নামাজে শামিল হয়। নামাজ শেষে সবাই মোসাফাহ ও কোলাকুলি করে। এসব ঈদের একান্ত অনুসঙ্গ। করোনাশংকায় ঈদে ব্যাপক সমাবেশ কিংবা মোসাফাহ- কোলাকুলিতে বারণ আছে। মাস্ক পরা ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। ঈদের আনন্দ শিশু-কিশোরদের জন্য আলাদা এবং মনে হয়, ঈদে যেন শিশু কিশোরদের জন্যই। আত্মীয়-স্বজনের বাসা-বাড়িতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা ও হৈ হুল্লোড় করার মধ্যে দিয়ে তারা আনন্দ উপভোগ ও উদযাপন করে। করোনাকারণে এবারের ঈদুল আজহায় তারা এসব আনন্দে কমই শামিল হতে পারবে।

কোরবানি ঈদুল আজহার একটা বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা। যারা সমর্থ্যবান তাদের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। এই ঈদের আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা হজ। হজ ফরজ, তবে যাদের সঙ্গতি-সামর্থ্য আছে তাদের জন্য। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মুসলমান পবিত্র মক্কা শরীফে হজ করতে যান। এ বছর বিভিন্ন দেশের মাত্র ৬০ হাজার মুসলমান হজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। ব্যাপক ও গণহজের সুযোগ করোনাকারণে রহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে লক্ষাধিক ব্যক্তি প্রতিবছর হজে গেলেও এ বছর যাচ্ছেন না। অন্যদিকে করোনাকারণে কোরবানির ব্যাপারে দুশ্চিন্তা কম নেই। কোরবানির পশুর হাট নিয়ে, পশু কেনা নিয়ে, পাওয়া নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে এসব আশংকার অনেকটাই নিরসন ঘটেছে। বরাবরই কোরবানি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে পশুর অস্থায়ী হাট বসে। এবার লকডাউনে হাট বসবে কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন দেখা দেয়। বিকল্প হিসাবে অনলাইন হাটের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারি ও বেসরকারিভাবে শত শত অনলাইন হাট গড়ে ওঠে। মোট চাহিদার অন্তত ২৫ শতাংশ গরু-ছাগল অনলাইন মাধ্যমে বিক্রী হবে বলে আশা করা হয়। বাস্তবেও হাজার হাজার গবাদি পশু অনলাইনমাধ্যমে বিক্রী হয়েছে। ইতোমধ্যে হাট-বসায় বাধা দূরিভূত হয়েছে এবং বহু হাট বসেছে।

ঈদুল আজহায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাপক রূপ পায়। সব মিলে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়। যখন করোনাকারণে অর্থনীতি গভীর সংকটে নিক্ষিপ্ত রয়েছে, তখন ঈদুল আজহা সেই সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। হজ উপলক্ষে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি খরচ হয় বৈদেশিক মুদ্রাসহ। এবার অবশ্য সেটা হচ্ছে না। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ১ লাখ ১৫ হাজার ৩০২ জন হজে গিয়েছিলেন। তাদের প্রত্যেকে গড়ে ৫ লাখ টাকা ব্যয় নির্বাহ করলে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার কোটি টাকা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ২০১৯ সালে প্রায় ৮৫ লাখ গরু ও ৬৫ লাখ ছাগল কোরবানি হয়েছিল। বাজার মূল্যে এই গরু-ছাগল বেচাকেনা হলে মোট কত টাকা লেনদেন হতে পারে, সেটা অনুমান কঠিন নয়। একজন বিশ্লেষকের মতে, কোরবানির পশু, পশুর চামড়া এবং পরিবহনসহ ঈদবাজারের আয়তন ৭৫ হাজার কোটি টাকার কম নয়। এইসঙ্গে রয়েছে হাট, ইজারা চাঁদা, বকশিস, পশুখাদ্য, বাঁশ-দড়ি ছুরি-বটি, মশলাপাতি, কাপড়-চোপড়, জুতা-স্যান্ডেল ইত্যাদি বাবদ বিপুল খরচ, যা ১০ হাজার কোটি টাকার কম হবে না।

এবারের ঈদুল আজহায় অর্থনীতিক কর্মকান্ড এমনটাই হোক, অর্থনীতির স্থবিরতা কেটে গতিশীলতা আসুক, এটাই সকলের প্রত্যাশা। সরকার বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় নিয়েই লকডাউন শিথিল করেছে। ঝুঁকি নিয়েই সরকার এটি করেছে। জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির স্বার্থেই এটা করতে হয়েছে। সবশ্রেণীর মানুষকে এই প্রেক্ষাপটে সচেতন হতে হবে। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ব্যতিক্রম হলে বিপদের শেষ থাকবে না।

করোনাকারণে বহু মানুষ কর্ম হারিয়েছে, বহু মানুষের আয় রোজগার কমেছে। পুরানো দরিদ্রের সঙ্গে নতুন দরিদ্র যুক্ত হয়েছে। মোট দরিদ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬-৭ কোটির মতো। এই সব দরিদ্রজনের দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা ও অনিশ্চিয়তার শেষ নেই। সরকারকে তাদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। আর্থিক ও পণ্য সহয়তা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে। যারা ধনী, বিত্তবান, তাদের এগিয়ে আসতে হবে তাদের সহায়তা ও কল্যাণে যতটা সম্ভব ভূমিকা রাখতে হবে। যারা কোরবানি করবেন, তারা কোরবানির গোশত এবার দরিদ্রদের জন্য অধিক পরিমাণে প্রদান করবেন, সেটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এই মহামারিকালে কল্পনাতীত সংকটে পড়া দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করলে মহান আল্লাহও সন্তুষ্ট হবেন। ঈদুল আজহার ত্যাগের শিক্ষা সকলকে অনুপ্রাণিত করুক, এই কামনা করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন