রাজধানীর গুলশান থানায় করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটি থেকে সদ্য পদ হারানো হেলেনা জাহাঙ্গীরের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল শুক্রবার রাতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে হেলেনাকে আদালতে হাজির করেন। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিলের আবেদন করেন। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু রিমান্ডের জোর দাবি জানান। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী রিমান্ডের এ আদেশ দেন। এর আগে গতকাল শুক্রবার গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা দায়ের করে র্যাব।
অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মানহানি ও সুনাম নষ্ট করেছেন। খ্যাতি লাভের আশায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের বিব্রত করতেন তিনি। অস্ট্রিয়া প্রবাসী আলোচিত বাংলাদেশি নাগরিক সেফুদার নিয়মিত যোগাযোগ ও লেনদেন ছিল। সেফুদা তাকে নাতনি হিসেবে সম্বোধন করতেন। গতকাল শুক্রবার কুর্মিটোলা র্যাব সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গুলশান-২ এর ৩৬ নম্বর রোডের বাসভবনে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতারের সময় হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে ১৯ বোতল বিদেশি মদ, একটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া, একটি হরিণের চামড়া, দু’টি মোবাইল ফোন, ১৯টি চেক বই ও বিদেশি মুদ্রা, দু’টি ওয়াকিটকি সেট এবং ক্যাসিনো খেলার সরঞ্জাম ৪৫৬টি চিপস উদ্ধার করে র্যাব। পরে মধ্যরাতে তার জয়যাত্রা টেলিভিশন স্টেশনেও অভিযান চালায় র্যাব। তার মালিকানাধীন আইপি টেলিভিশন চ্যানেল জয়যাত্রার কোনো অনুমোদন না থাকায় ওই কার্যালয় সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। গতকাল সন্ধায় র্যাব তাকে গুলশান থানায় হস্তান্তর করে। তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ও টেলিযোগাযোগ আইনে পৃথক পাঁচটি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ২টি মামলা করা হয়েছে। শুক্রবার গুলশান থানায় র্যাব-১ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ্ত কুমার চক্রবর্তী জানান, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা দায়ের করেছে র্যাব-১। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মামলায় মাদক, বন্যপ্রাণী ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা যুক্ত করা হয়েছে।
র্যাব সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরো বলেন, ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিদের সম্মানহানি করার অপচেষ্টার অভিযোগে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেফতার করা হয়। হেলেনা খ্যাতি লাভের আশায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের বিব্রত করতেন। অনৈতিক পন্থায় সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে খ্যাতনামা হিসেবে উপস্থাপন করতে চতুরতার আশ্রয় গ্রহণ করতেন। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তিনি একটি সংঘবদ্ধ চক্র তৈরি করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ফেসবুক লাইভে এসে অযাচিত ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করতেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, তিনি (হেলেনা) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন সম্মানিত ব্যক্তিদের কটাক্ষ ও উত্ত্যক্ত করতেন। পরবর্তী সময়ে ফোন করে তাদের হেয় করতেন। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে তার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেন। এছাড়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন আইপি টেলিভিশন জয়যাত্রার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।
তিনি বলেন, হেলেনা জাহাঙ্গীর অস্ট্রিয়া প্রবাসী আলোচিত সেফুদাকে নাতি ডাকতেন। সেফুদার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং তার সঙ্গে লেনদেনও ছিল হেলেনা জাহাঙ্গীরের। সেফুদা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে দেশবাসীর নজর কাড়তে চেষ্টা করেন। হেলেনা জাহাঙ্গীর অপকৌশলের মাধ্যমে নিজেকে ‘মাদার তেরেসা’, ‘পল্লীমাতা’, ‘প্রবাসীমাতা’ হিসেবে পরিচিতি পেতে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র ভুয়া খেতাবের অপপ্রচার চালাত।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থা ও ব্যক্তিদের থেকে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে অর্থ সংগ্রহ করতেন। যা মানবিক সহায়তায় ব্যবহারের চেয়ে গ্রেফতারকৃতের খেতাব প্রচার-প্রচারণায় বেশি ব্যবহার করা হতো। হেলেনা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রেখে নিজের বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেন। তিনি ১২টি ক্লাবের সদস্যপদে রয়েছেন।
ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি সেবন করেন হেলেনাকন্যা
র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড বা এলএসডির মতো ভয়ঙ্কর মাদকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মেয়ে জেসিয়া আলম আসক্ত। পরিবার থেকে মালয়েশিয়ায় পড়াশোনার জন্য পাঠানো হলেও তা শেষ করতে পারেননি জেসিয়া। বিদেশে থাকা অবস্থায় মদসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত হন তিনি। পরে দেশে এসেও প্রতিনিয়ত এলএসডি, গাঁজা, মদসহ বিভিন্ন মাদকের সঙ্গে জেসিয়া জড়িত ছিলেন বলে দাবি র্যাবের। হেলেনা জাহাঙ্গীরের দুই মেয়ে, এক ছেলে। অভিযানের সময় হেলেনার দুই মেয়ে সেখানে ছিলেন। বাড়িটির চারটি ফ্লোরে বসবাস ছিল হেলেনার। সেখানে ১৭টির বেশি রুম রয়েছে। অভিযানে মেয়ে জেসিয়ার রুম থেকে বিদেশি মদের ছোট তিনটি বোতল উদ্ধার করা হয়। এসব তিনি নিজেই বের করে দেন। এছাড়া ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি সেবন করতেন জেসিয়া। অভিযানের সময় নিজেই বলেন, এলএসডি উড়াতে হবে। জেসিয়ার রুমে অন্যান্য মাদক সেবনের সরঞ্জামও পাওয়া যায়।
অবৈধ নয়, মদ রাখার লাইসেন্স ছিল : হেলেনাকন্যা জেসি
হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় র্যাবের অভিযানে পাওয়া মদ অবৈধভাবে রাখা হয়নি বলে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন তার মেয়ে জেসি আলম। বিদেশি মদ প্রসঙ্গে জেসি আলম বলেন, আমরা মদ খাই না। করোনাকালে আমরা অ্যালকোহল খাইনি। মদের কালেকশন আমার ভাইয়ের। এগুলো রাখার লাইসেন্সও তার ছিল। সেই লাইসেন্সও তারা (র্যাব) নিয়ে গেছে। সাংবাদিকরা হরিণের চামড়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটি একটি উপহার। মায়ের নেত্রীরা আমার ভাইয়ের বিয়ের সময় এটি উপহার দিয়েছিলেন।
বিদেশি মুদ্রার বিষয়ে জেসি আলম বলেন, আমরা প্রায় সময়ই বিদেশে যাতায়াত করি। অনেক দেশে আমরা ভ্রমণ করতে যাই। আমাদের সবার পাসপোর্টও আছে। ফিরে আসার পর সেগুলো বেঁচে গেলে আমরা কি ফেলে দেব নাকি? ক্যাসিনো সরঞ্জাম সম্পর্কে তিনি বলেন, একটা ক্যাসিনো করতে অনেক সরঞ্জাম লাগে যা আমাদের এখানে ছিল না। আমাদের এখানে তাস ছিল যা আমরা বন্ধুদের সঙ্গে খেলতাম। হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আটকের বিষয়ে জেসি আলম বলেন, র্যাবের কাছে কোনো ওয়ারেন্ট ছিল না। তারা আমাদের সহযোগিতা করেনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন