হজ আরবি শব্দ; যার আভিধানিক অর্থ হলো কোনো কিছুকে পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করার সংকল্প করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ্র নির্দেশ মেনে ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কা’বা শরীফ যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে ভ্রমণের ইচ্ছা বা সংকল্প করা এবং ইসলামী শরীয়াহ্ অনুসারে নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকান্ড সম্পাদন করার নামই হজ। হজে বায়তুল্লাহ্ ইসলামের ৫টি রুকনের মধ্যে অন্যতম। নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ১০ম হিজরীতে একবার সপরিবারে হজ পালন করেন। ৯ম হিজরীতে নবী (সা.)-এর মাধ্যমে হজকে ফরয করা হয়। হজ সম্পন্ন করতে যিলহজের ৮ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে আরবের মক্কা, মিনা, আরাফাহ্ ও মুযদালিফায় নির্দিষ্ট কিছু কর্মকান্ড সম্পাদন করতে হয়। পৃথিবীতে যত নেক ‘আমল রয়েছে তন্মধ্যে হজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ। নবী করীম (সা.) অন্য সকল ‘আমলের উপর হজের মর্যাদাকে পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্তের দূরত্বের সাথে তুলনা করেছেন। হজ এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে আল্লাহ্র সাথে বান্দার সম্পর্ক সুদৃঢ় করার সঙ্গে সঙ্গে বান্দার সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সুদৃঢ় করাও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য।
ইসলামী শরীয়াহ্ অনুযায়ী হজ কবুল হওয়ার জন্য ৩টি কাজ যথাযথভাবে আদায় করতে হয়। ১. সহীহ্ভাবে নিয়্যত করা। ২. নির্দিষ্ট সময়ে তথা হজের মাসেই হজ সম্পাদন করা। ৩. নির্দিষ্ট কার্যাবলীর মাধ্যমে অর্থাৎ রাসূল (সা.) নির্দেশিত পদ্ধতি অনুযায়ী হজ সম্পাদন করা। উক্ত তিন কাজের মধ্যে যে কোনো একটি কাজ সঠিক সময়ে সঠিকভাবে আদায় করতে ব্যর্থ হলে হজ আদায় অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
হজ একই সাথে শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত। এজন্য হজ আদায় করা সবার ওপর ফরয নয়। বিত্তশালী লোকদের জন্য হজ অন্যতম ইবাদত। ফরয হওয়ার সাথে সাথে তা আদায় করা অবশ্য কর্তব্য। বিনা ওজরে বিলম্ব করাও গুনাহের কাজ। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা আলে ইমরানের ৯৭ নং আয়াতে ইরশাদ ফরমান, মানুষের মধ্যে যারা কা’বা ঘরে যাওয়ার সামর্থ্য আছে তার জন্য আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহের হজ করা অবশ্য কর্তব্য বা ফরয। এতদসত্তে¡ও যে তা অমান্য করবে সে কাফির, আর আল্লাহ্ তার সৃষ্টি জগতের কারো মুখাপেক্ষী নন।’ এছাড়াও মহান আল্লাহ্ সূরা বাক্বারার ১৯৬ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহ্র জন্য হজ্জ ও উমরাহ্ পালন কর।’
হজ যে একটি অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ ইবাদত তা নিম্নে বর্ণিত হাদীসে কারীমা দ্বারাও প্রমাণিত। যেমন: হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তি হজের সংকল্প করে, সে যেন দ্রুত সেটা সম্পাদন করে। কেননা, তোমাদের কারো জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে। (আবু দাউদ, মিশকাত: ২৫২৩)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন: এক উমরাহ্ থেকে অপর উমরাহ্ পর্যন্ত সময়ের (সগীরা গুনাহের) কাফফারা স্বরূপ। আর জান্নাতই হলো কবুল হজের একমাত্র প্রতিদান। (সুনানে নাসায়ী : ২৬২২)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আকরা বিন হাবিস নবী করীম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হজ কি প্রতি বছর ফরয না জীবনে একবারই ফরয? নবী (সা.) উত্তরে বললেন: না, বরং হজ জীবনে একবারই ফরয, যে ব্যক্তি একাধিকবার করবে তা (তার জন্য) নফল হবে। (আবু দাউদ: ১৭২১, নাসায়ী: ২৬২০)
কোনো ব্যক্তির ওপর হজ ফরয হওয়ার জন্য ইসলামী শরীয়তে যেসব শর্তারোপ করা হয়েছে তা হলো: ১. মুসলমান হওয়া। ২. স্বাধীন হওয়া। ৩. প্রাপ্ত বয়স্ক ও জ্ঞানবান হওয়া। ৪. শারীরিকভাবে পূর্ণ সুস্থ হওয়া। ৫. দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন হওয়া। ৬. হজে গমনের রাস্তা নিরাপদ হওয়া। ৭. মহিলা হজযাত্রীর সঙ্গে তার স্বামী বা অন্য কোনো মুহ্রিম পুরুষ থাকা। ৮. পারিবারিক খরচ ব্যতীত হজের সমস্ত ব্যয় বহন করার সামর্থ্য থাকা। এসব শর্তাবলী কারো মধ্যে থাকা সত্তে¡ও যদি কেউ গড়িমসি করে হজ আদায় না করে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে তার কঠিন শাস্তির ব্যাপারে রাসূল (সা.) হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
মহানবী (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ্ তোমাদের উপর হজ্জ্ব ফরয করেছেন সুতরাং তোমরা হজ পালন কর (মুনতাকী)। আর সঠিক সময়ে হজ পালন না করা কুফুরী। সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও যারা হজ পালনে বিরত থাকে মহানবী (সা.) তাদেরকে ইয়াহুদি নাসারাদের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার জন্য পাথেয় এবং বাহন যার আছে সে যদি হজ আদায় না করে আর এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তবে তার মৃত্যু ইয়াহুদি নাসারাদের মতো। (তিরমিযি: ৮১২)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়েছে। অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সেও তদ্রুপই হয়ে যায়। (বুখারী: ১৪২৪)
আরেকটি হাদীসে নবী করীম (সা.) বলেছেন: শয়তান আরাফার দিন হতে অধিক লজ্জিত ও অপদস্থ আর কোনো দিন হয় না, কেননা ওই দিন আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বান্দার প্রতি অগণিত রহমত বর্ষণ করেন ও অসংখ্য কবিরা গুনাহ্ ক্ষমা করে দেন। তিনি আরো বলেছেন: একটি বিশুদ্ধ ও মকবুল হজ সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর চেয়ে উত্তম। বেহেস্ত ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু তার প্রতিদান হতে পারে না। (বুখারী: ১৭৭৩)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ৩টি দল আল্লাহ্র মেহমান: আল্লাহর পথে জিহাদকারী, হজকারী ও উমরাহ্ পালনকারী। (নাসাঈ, মিশকাত: ২৫৩৭) অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূল (সা.) বলেন, হজ ও উমরাহ্ পালনকারীগণ আল্লাহর মেহমান। তারা দু‘আ করলে তিনি কবুল করেন। তারা ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন।
আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ ও জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেছেন: আগুন যেভাবে স্বর্ণ, রৌপ্য ও লোহা থেকে খাঁদ দূর করে, তেমনি যদি তোমরা তোমাদের দারিদ্রতা ও পাপ মোচন করতে চাও তাহলে তোমরা ফরয হওয়ার পর পরই হজ ও উমরাহ্ পালন কর। (তিরমিযি ও নাসাঈ)
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, কারো ইসলাম গ্রহণ পূর্বকৃত সকল পাপকে মুছে দেয়। হিজরত তার পূর্বের সকল গুনাহ্ মুছে দেয় ও হজ তার পূর্বের সকল পাপ মুছে দেয়। (মুসলিম: ১৭৩)
হযরত বুরাইদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, হজ পালনে অর্থ ব্যয় করা আল্লাহর পথে ব্যয় করার সমতুল্য। এক দিরহাম ব্যয় করলে ওটাকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। (আহমদ, বায়হাকী)
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন: আল্লাহ্ তা‘আলা হাজীদের গুনাহ্ ক্ষমা করেন এবং হাজীগণ যাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাদেরকেও ক্ষমা করেন। (মুসনাদে বাযযার : ১১৫৫)
মহান আল্লাহ্ পাক সকল সামর্থ্যবান মু’মীন মুসলমান নর-নারীকে পবিত্র হজ পালন করার তৌফিক দান করুন, আমীন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক
শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন