রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রথমে সখ্যতা তৈরি করে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল। এই বø্যাকমেইল করে টাকা আদায় করতেন স¤প্রতি গ্রেফতার হওয়া ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর। যাদের কাছ থেকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করা হয়েছে সে বিষয়ে তথ্য আমরা পেয়েছি। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। গতকাল শনিবার তিনি এসব কথা বলেন। অন্যদিকে রিমান্ডের প্রথম দিনে ব্যবসা, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে কানেকশনসহ বেশকিছু বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল আলোচিত অস্ট্রিয়া প্রবাসী সেফাত উল্লাহ সেফুদা বলেছেন, হেলেনা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে (আমার) টাকা নয়, হৃদয়ের লেনদেন। শনিবার ফেসবুক লাইভে এসে তিনি এ কথা বলেন। তবে তার আয়ের উৎস সম্পর্কে সিআইডি কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট্র কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানাবে র্যাব। এরই মধ্যে হেলেনা জাহাঙ্গীরের আয়ের উৎস তদন্তে নেমেছে একাধিক সংস্থা।
হেলেনা জাহাঙ্গীরের মামলা তদন্ত করছেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তার ঢাকায় ১৬টির অধিক ফ্ল্যাট ও ৮টির বেশি গাড়ি রয়েছে। এছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একাধিক শিল্প কারখানা রয়েছে। খুব অল্প সময়েই তিনি এত সম্পদের মালিক হয়েছেন। তদন্ত চলছে। তদন্তের সব বেরিয়ে আসবে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আরো বলেন, হেলেনা সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির জন্য থেমে থাকেননি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তার। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাকেই প্রয়োজন হয়েছে তাকে তিনি ঘায়েল করেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন এবং সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছেন শুধুমাত্র উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আমাদের মামলার কারণ এটাই। সে রাষ্ট্রের ব্যক্তিদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছে যা তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, জনগণের মধ্যেও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন এই মামলাটির র্যাব তদন্ত করবে তাহলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে আমরা আবেদন করব। তবে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে হবে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী ১৯৯০ সাল থেকে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে অন্যদের সঙ্গে পার্টনারশিপ’র মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি।
আমরা জানতে পেরেছি গত দুই বছরে বিভিন্ন মাধ্যম এবং টেলিভিশনে চাকরি দেয়ার কথা বলে, এজেন্সি দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা আদায় করত। কারো কাছ থেকে দশ হাজার কারো কাছ থেকে বিশ হাজার টাকা, আবার কারো কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন বলে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। কী কারণে টাকা নিয়েছেন এবং কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে- এ বিষয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা। এসবের তাই অফিস স্টাফদের ওপর চাপিয়েছেন তিনি। বাসায় এবং অফিস থেকে যে পরিমাণ ভাউচার পাওয়া গেছে তা এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। জয়যাত্রা টেলিভিশন’র আইডি কার্ড ব্যবহার করে অনেক প্রতিনিধিও এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন- হেলেনা জাহাঙ্গীর আমাদেরকে জানিয়েছেন, তার ১৫ থেকে ১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তিনি জড়িত। বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি কিংবা ব্ল্যাকমেইল করে আদায় করা টাকাগুলো তিনি ফাউন্ডেশনের কাজে লাগাতেন। সুনামগঞ্জে তিনি ত্রাণ বিতরণ করায় স্থানীয়রা তাকে পল্লীমাতা উপাধি দিয়েছেন। ফাউন্ডেশনের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে অনেক টাকা এনেছেন। এগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা গেছে, ফ্ল্যাট কিংবা গাড়ির সংখ্যা কতগুলো সে বিষয়ে প্রকৃত কোনো তথ্য আমাদের দিতে পারেনি। কখনো ৬টি গাড়ি, কখনো ৮টি গাড়ির কথা উল্লেখ করেন তিনি। এসব বিষয়ে যারা তদন্ত করবেন তারা খতিয়ে দেখবেন। তার আয়ের উৎস সম্পর্কে সিআইডি কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন এ ব্যাপারে কার্যকর ভ‚মিকা রাখবে বলেও মনে করেন র্যাবের এই কর্মকর্তা।
জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীর র্যাবকে আরো জানায়, স¤প্রতি তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। সামাজিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় ছিলেন। বেশ কয়েকবার তিনি নির্বাচন করতে চেয়ে ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র নিজের অবস্থান উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এধরনের অপপ্রয়াস অপতৎপরতা চালিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশের মানুষ তাকে চিনবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, বক্তব্য খুবই উদ্বেগজনক। কাউকে এভাবে হেয় প্রতিপন্নভাবে কথা বলা সমীচীন নয়।
হেলেনা জাহাঙ্গীরের ছিল শক্তিশালী সাইবার টিম : র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আলোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীরের ছিল ২০ লাখ ফলোয়ারের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ। তার পেজ ও জয়যাত্রা আইপি টেলিভিশনের পেজ মনিটরিংয়ের জন্য ছিল শক্তিশালী সাইবার টিম। হেলেনার পেজে অযাচিত ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য এলেই সাইবার টিম তাদের ঘায়েল করতো।
তিনি বলেন, জয়যাত্রা টিভির অফিসে অভিযানের সময় র্যাব জানতে পারে হেলেনা জাহাঙ্গীর একটি শক্তিশালী সাইবার টিম পরিচালনা করতেন। এই টিমে ১৫-২০ জনের নাম পাওয়া গেছে। এই সাইবার টিম একাধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে হেলেনা জাহাঙ্গীরের নামে প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। তারা নিজেরাই লাইক, শেয়ার ও হেলেনার পক্ষে পজিটিভ কমেন্ট করতেন। এমনকি হেলেনার বিরুদ্ধে যদি কেউ নেতিবাচক মন্তব্য করতেন তৎক্ষণাৎ সাইবার টিম তাদের অপমান করে ঘায়েল করতেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীর বলেছেন, নারায়ণগঞ্জে তার পাঁচটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর গুলশান, উত্তরা ও মিরপুরে ১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। পাশাপাশি আটটি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ডজনখানেক ক্লাবের সদস্য তিনি।
হেলেনার সঙ্গে টাকা নয়, হৃদয়ের লেনদেন : সেফুদা
শনিবার ফেসবুক লাইভে এসে সেফাত উল্লাহ সেফুদা বলেন, র্যাব বলেছে আমি নাকি হেলেনা জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিই কিংবা সে নাকি আমাকে টাকা-পয়সা দেয়। এরকম কী কী জানি বলেছে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার টাকা-পয়সার লেনদেন নেই। সম্পদের লেনদেন নেই। হৃদয়ের লেনদেন আছে। তিনি আবার বলেন, অনলাইনে গত প্রায় তিন বছরের কম সময় ধরে আমি তাকে চিনি। মানে আমাকে সে আবিষ্কার করেছে। হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতারের সময় চেহারায় কোনো অনুতাপ নেই (ছিল না)। অনুতাপ থাকবে কেন? তিনি কঠোর পরিশ্রমী একজন শিল্প-উদ্যোক্তা। নিজের পরিশ্রমের ফসল আজ তার কোটি কোটি টাকা, অনেকগুলো শিল্প, অনেক বাড়ি-গাড়ির মালিক। তিনি সমাজের ওপর স্তরের মানুষ। টাকা-পয়সা না থাকলে তার কোনো দাম নেই। গত বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) রাত ১২টার দিকে গুলশানের ৩৬ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাসায় দীর্ঘ প্রায় চার ঘণ্টা অভিযান শেষে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তার বাসা থেকে বিদেশি মদ, অবৈধ ওয়াকিটকি সেট, চাকু, বৈদেশিক মুদ্রা, ক্যাসিনো সরঞ্জাম ও হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের মালিকানাধীন আইপি টেলিভিশন জয়যাত্রার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। তার বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলাও হয়েছে। বর্তমানে তিন দিনের রিমান্ডে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
অনুমোদন ছাড়া টিভি স¤প্রচার, হেলেনাকে রিমান্ডে নিতে চায় পুলিশ : সরকারি অনুমোদন ও বৈধ কাগজপত্র ব্যতীত জয়যাত্রা টিভি স¤প্রচারসহ প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে পরিচালনা করার অভিযোগে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেছে পুলিশ। শনিবার ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলামের আদালতে এ রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইয়ামিন কবির। হেলেনা জাহাঙ্গীর গুলশান থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। শুক্রবার ঢাকা মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ মামলার রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করার দিন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার রিমান্ড শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে আদালতে সূত্রে জানা গেছে।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, হেলেনা জাহাঙ্গীর দীর্ঘদিন ধরে সরকারি অনুমোদন ছাড়া, সংশ্লিষ্ট বৈধ কাগজপত্র ব্যতীত জয়যাত্রা টিভি স¤প্রচারসহ প্রতিষ্ঠানটি অবৈধভাবে পরিচালনা করে আসছে। এমতাবস্থায় মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটন ও জয়যাত্রা টিভি স¤প্রচারসহ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের লক্ষ্যে আসামি হেলেনা জাহাঙ্গীরের সাত দিনের রিমান্ড পাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
এদিকে গতকাল মামলার এজাহার গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম। এর আগে শুক্রবার দিবাগত রাতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন আইনে র্যাব বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন ঢাকা মহানগর হাকিম দেবদাস চন্দ্র অধিকারী। গুলশান থানায় শুক্রবার রাতে র্যাব বাদী হয়ে এ মামলা করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন