বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈদুল আজহা সংখ্যা

হজ ও কোরবানির তাৎপর্য

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০২১, ১২:০৮ এএম

যিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও মর্যাদাপূর্ণ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক এবং হাদীস শরীফে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিনগুলির গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আল্লাহর কাছে উত্তম কাজসমূহের মধ্যে পবিত্রতম এবং প্রতিদানের ক্ষেত্রে বড় আমল হলো ঐ আমল যা যিলহজ মাসের প্রথম দশদিনে করা হয়। তিনি আরও বলেছেন: এই দশদিনের মর্যাদার সমতুল্য এবং এই দশদিনের আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয় আমল আল্লাহর কাছে নেই। (দারেমী ও আহমাদ)। পবিত্র হজের মূল অনুষ্ঠান কোরবানি এই দশদিনের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। হাজী সাহেবগণ ৮ যিলহজ মক্কা মোয়াজ্জমা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে মিনায় গিয়ে অবস্থান করেন। ৯ যিলহজ সূর্যোদয়ের পর সেখান থেকে রওয়ানা দেন আরাফাতের ময়দানের দিকে । সেখানে সূর্য হেলার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ বা অবস্থান করেন। (এটিই হজের প্রধান কাজ) সূর্যাস্তের পর সেখান থেকে পৌঁছান মুজদালাফায়। রাত্রে অবস্থান করেন সেখানে। ১০ যিলহজ সকালে সেখান থেকে রওয়ানা করে পৌঁছেন গিয়ে মিনা উপাত্যকায়। সেখানে শয়তানকে পাথর মেরে তারপর করেন কোরবানি। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিদিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু যবেহ করাকে বলা হয় কোরবানি। কোরবানির তাৎপর্য হলো ত্যাগ তিতিক্ষা এবং প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি করেন আদম আ. এর দুই পুত্র হাবীল ও কাবিল। প্রত্যেক জাতির জন্যই কোরবানির বিধান ছিল। আমরা যে কোরবানি করছি তা হযরত ইবরাহিম আ. এর অপূর্ব ত্যাগের ও বিস্ময়কর ঘটনার স্মারক।

আল্লার মহাপরিকল্পনায় কি আছে তাৎক্ষণিকভাবে তা আমরা জানি না, বুঝি না। হাকিমের কাজ অবশ্যই হিকমতপূর্ণ। সেই হিকমত বুঝা যায় কখনো কখনো অনেক পরে। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক মা হাজেরা ও শিশু ইসমাইল আলাইহিস সালামকে মক্কার মরু বিয়াবানে নির্বাসন দেয়ার কথাই ধরা যাক। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন আল্লাহর খলীল কিন্তু নিঃসন্তান। তিনি আল্লাহর সমীপে ফরিয়াদ জানালেন: ‘হে পরওয়ারদেগার! আমাকে একটি নেককার পুত্র দান করুন’। আল্লাহপাক তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন এবং ‘তাঁকে একটি স্থিরবুদ্ধির সন্তান দান করলেন’। (সাফফাত: ১০০-১০১) ছোট সহধর্মিনীর গর্ভে জন্ম নেয়া এই শিশুর নাম রাখা হলো ইসমাইল আলাইহিস সালাম। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম বাস করতেন ফিলিস্তিন এলাকায়। ইতোমধ্যে তার বড় সহধর্মিনী সারা বিবির মনে জেগে উঠল স্বপত্নী বিদ্বেষ। তিনি হাজেরা ও তাঁর সন্তানকে নির্বাসন দিতে বললেন ইবরাহিম আ.কে। আল্লাহর ইশারা পেলেন তা কার্জকর করার। তিনি হাজেরা ও ইসমাইল আ.কে নিয়ে চলে এলেন প্রায় হাজার মাইল দূরে উসর ধূসর পার্বত্য মরু উপাত্যকা মক্কায়। জন মানবহীন, তরুলতা, ফলমূল, খাদ্যপানি শূন্য হাহাকার ভরা পার্বত্য এই মরু উপাত্যকায় হাজেরা ও ইসমাইল আ.কে নির্বাসন দিয়ে গেলেন। আল্লাহর ভবিষ্যৎ মহাপরিকল্পনা তাৎক্ষণিকভাবে আমরা বুঝতে পারি না। সে পরিকল্পনায় তো ছিল, এখানে আল্লাহর পবিত্র ঘর কাবাশরীফ পুনঃনির্মিত হবে, হজের আনুষ্ঠানিকতা প্রবর্তীত হবে, এখানে তাঁর হাবীব বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবির্ভূত হবেন, নাযিল হবে পবিত্র কুরআন। এখানকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে প্রচারিত ও প্রসারিত হবে ইসলাম। এই স্থান পরিণত হবে বিশ্বাসীদের মহামিলন কেন্দ্রে। হাজেরা ও ইসমাইল আ.কে নির্বাসন দেয়ার মধ্য দিয়ে হলো যার সূচনা।

বড় করুণ, বড় হৃদয় বিদারক সে দৃশ্য! মাতা ও শিশু পুত্রকে নির্বাসন দিয়ে হযরত ইবরাহিম আ. যখন শামের দিকে যাত্রা করলেন তখন দিশেহারা হয়ে পড়লেন হাজেরা। স্বামীর জামার আস্তিন টেনে ধরে অশ্রুস্নাত আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, আমার মতো এক অবলা নারী ও দুগ্ধ-পোষ্য এই শিশুকে এই ভয়াবহ স্থানে রেখে কোথায় যাচ্ছেন আপনি-স্বামী? ইবরাহিম আ. এর হৃদয় তখন বেদনা ভারাক্রান্ত। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী আর অশীতিপর বয়সে প্রাপ্ত একমাত্র (তখন পর্যন্ত) সন্তানকে রেখে যেতে তিনি অশ্রুসজল হলেন। কিন্তু খোদার পরীক্ষায় হলেন উত্তীর্ণ। বললেন, সবর করো হাজেরা, এ যে আল্লাহর ইচ্ছা। এখানে আল্লাহর ঘর লুপ্ত আছে। আল্লাহ দেখবেন। হাত তুলে তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানালেন (কুরআনের ভাষায়) রাব্বানা ইন্নি আসকানতু... ‘হে পরওয়ারদেগার! আমি আমার এক সন্তানকে তোমার গৃহের সন্নিকটে, এক ফল-ফসলহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে গেলাম। হে আমার প্রতিপালক! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। তুমি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট, অনুরাগী করে দাও এবং ফল-ফলাদি দ্বারা তাদের রিযকের ব্যবস্থা করো। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। (সূরা ইবরাহিম: আয়াত ৩৭)

থাকলেন হাজেরা। পানি নেই, শিশু ইসমাইলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তেষ্টায় দিশেহারা হাজেরা উম্মাদিনীর মতো দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন। একবার দৌড়ে গিয়ে ওঠেন পার্শ্ববর্তী সাফা পাহাড়ে আর একবার মারওয়া পাহাড়ে। আশা, কোনো কাফেলা যায় নাকি এ পথ ধরে। দু’পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান অতিক্রম করেন অতিদ্রুত। এখান থেকে দৃষ্টিগোচর হয় না শিশুকে। না জানি প্রাণের যাদুকে নিয়ে যায় কোনো বন্য শেয়াল। এভাবে ৭ বার। না কাউকে দেখা যাচ্ছে না। নিরাশ হয়ে ফিরলেন ইসমাইলের কাছে। এ কী দৃশ্য! শিশু ইসমাইলের কচি পায়ের আঘাতে কঠিন পাথুরে যমিন ফেটে প্রবাহিত হচ্ছে পানির ফোয়ারা। ইসমাইলকে পান করালেন সেই পবিত্র পানি। নিজেও পান করলেন। স্বতঃস্ফূর্ত সেই জলধারাকে আটকে রাখার জন্য তার চার দিকে পাথরের টুকরা দিয়ে কূপাকৃতি করলেন। এই হলো যমযম, যা বিশ্ববাসী মহা নিয়ামত হিসেবে পান করে চলছে। পান করতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত। এ পানি ফুরায় না, ফুরাবে না। আল্লাহপাক মা হাজেরার দৌড়াদৌড়িকে এতই পছন্দ করলেন যে, তা হজ ও ওমরাকারীদের ওপর ওয়াজিব করে দিলেন। আল্লাহর ফরমান: ‘সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। সুতরাং যে কেউ কাবা গৃহের হজ বা ওমরা সম্পন্ন করে তারা এই দুটির মধ্যে দৌড়ালে তাতে কোনো পাপ হবে না। বরং কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ নেক কাজ করলে আল্লাহ (তার) পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারা: আয়াত ১৫৮)

কোরবানির ঘটনা
পবিত্র কুরআনের ভাষায়: ‘সে যখন (পিতার সাথে) দৌড়াদৌড়ি করার মতো (বয়সে) তখন সে (ইবরাহিম ছেলেকে) বললো, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, আমি তোমাকে যবাই করছি, (বলো এ ব্যাপারে) তোমার অভিমত কী? (এ কথা শুনে) সে বললো, হে আমার আমার আব্বা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে (এ সময়েও) ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন। অতঃপর যখন তারা দুজনই (আল্লাহতালার) ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ করলো তাকে (যবাই করার জন্য) উপুড় করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি (আমার দেখানো) স্বপ্ন সত্য প্রমাণ করেছো, আমি তোমাদের উভয়কে মর্যাদাবান করবো। (মূলত) আমি এভাবেই সৎকর্মশীল মানুষদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। এটা ছিল (তাদের উভয়ের) জন্য একটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার (ছেলের) পরিবর্তে (আমার পক্ষ থেকে) একটা বড় কোরবানির পশু (সেখানে) দান করলাম। (অনাগত মানুষদের এ কোরবানির বিধান চালু রেখে) তার স্মরণ আমি অব্যাহত রেখে দিলাম’ (সূরা আস সাফাফাত: ১০২)

বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ইসমাইল আ. যখন কৈশরে উপনীত হলেন তখন হযরত ইবরাহিম আ. আল্লাহর নিকট থেকে স্বপ্নে নির্দেশ পেলেন হে, ইবরাহিম কোরবানি করো। প্রাতে উঠে তিনি একশত দুম্বা কোরবানি করলেন। দ্বিতীয় রাতে তিনি আবার কোরবানির নির্দেশ পেলেন। এবার নির্দেশ পালনার্থে তিনি একশত উট কোরবানি করলেন। তৃতীয় রাতে পুনঃ নির্দেশ পেলেন হে ইবরাহিম! তোমার সব চেয়ে প্রিয় বস্তুকে আমার রাহে কোরবানি করো। প্রাতে উঠে ভাবলেন, আমার সব চাইতে প্রিয় বস্তু তো একমাত্র পুত্র ইসমাইল। তাকেই আল্লাহ চাচ্ছেন। মনস্থির করে ফেললেন তিনি। উপস্থিত হলেন গিয়ে হাজেরা আ. এর কাছে। বললেন ইসমাইলকে সাজিয়ে দাও তাকে বন্ধুর বাড়ি যিয়াফতে নিয়ে যাব। খুশি হলেন মা হাজেরা। এত দিন পরে শাম থেকে পিতা এসেছেন পুত্রের কাছে, নিয়ে যেতে বন্ধুর বাড়ি যিয়াফতে। তিনি বসন-ভূষণে পুত্রকে সাজিয়ে রওয়ানা করিয়ে দিলেন। তারা বের হয়ে যেতেই শয়তান মানবাকৃতি ধারণ করে হাজেরার কাছে হাজির হয়ে বলল, তুমি কি জান তোমার পুত্রকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? - কেন বন্ধুর বাড়ি যিয়াফতে। - না, না, তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যবেহ করতে। - কেন পিতা পুত্রকে নিয়ে যাবে যবেহ করতে? - ইসমাইলকে যবেহ করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ, তাই তাকে নিয়ে যাচ্ছে ইবরাহিম। মা হাজেরা বললেন, আল হামদুলিল্লাহ, দুনিয়ায় আমার ইসমাইলের মতো হাজারো ইসমাইল বিদ্যমান থাকতে মহান আল্লাহ যে আমার ইসমাইলকে পছন্দ করেছেন, এতো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। তুই শয়তান আমাকে ধোকা দিতে এসেছিস, ভাগ এখান থেকে।

ইসমাইলকে নিয়ে ইবরাহিম আ. চলছেন মিনা উপাত্যকার দিকে। পিছে পড়ে গেছে ইসমাইল। এই সুযোগে শয়তান তাকে বলল, তুমি জানকি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তোমাকে তোমার পিতা? - কেন যিয়াফত খেতে। আরে! যিয়াফত নয়, যবেহ করতে নিয়ে যাচ্ছেন। - কেন? - আল্লাহ এ নির্দেশ দিয়েছেন। ইসমাইল আ. বললেন তাই যদি হয়, সেতো খোশ কিসমত! দুনিয়ায় আমার মতো হাজারো ইসমাইল থাকতে দয়াময় আল্লাহ আমাকে যে পছন্দ করেছেন, এতো পরম সৌভাগ্যের কথা। তুই শয়তান আমাকে ধোকা দিতে এসেছিস, ভাগ এখান থেকে। তিনি পাথর ছুঁড়ে তাড়িয়ে দিলেন শয়তানকে।

এতক্ষণে পিতা-পুত্র হাযির হলেন এসে মিনা ময়দানে। এবার ইবরাহিম আ. স্বপ্নাদেশ অবহিত করে এ ব্যাপারে জানতে চাইলেন ইসমাইলের মতামত। সে খুশি মনে বলল ‘ইয়া আবাতেফআল মা তু’মার’। ‘আব্বাজান! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারীদের মাঝে পাবেন’। আব্বা! এ ব্যাপারে আপনার কাছে আমার তিনটি আবদার আছে। ১. আমার হাত পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিন। যাতে ছটফট করার কারণে যবেহ সমাধা করতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। ২. আমাকে জমিনে উপুর করে শুইয়ে দিন। যাতে আমার চেহারার উপর আপনার দৃষ্টি পরে স্নেহবশত ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। ৩. যবেহের পরে আমার রক্তমাখা বস্ত্রাদি আমার জনম দুঃখিনী মাকে নিয়ে দেবেন এবং তাঁকে ধৈর্য ধরার নসিহত করবেন। ইবরাহিম আ. তাই করলেন ইসমাইল আ. এর হাত পা শক্ত করে বাঁধলেন, যমিনের উপর উপুর করে শোয়ালেন, এবং তীক্ষ্ণধার ছুরি তার গলায় চালিয়ে দিলেন। বিশ্ব প্রকৃতি স্তব্ধ বিস্ময়ে, রুদ্ধশ্বাসে প্রত্যক্ষ করল আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদনের ও ভালবাসার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। কিন্তু কী আশ্চর্য! ছুরি গলায় বসছে না, একটা পশমও কাটছে না, আরও জোরে চালালেন, কিন্তু না কাটছেই না। ইবরাহিম আ. বলছেন আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ছুরির তলে ইসমাইল আ. বলছেন আল্লাহু আকবার, আর জিব্রাঈল আ. লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে বেহেশত থেকে একটি দুম্বা নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন। গায়েব থেকে আল্লাহ রাববুল আলামীন আওয়াজ দিলেন, ‘ইয়া ইবরাহিম! কাদ সাদ্দাকতার রুইয়া’। ‘হে ইবরাহিম তুমিতো স্বপ্নকে সত্য সত্যই বাস্তবায়িত করলে। জিব্রাঈল আ. বললেন, কোরবানি কবুল। ইসমাইলের পরিবর্তে আল্লাহ-প্রেরিত এই বেহেশতি দুম্বাকে যবেহ করুন। এভাবে বেহেশতি দুম্বা কোরবানি হলো এবং রক্ষা পেলেন ইসমাইল আ.। উভয়ে লাভ করলেন আল্লাহর পরম সন্তুষ্টি। আল্লাহ পাক বলেন: ‘তোমাদের কোরবানিকৃত পশুর রক্ত বা গোশত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের মনের তাকোয়া’। (সূরা হজ: আয়াত ৩৭) অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন: ‘আমি প্রত্যেক জাতির জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছি, যাতে তারা আল্লাহর দেয়া চতুস্পদ পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ। সুতরাং তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণ করো এবং বিনীতগণকে সুসংবাদ দাও।’ (সূরা হজ : আয়াত ৩৪)

সাহাবায়ে কেরাম একদা রাসূলুল্লাহ সা.কে প্রশ্ন করলেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোরবানি কী? তিনি বললেন: তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ. এর সুন্নাত। তারা বললেন: এ দ্বারা আমরা কী পাবো? তিনি বললেন: এ পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে তোমরা একটি করে নেকী পাবে। (ইবনে মাজাহ) রাসূলুল্লাহ সা. বলেন: ‘আদম সন্তান কোরবানির দিন যে সব নেকীর কাজ করে থাকে তন্মধ্যে আল্লাহপাকের নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় আমল হলো কোরবানি করা। কিয়ামতের দিন কোরবানির পশু তার শিং পশম ও খুরসহ উপস্থিত হবে এবং কোরবানির রক্ত যমীনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ পাকের নিকট কবুল হয়ে যায়।’ (ইবনে মাজাহ) কোরবানির পশু কিয়ামতের দিন কোরবানিকারীর জন্য পুলছিরাতে সওয়ারী হবে।

রাসূলুল্লাহ সা. প্রতি বছরই কোরবানি করেছেন। সোলেহ হোদায়বিয়ার সময় তিনি নিজ হাতে কোরবানির উট যবেহ করেছন। বিদায় হজের সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একশত উট কোরবানি করেছেন। তন্মধ্যে ৬৩টি উট নিজ হাতে যবেহ করেছেন। বাকী ৩৭টি উট তার নির্দেশে হযরত আলী রা. যবেহ করেন।

কোরবানি করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। আল্লাহপাক বলেন, ‘আপনি বলে দিন, আমার নামায, আমার কোরবানি তথা আমার সমগ্র ইবাদত, আমার জীবন ও মরণ সবকিছু বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আল আনআম: আয়াত ১৬২)

অনেক সময় এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে কোরবানির পশুর ব্যাপারে প্রদর্শনী বাতিক পরিলক্ষিত হয়। কত টাকা দিয়ে, কত বড় ও হৃষ্ট পুষ্ট গরু কেনা হচ্ছে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা ও অহংকার করতে দেখা যায়। এটা পরিহার করা উচিত। লোকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কোনো ইবাদত করা হলে তা ইবাদত হিসাবে গণ্য না হয়ে গুনায় পর্যবসিত হয়, একে বলা হয় রিয়া।

ইদানিং করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় তথাকথিত কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে ফতোয়া দিতে দেখা যাচ্ছে কোরবানি না দিয়ে সেই টাকা অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বিতরণ করতে। এই দারুণ দুঃসময়ে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেককে দুর্দশাগ্রস্ত অসহায় লোকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। এটা মানবিক কর্তব্য। এ দ্বারা অবশ্যই অসীম সওয়াব লাভ হবে। তবে তার জন্য কোরবানি বন্ধ রেখে সেই টাকা দিতে হবে কেন? কোরবানি একটি ইবাদত। যার প্রতি কোরবানি করা ওয়াজিব, অবশ্যই তাকে কোরবানি করতে হবে। কোরবানি করার সাথে সাথে দুর্গত লোকদের সাহায্যেও এগিয়ে যেতে হবে। কোরবানির গোশত তাদের মধ্যে বিতরণ করা যেতে পারে।

এবার হজের বিষয়ে সামান্য আলোচনা করে নিবন্ধের ইতি টানব। ইতোমধ্যে ইসমাইল উপনীত হলেন কৈশরে। তখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইবরাহিম খলীলকে নির্দেশ দিলেন কাবা পুনঃস্থাপনের। তিনি নির্দিষ্ট স্থানে খুঁজে পেলেন আদম আ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কাবার ভিত। বাপ-বেটা মিলে গড়ে তুলতে লাগলেন কাবার প্রাচীর এবং দোয়া করতে থাকলেন- ‘রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস সামিউল আলীম’- ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাদের এ কাজকে কবুল করো, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞাতা। হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি আমাদেরকে তোমার একান্ত অনুগত করো। আমাদের বংশধরদের থেকে তুমি এক অনুগত উম্মত বানিও।’

হে প্রতিপালক! (তাদের মধ্যে) এক রাসূল পাঠিও যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করবে, তাদেরকে কিতাব হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা বাকারা: আয়াত ১২৭,১২৮)

সেই মোতাবেক কাবার যিয়ারত ও হজ চলছে, চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। করোনা ভাইরাসের কারণে দু’ বছর ধরে হজ ও যিয়ারত চলছে অত্যন্ত সীমিত পরিসরে। সৌদি আরবের বাইরের লোকেরা যেতে পারছেন না হজ ও যিয়ারতে। কাবা প্রেমিক, রাসূলেপাকের রওযা মুবারক যিয়ারত আকাক্সক্ষীদের হৃদয়ে জ্বলছে বিচ্ছেদ বেদনার আগুন। আসুন, আমরা সকলে তওবা করি, আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করি, ফরিয়াদ জানাই-

ওগো দয়াময় এ বালা সহনে শক্তি মোদের নাই
মাফ করে দাও, দূর করো বালা তব রহমাত চাই।
আবার ধরায় ফিরাও সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ
হে প্রতিপালক! তব রহমাত করুণা তো অনিঃশেষ।
কাবাকে ঘেরিয়া লক্ষ কণ্ঠে হোক লাব্বায়েক ধ্বনি
আকাশে বাতাসে উঠুক আবার সেই ধ্বনি রণি রণি।
তব হাবীবের রওযায় হোক ইয়া নাবীর গুঞ্জন
কুল দুনিয়ায় কর প্রভূ খাস রহমাত বরিষণ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন