বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

রোহিঙ্গারাও মানুষ : প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান

কক্সবাজার থেকে শামসুল হক শারেক | প্রকাশের সময় : ৩ আগস্ট, ২০২১, ৩:৪৮ পিএম

  • বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব অযৌক্তিক
  • প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করাও অমানবিক

বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারের এককালের সমৃদ্ধ আরাকান রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা মুসলিম। সাড়ে তিন শত বছরের আরাকান শাসনের রয়েছে তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস। এমনকি তৎকালীন বার্মার বর্তমান মিয়ানমার শাসন ব্যবস্থায় ও রোহিঙ্গাদের রয়েছে গৌরবময় অবদান। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই
ঐতিহ্যবাহী রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ নারী পুরুষ আজ সব হারিয়ে জীবন যাপন করছে বাংলাদেশের ঝুপড়ি ঘরে।এককালে আদি নিবাস আরাকানে তাদের ক্ষমতা, ধন-সম্পদ, জমিদারী, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই ছিল জৌলুশপূর্ণ। কালক্রমে জালিম সরকারের অধীনে রোহিঙ্গারা সেখানে সংখ্যা লঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।

১৯৪৭ সালের পরে সরকারী বাহিনী ও মগ দস্যুদের বিভিন্ন নামে ছোট বড় শতাধিক অপারেশনে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী পুরুষকে হত্যা করে আরাকানে সংখ্যা লঘুতে পরিণত করা হয় রোহিঙ্গাদের। রোহিঙ্গাদের সহায় সম্পদ ও ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে সেখানে পুনর্বাসিত করা হয় মগ-বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীকে। ১৯৭৮ সালে জ্যান্তা সরকার জঘন্য কালো আইন রচনা করে নাগরিক অধিকারও হরণ করে রোহিঙ্গাদের।
এমনকি ঐতিহাসিক সেই আরাকান রাজ্যের নামটি পর্যন্ত মুছে দিয়ে রাখাইন স্টেট করে জঘন্যতম নজির স্থাপন করে মিয়ানমার জ্যান্তা সরকার।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগ-বৌদ্ধ এবং রাখাইন সন্ত্রাসীরা মিলে ইতিহাসের জঘন্যতম জ্বালাও পুড়াও নীতির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আরাকান ছাড়তে বাধ্য করে।
এসময় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। খুন,গুম, ধর্ষণসহ বর্বরতম নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে বাপ দাদার আদি নিবাস আরাকান ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এসময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। ধর্ষিত হয় আরো হাজার হাজার মুসলিম মা-বোন। এতে আরাকানের বিভিন্ন অঞ্চলের দুর্গম পথ অতিক্রম করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ১২ লাখ রোহিঙ্গা।
রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতা দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দিয়ে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা করে। এতে করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে। অন্য দিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতা দেখানোর কারণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ।

আরাকান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সবাই চোর-ডাকাত তা নয়। তাদের মধ্যে আছেন, আলেম ওলামা, পীর মশায়েখ, হাফেজে কুরআন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী ও মসজিদের ইমাম, মাদরাসার শিক্ষক ও ইসলাম প্রচারকের মত রোহিঙ্গা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা।

তবে শত বছর ধরে মিয়ানমারে জ্যান্তা সরকারের নির্যাতন নিষ্পেষণে শিক্ষা-দীক্ষা বঞ্চিত একটি জাতির কিছু মানুষ তো উশৃংখল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া বিশাল আরাকান রাজ্যের প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী উখিয়া-টেকনাফের মাত্র ৬৫ হাজার বর্গ একর পাহাড়ি এলাকায় গাদাগাদি করে ঝুপড়িতে বসবাস করা কতই মানবেতর তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

এটা সত্যি যে, অবিবেচক কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশী দুর্বৃত্তদের সাথে মিশে নানা দুষ্কর্মে জড়িত হয়ে গোটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বদনাম ডাকছে। তবে তারা আইনের আওতায় আসছে। এই দুর্বৃত্ত চক্র ক্যাম্পের ভেতরে বাইরে দুষ্কর্ম করে হতাহত হচ্ছে। মামলায় জড়িয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হচ্ছে। এভাবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে কয়েক শত। আর হতাহত হয়েছে শত শত। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার আছে দুই সহস্রাধিক। সম্প্রতি আইজিপি বেনজির আহমদ ঢাকায় বলেছেন, ২ হাজার ২০০ শত রোহিঙ্গা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। এর আগে গত সপ্তাহে কক্সবাজার সফরকালে তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলো পাহাড়ে এবং পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় ভারী বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসে বিপদ ডেকে আনে। গত সপ্তাহ ব্যাপী ভারী বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধস ও ঢলে ৫০ হাজার মত রোহিঙ্গা ঝুপড়ি শেড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কমপক্ষে দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এসময় পাহাড় ধসে নিহত হয়েছে ৭ জন রোহিঙ্গা
নারী শিশু।

অথচ এটাও সত্য যে, রোহিঙ্গাদের কারণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর পড়েছে উখিয়া-টেকনাফসহ কক্সবাজারে। তিন সহস্রাধিক বিদেশীসহ লক্ষাধিক নারী পুরুষের চাকরির সুযোগ হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য-মালামাল সাপ্লাইসহ দক্ষ অদক্ষ শ্রমিক মিলে কর্মসংস্থান হয়েছে কমপক্ষে আরো দেড় লাখ মানুষের। এছাড়াও সরকার নানা ভাবে যেমন শত শত কোটি টাকা রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে পাচ্ছে। তেমনি উখিয়া-টেকনাফসহ গোটা কক্সবাজার রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়েছে। পাশাপাশি উন্নয়ন হয়েছে রাস্তা ঘাট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের। এর পরেও হোষ্ট কমিউনিটির জন্য রোহিঙ্গাদের বাজেট থেকে খরচ হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। অথচ রোহিঙ্গারা গাদাগাদি করে অবস্থান করছে সেই ঝুপড়িতেই।

তার পরেও শুনাযায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা বৈষম্য ও অনিয়মের খবর। খাবার (ফুড) কার্ডকে কেন্দ্র করে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে রেজিস্টার্ড পুরাতন রোহিঙ্গারা বিক্ষোভ করছে। তারা অভিযোগ করেছে রেশনকার্ড, খাবার বিতরণে অনিয়মের। গত কয়েকদিন ধরে চেপে থাকা ক্ষোভ তারা প্রতিবাদের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। ক্ষোভে শুধু পুরুষেরা নয়, এবার নারীরাও অংশগ্রহণ নিতে দেখা গেছে।
রবিবার (১ আগষ্ট) ভোর থেকেই পুরাতন রোহিঙ্গারা নয়াপাড়া ক্যাম্পে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী মাত্র ৬৫ হাজার বর্গ একর পাহাড়ি এলাকায় গাদাগাদি করে ঝুপড়িতে বসবাস করলেও কক্সবাজারসহ সারাদেশের তুলনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমুহে করোনা সংক্রামণ হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম। ক্যাম্প গুলোতে সময়মতো করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য বিধি প্রতিপালনে রোহিঙ্গাদের
বাধ্য করায় ক্যাম্প সমুহে করোনা সংক্রমণ অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনায় গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ২৮ জন রোহিঙ্গা। আর আক্রান্ত হয়েছে দুই হাজারের চেয়ে কিছু বেশী।

জানা গেছে, ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা আলেম ওলামা, পীর মশায়েখ ও মুবাল্লিগরা সেখানে নির্মিত শত শত মসজিদ ও মক্তবে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করেছেন রোহিঙ্গাদের। এতে করে তারা সচেতন হয়েছে, সংক্রমন তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে।

হ্যাঁ, এটি ভালো উদ্যোগ যে,
সরকার আগামী ১০ আগষ্ট থেকে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করতে যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ৫৫ বছর ও তদুর্ধ বয়সী শরনার্থীদের করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।

প্রসঙ্গত রোহিঙ্গা সমস্যাটি সম্পূর্ণভাবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। রোহিঙ্গাদের আদিনিবাস আরাকানে সমস্যার কারণে তারা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। সেই সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েই ২১ দফা দাবীতে নিজ দেশে ফিরে যেতে আকুতি জানিয়েছিল মিয়ানমার সরকারসহ বিশ্ব সম্প্রায়ের কাছে। সেই দাবী পূরণ হলে তারা এখনো তাদের দেশে ফিরে যেতে রাজি।
এসব দবীতে ছিল, নাগরিক অধিকারসহ তাদের ফিরিয়ে নেয়া, পুড়িয়ে দেয়া সহায় সম্পদের ক্ষতিপূরণ দেয়া। সকল শিক্ষার অধিকার দেয়া, তাদের
বাড়ি ঘর জমি জমা কোন শর্ত ছাড়া কাগজে কলমে ফেরত দেয়া, রোহিঙ্গাদের আবাসভূমির পুরনো নাম আরাকান এস্টেট করা, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা বাণিজ্যের অধিকার এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মালামালের নিরাপত্তা প্রদান করা। আরাকান প্রদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা বিচার ব্যবস্থা ও রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগ দেয়া। মিয়ানমারে কারাবন্দী রোহিঙ্গাদের নিঃশর্ত মুক্তি ও এবং আরকান প্রদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা কারাগার স্থাপন করা। রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা মুসলিম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা। যে কোন এনজিও এবং দেশী বিদেশী সাংবাদিকদেরকে আরাকানে প্রবেশ করার অধিকার দেয়ার পাশাপাশি নিজস্ব মিডিয়া-টিভি চ্যানেল সম্প্রচারে কোন বাধা না দেয়া। আরাকান প্রদেশের অস্ত্রধারী বৌদ্ধদের নিরস্ত্রীকরণ, রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও যুবকদের উপর সংগঠিত গণহত্যা ও ধর্ষণের বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে করা। রোহিঙ্গাদের মসজিদ মাদরাসা, মকতব ও তাবলীগের মরকজসহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা দেয়া। সকল সরকারী চাকরীতে সুযোগ দেয়া, পুরো আরাকানে ও মিয়ানমারে যে কোন জায়গায় রোহিঙ্গাদের চলাফেরা করার অধিকার দেয়া। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের পাসপোর্ট প্রদান ও বিদেশ গমনের সুযোগ দেয়া। কোন মামলা ছাড়া সেনা, পুলিশ সহ কোন বাহিনী অনর্থক রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘরে চেকের নামে না ঢোকা। রোহিঙ্গা আলেম-ওলামাদেরকে পাঞ্জাবী পায়জামা টুপি পরনে বাধা না দেয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় কাজে বাধা না দেয়া ও গবাদী পশু, হাস মুরগী পালনে কোন ক্ষতিপূরণ না নেয়া।
রোহিঙ্গারা এখনো বলছে তারা বাংলাদেশে থাকতে চায়না। যতদ্রুত সম্ভব তারা তাদের নিজ দেশে ফিরতে চায়। কিন্তু মিয়ানমার সরকার গড়িমসি করছে বলেই প্রত্যাবাসন ঝুলে রয়েছে। তাই বলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী নাগরিকদের সাথে একীভূত করার বিশ্ব ব্যাংকের আবদার মেনে নেয়া যায়? এই আবদার হাস্যকর ও অযৌক্তিক বলে মনে করেন সচেতন মহল। বিশ্ব ব্যাংকের এই অযৌক্তিক আবদারে কক্সবাজারের মানুষ প্রচন্ডভাবে ক্ষুদ্ধ৯ হয়ে উঠেছে। অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন ওই আবদার নাকচ করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। অভিজ্ঞ মহলের মতে
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন